-->

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা

ওবায়দুল কাদের-জয়সহ ৪৫ জন আসামি

ভোরের আকাশ প্রতিবেদক
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা

গত সাড়ে ১৫ বছরে সারাদেশে চালানো গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধে যুক্ত থাকার অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। একই সঙ্গে দলের সাধারণ সম্পাদক সাবেক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, প্রধানমন্ত্রীর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক মুক্তিযোদ্ধা বিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, সাবেক সমাজকল্যাণমন্ত্রী দীপু মনি, সাবেক তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, সাবেক তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত, বিচারপতি এএইচ শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক, অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল, ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) সাবেক অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশীদ, পুলিশ কর্মকর্তা হাবিবুর রহমান, বিপ্লব বড়ুয়াসহ ৪৫ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে।

বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গতকাল বৃহস্পতিবার এ আদেশ দিয়েছেন। দুই সদস্য হলেনÑ বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী। পুনর্গঠিত এই ট্রাইব্যুনাল গতকাল প্রথম বিচার কাজ শুরু করেন। আর বিচার কাজের শুরুর দিনেই সাবেক প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করলেন ট্রাইব্যুনাল।

আগামী ১৮ নভেম্বর আসামিদের গ্রেপ্তারের অগ্রগতি সংক্রান্ত প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। প্রসিকিউশন টিমের পৃথক দুটি আবেদনে এ আদেশ দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল।

রাষ্ট্রপক্ষে আসামিদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আবেদন উপস্থাপন করেন চিফ প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। ২০০৯ সালের পর থেকে গত ৫ আগস্ট পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামল এবং জুলাই-আগস্টে তাদের ভূমিকা তুলে ধরে এই আবেদন করা হয়। এ সময় অপর প্রসিকিউটর গাজী এম এইচ তামিম, বি এম সুলতান মাহমুদ উপস্থিত ছিলেন।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে গত ৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা।

আত্মগোপনে যান সাবেকমন্ত্রী, সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ আওয়ামী লীগ সমর্থক বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা, বিভিন্ন পর্যায়ের পট পরিবর্তনের পর প্রথমবারে মতো গতকাল বৃহস্পতিবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার কাজ শুরু হয়। এদিন বেলা সাড়ে ১১টার দিকে কোর্টের কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর চিফ প্রসিকিউটর প্রথমে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অভিযোগ পড়ে শোনান। এরপর তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আবেদন জানান। তিনি বলেন, আসামির বিরুদ্ধে তদন্তে গণহত্যার প্রাথমিক অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে। আসামি প্রভাবশালী। এখনো দেশের বিভিন্ন স্থানে আসামির লোকজন বিভিন্ন পজিশনে আছে। তাই আলামত নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এছাড়া মামলার তদন্ত কাজ বাধাগ্রস্ত হতে পারে। তাই আসামির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আবেদন করছি।

এ সময় সংবিধানের বিভিন্ন সংশোধনী, ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা নেয়ার পর থেকে গুম, খুন, তথ্যপ্রযুক্তি আইনে হওয়া মামলার পরিসংখ্যান, অর্থ পাচারের পরিসংখ্যান এবং সর্বশেষ ছাত্র আন্দোলনে বল প্রয়োগের তথ্য তুলে ধরেন তিনি। তিনি সূচনা বক্তব্যে ২০০৯ সালে বিডিআর বিদ্রোহে ৭৪ জনকে হত্যা, ২০১৩ সালে শাপলা চত্বরে হেফাজতের সমাবেশে ‘হত্যা’, র‌্যাবের বিচার বহির্ভূত হত্যা, ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট ‘গণহত্যা’সহ আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে ‘মানবতাবিরোধী অপরাধের’ সারসংক্ষেপ তুলে ধরেন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়াও তার সরকারের মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী, সাহিত্যিক ও গণমাধ্যমকর্মীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে ধরা হয়। আবেদনে অপরাধের ঘটনা স্থান হিসেবে সমগ্র বাংলাদেশকে দেখানো হয়েছে।

