শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে রাজশাহীর সারদা পুলিশ একাডেমিতে চূড়ান্তভাবে নিয়োগের জন্য সুপারিশপ্রাপ্ত ও প্রশিক্ষণরত ২৫২ জন উপপরিদর্শককে (এসআই) অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। গত সোমবার তাদের অব্যাহতি দেওয়া হয়। তবে বিষয়টি গতকাল মঙ্গলবার জানাজানি হয়। এরপরই শুরু হয় নানা আলোচনা-সমালোচনা। রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে তাদের অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে বলে মনে করছেন অপরাধ বিশ্লেষকরা। এটাকে খারাপ নজিরও বলছেন তারা। লঘু পাপে গুরু দণ্ড পাওয়ায় পুলিশে নেগেটিভ প্রভাব পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। তবে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী জানিয়েছেন, প্রশিক্ষণরত আড়াইশ ক্যাডেট এসআইকে অব্যাহতি দেওয়ার পেছনে ‘কোনো রাজনৈতিক কারণ নেই’।
জানা গেছে, সোমবার একাডেমির অধ্যক্ষের পক্ষে পুলিশ সুপার (অ্যাডমিন অ্যান্ড লজিস্টিক) তারেক বিন রশিদ স্বাক্ষরিত চিঠিতে সারদা পুলিশ একাডেমিতে চূড়ান্তভাবে নিয়োগের জন্য সুপারিশপ্রাপ্ত ও প্রশিক্ষণরত ২৫২ জন উপ-পরিদর্শককে (এসআই) অব্যাহতি দেওয়া হয়। ঠিঠিতে বলা হয়, বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমি প্যারেড মাঠে ১ অক্টোবর সকাল ৭টা ২৫ মিনিট থেকে ৪০তম বিসিএস (পুলিশ) প্রবেশনারস ব্যাচ-২০২৩-এর সমাপনী কুচকাওয়াজ অনুশীলন প্যারেড কার্যক্রম চলমান ছিল। এ সময়ে বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমি সারদা, রাজশাহী কর্তৃক পূর্বনির্ধারিত মেন্যু অনুযায়ী প্যারেডে অংশগ্রহণকারী সব প্রশিক্ষণার্থীর প্যারেড বিরতিতে সকালের নাশতা পরিবেশন করা হয়। কিন্তু আপনি উক্ত সরবরাহকৃত নাশতা না খেয়ে হই চই করে মাঠের মধ্যে চরম বিশৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টি করেন। আপনি অন্যান্য প্রশিক্ষণরত ক্যাডেট এসআইদের পরস্পর সংগঠিত করে একাডেমি কর্তৃপক্ষকে হেয়প্রতিপন্ন করে চরম বিশৃঙ্খলা ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করতে থাকেন। এ ছাড়া আপনি অন্যদের সঙ্গে হই চই করতে করতে নিজের খেয়ালখুশিমতো প্রশিক্ষণ মাঠ থেকে বের হয়ে নিজ ব্যারাকে চলে যান। একজন প্রশিক্ষণরত ক্যাডেট এসআই হিসেবে এরূপ আচরণ এবং বিনা অনুমতিতে প্যারেড মাঠ থেকে বের হয়ে নিজ ব্যারাকে চলে যাওয়া সম্পূর্ণভাবে শৃঙ্খলাপরিপন্থি। আপনার এরূপ আচরণ মাঠের সার্বিক প্রশিক্ষণ কার্যক্রমকে চরমভাবে ব্যহত করেছে এবং অন্য প্রশিক্ষণার্থীদের শৃঙ্খলাভঙ্গে উৎসাহিত করেছে মর্মে আপনার বিরুদ্ধে শৃঙ্খলাভঙ্গের কারণে পুলিশ পরিদর্শক মহসিন আলী (বিপি- ৬৯/৮৭০০১৫২০) বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমির অধ্যক্ষ (অতিরিক্ত আইজিপি) বরাবর লিখিত প্রতিবেদন দাখিল করেছেন।
ওই চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, ‘ওই অভিযোগের কারণে একাডেমির অধ্যক্ষের পক্ষে পুলিশ সুপার (অ্যাডমিন অ্যান্ড লজিস্টিকস) তিন দিনের মধ্যে কৈফিয়তের জবাব দাখিল করার জন্য নির্দেশনা দেন। আপনি নির্ধারিত তিন দিন সময়ের মধ্যে কৈফিয়তের জবাব দাখিল করেন। আপনার দাখিলকৃত কৈফিয়তের জবাব পর্যালোচনান্তে সন্তোষজনক নয় মর্মে প্রতীয়মান হয়। আপনার উপরোক্ত শৃঙ্খলাবিরোধী কর্মকাণ্ড বাংলাদেশ পুলিশের গুরুত্বপূর্ণ ও দায়িত্বশীল পদ হিসেবে বিবেচিত সাব-ইন্সপেক্টর পদে কাজ করার পথে বড় ধরনের অন্তরায় ও অযোগ্যতার শামিল।
এর আগে ২০ অক্টোবর চারঘাটে পুলিশ একাডেমিতে ৬২ জন সহকারী পুলিশ সুপারের প্রশিক্ষণ সমাপনী কুচকাওয়াজ স্থগিত করা হয়েছিল। অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা রাজশাহীতেও গিয়েছিলেন। তখন তিনি সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অনিবার্য কারণে এই কুচকাওয়াজ স্থগিত করা হয়েছে।
অব্যাহতি পাওয়া কয়েকজন উপপরিদর্শক জানান, ওই কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানের আগে ৪০তম ক্যাডেট এসআই-২০২৩ ব্যাচের উপ-পরিদর্শকদের একাংশকে ১৯-২৩ অক্টোবর ছুটিতে পাঠানো হয়। আগের দিন ১৮ অক্টোবর এই ছুটি ঘোষণা করা হয়। ২৩ অক্টোবর সন্ধ্যা ছয়টায় তাদের একাডেমিতে উপস্থিত হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। তবে এর আগেই স্থানীয় থানাগুলোয় তাদের ২৫২ জনের বরখাস্তের আদেশ পাঠিয়ে দেওয়া হয়। আবার ছুটি পাওয়া প্রশিক্ষণার্থীদের একাংশ যথারীতি যোগদান করেছেন।
এ সম্পর্কে পুলিশ একাডেমির অধ্যক্ষ ও অতিরিক্ত আইজিপি মাসুদুর রহমান ভুঞা বলেন, শৃঙ্খলাভঙ্গের কারণে প্রশিক্ষণরত ২৫২ জন উপ-পরিদর্শক (এসআই) পদমর্যাদার কর্মকর্তাকে পর্যায়ক্রমে ‘ডিসচার্জ’ করা হচ্ছে। এটার প্রসেস চলছে। চিঠি ইস্যু হচ্ছে। একাডেমি তাদের শৃঙ্খলাভঙ্গের কারণে বের করে দিয়েছে। এর চেয়ে আরও বেশি সংখ্যায় বের করা হয়। পুরো ব্যাচ ধরে কখনো বের করে দেওয়া।
গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির তৃতীয় সভা শেষে সাংবাদিকদের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, রাজনৈতিক পরিচয় নয়, শৃঙ্খলাভঙ্গের দায়ে ২৫২ জন এসআইকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
ঠিক কী কারণে তাদের অব্যাহতি দেওয়া হলো জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, শৃঙ্খলার সংজ্ঞা তো অনেক বড়। এটা তো একাডেমি বলতে পারবে। আমাদের সেনাবাহিনীতে দেখছি পাসিং আউটের আগেরদিনও অনেককে ফেরত পাঠানো হয়। এত বড় সংখ্যায় ক্যাডেট এসআইকে অব্যাহতি দেওয়ার ফলে যে শূন্যতা তৈরি হলো, তা কীভাবে পূরণ করা হবে জানতে চাইলে উপদেষ্টা বলেন, তেমন কোনো সমস্যা হবে না। আমরা তো নতুন নিয়োগের সার্কুলার দিয়েছি।
যাদের অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে, তাদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল গত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে। গত বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি শেখ হাসিনার সরকার পতনের আগ মুহূর্তে নিয়োগ করা ৮০৩ জন এসআই এবং ৬৭ জন এএসপির নিয়োগ বাতিলের দাবি জানিয়েছিল।
এই এসআইরা ছাত্রজীবনে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকার কারণে তাদের অব্যাহতি দেওয়া হলো কি না জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, একাডেমি তাদের শৃঙ্খলাভঙ্গের কারণে বের করে দিয়েছে। এর চেয়ে আরও বেশি সংখ্যায় বের করা হয়। পুরো ব্যাচ ধরে কখনো বের করে দেওয়া হয়। বিজিবিতে একবার পুরো ব্যাচ ধরে বের করে দেওয়া হয়। এ রকম হতে পারে। ডিসিপ্লিন শব্দটাতো বিরাট বড়। এখানে কোনো রাজনৈতিক কারণ নেই।
ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক বলেন, শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে পুলিশের যেকোনো সদস্যকে চাকরিচ্যুতির বিধান রয়েছে। তবে লঘু পাপে গুরুদণ্ড দেওয়াটা খুব একটা সুখকর নয়। পুলিশে নিয়োগের আগে ভালোভাবে যাচাই-বাছাই করা উচিত। সবারই রাজনৈতিক মতাদর্শ আছে। তবে সেটা পেশাগত জায়গায় প্রয়োগ না করলেই হলো। রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে কারো চাকরিচ্যুতি খুবই খারাপ দৃষ্টান্ত।
পুলিশ আইন অনুযায়ী, কোনো সদস্য অপরাধে জড়ালে তার বিরুদ্ধে দুই ধরনের বিভাগীয় শাস্তির (লঘু ও গুরু) বিধান রয়েছে। গুরুদণ্ডের আওতায় চাকরি থেকে বরখাস্ত, পদোন্নতি স্থগিত, বেতন বৃদ্ধি স্থগিত ও চাকরিকালীন সুযোগ-সুবিধা রহিত করা হয়। বিসিএস ক্যাডারের পুলিশ কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রে সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮ (শৃঙ্খলা ও আপিল) অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয়। সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) থেকে তদূর্ধ্ব কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ খতিয়ে দেখতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগে একটি সেল রয়েছে।