ওবায়দুল কাদেরসহ অপরাপর আসামির বিরুদ্ধে করা আবেদনে বলা হয়, এক থেকে নয় নম্বর আসামির নির্দেশ ও পরিকল্পনায় অন্যান্য আসামিরা দেশীয় ও আগ্নেয়াস্ত্র দ্বারা নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারী সাধারণ নিরস্ত্র ছাত্র-জনতাকে হত্যা করে তাদের সমূলে বা আংশিক নির্মূল করার উদ্দেশ্যে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটন করে।

তিনি বলেন, হেলিকপ্টর থেকেও গুলি ও বোমা বর্ষণ করা হয়। তিনি বলেন, কমপক্ষে ১ হাজার ৫০০ ছাত্র-জনতাকে হত্যা করা হয়েছে। আন্দোলনের সময় শতাধিক শিশু নিহত হয়েছে। অনেক শিশু ঘরের মধ্যে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছে। নিহত ছাত্রদের লাশে আগুন দেয়া হয়েছে। লাশ মাটি চাঁপা দেয়া হয়েছে। অনেক লাশ ময়নাতদন্ত ছাড়াই দাফন করা হয়। এটা বিশ্বের ইতিহাসে একটি ঘৃণ্য ও জঘন্য হত্যাকাণ্ড। আন্দোলনে হাজার হাজার ছাত্র-জনতা আহত হন। তাদের চিকিৎসা দিতে বাধা দেয়া হয়। অনেকে চিকিৎসার অভাবে মৃত্যুবরণ করেন। রাস্তায় রাস্তায় আহত রোগীবাহী অ্যাম্বুলেন্সে বাধা দেয়া হয়। এমনকি অ্যাম্বুলেন্স ভাঙচুর ও আগুন দেয়া হয়।

সাভারে এমআইএসটির শিক্ষার্থী শাইখ আসহাবুল আসহাবুল ইয়ামিনকে হত্যার ঘটনা তুলে ধরেন। তিনি ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে পুলিশের সাঁজোয়া যান থেকে গুলিবিদ্ধ ইয়ামিনের নিথর দেহ টেনে নীচে ফেলার ঘটনা বর্ণনা দেন। তিনি বলেন, গাড়ি টান দেয়ার সময় চাকার নীচে পড়বে বলে দেহটি টেনে দূরে সরানো হয়। তখনও সেই দেহটি নড়তে দেখা যায়। এমন একটি লোমহর্ষক ভিডিও ভাইরাল হয়ে পড়ে নেট দুনিয়ায়।

তাজুল ইসলাম বলেন, ছাত্র আন্দোলনে শেখ হাসিনার সংবাদ সম্মেলনের উসকানিমূলক বক্তব্য রাখেন। কয়েকজন সাংবাদিকও উসকানি দেন। সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষার্থীদের রাজাকার বলা হয়। ইস্টারনেটসেবা বন্ধ করে দিয়ে গণহত্যার তথ্য আড়াল করা হয়, সঠিক তথ্য জানতে বাধা দেয়া হয়।

গতকাল শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে করা আবেদনের শুনানির এক পর্যায়ে আদালত জানতে চান, রাষ্ট্রীয়ভাবে আসামির অবস্থান জানেন কি না। জবাবে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, না। তারপর আদালত চিফ প্রসিকিউটরের আবেদন মঞ্জুর করে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আদেশ দেন। আদেশে ১৮ নভেম্বর মামলার পরবর্তী তারিখ রেখে এই সময়ের মধ্যে আসামিকে আদালতে হাজির করতে বলেন। এরপর দ্বিতীয় আবেদনে ৪৫ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে ধরেন চিফ প্রসিকিকিউটর। আদালত একই আদেশ দেন।