সাবেক আইজিপি মোহাম্মদ নুরুল হুদা বলেন, পুলিশ অপরাধ করলে সেটা প্রথমে নিজ বাহিনীতে বিচার হয়। শাস্তির ব্যবস্থাটা ভালো। যেকোনো অপরাধের শাস্তি হলে শৃঙ্খলা থাকে। তবে বর্তমান সময়ে পুলিশের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ বাড়ছে, এসব বিষয়ে পুলিশের ওপর মহলের নজর বাড়ানো উচিত।
পুলিশ সদর দপ্তরের একটি সূত্রমতে, ২০১৩-এর জানুয়ারি থেকে ২০২৩ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ১০ বছরে ১ লাখ ৭৩ হাজার ৩৩৯ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে সদর দপ্তর ও সংশ্লিষ্ট জায়গায় অভিযোগ জমা পড়েছে। এর মধ্যে ২০১৩ সালে ১৫ হাজার ৬০ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ পড়ে। ১৪ হাজার ৬০ জনের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়। ২০১৪ সালে ১৫ হাজার ২৯৭ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসে। এর মধ্যে ১৪ হাজার ৪০০ জনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। ২০১৫ সালে ১১ হাজার ১৬৭ জন পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসে। এর মধ্যে বিভিন্ন অপরাধে ১০ হাজার ৩৪ পুলিশ সদস্যকে বিভাগীয় শাস্তি দেওয়া হয়েছে। ২০১৬ সালে ১৩ হাজার ৫৮৬ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগের ভিত্তিতে ১৩ হাজার ১০০ জনের শাস্তির ব্যবস্থা নেওয়া হয়। ২০১৭ সালে অভিযোগ পড়ে ১৬ হাজার ২৫৮টি। এর মধ্যে ১৬ হাজার পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়। যার মধ্যে ১৪ হাজার ৩৯৫ জনকে (কনস্টেবল থেকে এসআই পদবির) লঘুদণ্ড, ইন্সপেক্টর পদমর্যাদার ৩৫৭ জনকে গুরুদণ্ড ও ২৯ জনকে লঘুদণ্ড, সাতজনের বিরুদ্ধে সাময়িক বরখাস্তসহ বিভাগীয় শাস্তি এবং ২৫ জনকে চাকরিচ্যুত করা হয়। ২০১৮ সালে ১৫ হাজার ৭৩৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসে। এর মধ্যে ১৪ হাজার ৪০২ জন পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এ ছাড়া ২০১৯ সালে ১৫ হাজার ৫১২ জন পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ জমা হয়। শাস্তি হয় ১৪ হাজার ৭১৭ জনের বিরুদ্ধে। ২০২০ সালে ১৬ হাজার, ৩১২ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ এলে শাস্তি হয় ১৫ হাজার ২১২ জনের। ২০২১ সালে ১৬ হাজার ৮১৮ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ জমা পড়ে সদর দপ্তরে। এর মধ্যে ১৫ হাজার ৩১২ জনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। ২০২২ সালে অভিযোগ বেড়ে ১৮ হাজার ৬১৮ হয়। যার মধ্যে শাস্তি হয় ১৭ হাজার ৫১৮ জনের এবং ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৯ হাজার ১৮ জন পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগে আসে। যার মধ্যে ১৮ হাজার ৫২৮ জনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। মোট ১০ বছরে ১ লাখ ৭৩ হাজার ৩৩৯ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে বিভিন্ন অভিযোগ পড়ে। তবে একাধিকবার একই ব্যক্তির বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ পড়ে। এর মধ্যে পুলিশ কনস্টেবল ও এএসআই এবং এসআইয়ের (সাব-ইন্সপেক্টর) সংখ্যা বেশি। এসব অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় পুলিশ সদর দপ্তর অভিযোগ আমলে নিয়েই বিভিন্ন শাস্তি দিয়েছে ১ লাখ ৬৩ হাজার ৮৩ জনকে।
পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর বলেন, পুলিশ বাহিনীর যেকোনো সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ এলে তা তদন্ত করা হয় এবং সেটা সংশ্লিষ্ট ইউনিটে পাঠানো হয়। তারা বিষয়টি খতিয়ে দেখে শাস্তির সুপারিশ করেন।
ভোরের আকাশ/রন
মন্তব্য