পরে তাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, আমরা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আবেদন করেছিলাম। আদালত আমাদের আবেদন মঞ্জুর করেছেন। আদালত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তার করার নির্দেশ দিয়েছেন। ১৮ নভেম্বরের মধ্যে তাকে গ্রেপ্তার করে এই আদালতে উপস্থিত করার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন, জুলাই-আগস্টে সংঘঠিত মানবতাবিরোধি অপরাধ, গণহত্যার বিস্তারিত বিবরণ এবং একই সঙ্গে একটি সরকারের দানবীয় সরকারে পরিণত হওয়া, নিরস্ত্র সাধারণ ছাত্রদের গুলি করে হত্যার প্রেক্ষাপট আদালতে তুলে ধরা হয়েছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে এবং আন্তর্জাতিক আইনে যেসব ব্যবস্থা রয়েছে, সে সব প্রক্রিয়া গ্রহণ করে এই গ্রেপ্তারি পরোয়ানা কার্যকর করা হবে। তিনি বলেন, এই অপরাধীদের অনেকে এখনো রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে রয়েছেন। সে কারণে তাদের সবার নামপ্রকাশ করা হচ্ছে না।

জানা গেছে, ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা শেখ হাসিনা এবং অপরাপর আসামিদের বিরুদ্ধে প্রাথমিক অনুসন্ধান শেষে একটি প্রতিবেদন প্রসিকিউশন টিমের কাছে দাখিল করে।

ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রাথমিক অনুসন্ধানে আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে। এই অপরাধের আসামি যারা, তারা অসম্ভব রকমের প্রভাবশালী, তাদের গ্রেপ্তার করা না হলে তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করাটা অসম্ভব কঠিন। তাদের ভয়ে সাধারণ মানুষ, এমনকি শহীদ পরিবারের সদস্যরা কথা বলতে সাহসী হচ্ছেন না। এখনো দেশের বিভিন্ন স্থানে আসামির লোকজন বিভিন্ন পজিশনে আছে। আসামিদের দ্রুত গ্রেপ্তার না করা হলে আলামত নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে আসামিদের গ্রেপ্তার করা প্রয়োজন। এই প্রতিবেদন ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপন করেন চিফ প্রসিকিউটর।

নিয়ম অনুযায়ী ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা এখন তদন্ত করে একটি প্রতিবেদন দাখিল করবে। যা যাচাই-বাছাই শেষে ফরমাল চার্জ বা আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আকারে ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপন করবে প্রসিকিউশন টিম। আনুষ্ঠানিক অভিযোগের ওপর শুনানি শেষে ট্রাইব্যুনাল আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করলেই কেবল মূল বিচার কাজ শুরু হবে।

শেখ হাসিনা, তার মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, ১৪ দলীয় জোটের শরিক দলের নেতা, পুলিশের তৎকালীন আইজিসহ বেশ কয়েকজন সদস্য, র‌্যাবের তৎকালীন ডিজি, আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ নেতাদের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগে এ পর্যন্ত অর্ধশতাধিক অভিযোগ জমা পড়েছে।

একাত্তরে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে। এই ট্রাইব্যুনালের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয় ২০১০ সালের ২৫ মার্চ। পরে ২০১২ সালের ২২ মার্চ ট্রাইব্যুনাল-২ নামে আরেকটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। ২০১৫ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর দুটিকে একীভূত করে আবার একটি ট্রাইব্যুনাল করা হয়। এখন একটি ট্রাইব্যুনালে (আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১) চলছে বিচারকাজ।

ওই ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যানকে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি করায় এবং অপর এক সদস্যকে হাইকোর্টে ফিরিয়ে নেয়ায় বিচার কাজ বন্ধ হয়ে যায়। এমন অবস্থায় গত ৫ আগস্ট পট পরিবর্তনের পরেই তিন সদস্যেও ট্রাইব্যুনালের অপর সদস্য অব্যাহতি নেন। এমন অবস্থায় গত ১৪ অক্টোবর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করে সরকার। ১৫ অক্টোবর ট্রাইব্যুনালে যোগ দেন তিন সদস্যের বিচারক প্যানেল। ১৬ অক্টোবর তাদের এজলাসে প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে সংবর্ধনা দেয়া হয়।

গতকাল প্রথমবারের মতো বিচার কার্যক্রম শুরু করেন ট্রাইব্যুনাল।

 

ভোরের আকাশ/মি

মন্তব্য

Beta version