-->

ফের অস্থির চালের বাজার

হেলাল সাজওয়াল
ফের অস্থির চালের বাজার

জুলাই-অগাস্টে এক দফা বৃদ্ধির পর এখন নতুন করে বাড়ছে চালের দাম। সপ্তাহখানেকের ব্যবধানে বাজারে বিভিন্ন ধরনের চালের দাম কেজিতে ২ থেকে ৪ টাকা বেড়েছে। ব্যবসায়ীদের কেউ বলছেন বন্যার কারণে চালের দর বাড়ছে, আবার কেউ বলছেন একটি চক্র ‘কারসাজি’ করে দাম বাড়াচ্ছে। গুদামে গুদামে অভিযান চালানোর পরামর্শ দিচ্ছেন তারা। এমন পরিস্থিতিতে বেসরকারি খাতে চাল আমদানি বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এর অংশ হিসেবে আমদানি শুল্ক কমানো হয়েছে।

রাজধানীতে চালের বৃহৎ আড়ত বাবুবাজারের অন্তু-সেন্টু রাইস এজেন্সির বিক্রেতা আব্দুল জলিল বলেন, গত এক সপ্তাহে সব চালেই দাম বেড়েছে মোটামুটি দুই-আড়াই টাকার মতো। আর ব্রি ২৮ চালে বেড়েছে চার টাকা।

‘আটাশ চাইল আগে বিক্রি করছি ৫৬-৫৭ টাকায়, এটা এখন ৬০ টাকা। আবার পাইজামও আটাশের মতোই দাম ছিল, এটা এখন ৬০ টাকা। মানে এখন পাইকারিতে ৬০ টাকার নীচে কোনো চাইল নাই। শুধু মোটা চালের দাম ৪৯ টাকা, কিন্তু এটাও আগে ৪৭ টাকা ছিল। তবে মিনিকেট বা নাজিরশাইলে বাড়ে নাই। মানুষের কাছে টাকা নাই, তাই চাহিদা কম। মিনিকেট চাল আগের মতোই ৭৩ থেকে ৭৫ থেকে টাকা এবং নাজিরশাইল ৭৫ থেকে ৮৮ টাকা কেজি দরে বিক্রির কথা বললেন এই পাইকারি ব্যবসায়ী।

কৃষি মার্কেটের পাইকারি দোকান মেসার্স মাস্টার এন্টারপ্রাইজের বিক্রেতা জালাল উদ্দিনও একই রকম কথা বললেন। তিনি ব্রি-২৮ ও পাইজাম বিক্রি করছেন ৬৪ টাকা কেজি দরে। দাম বাড়ার কারণ নিয়ে প্রশ্ন করলে জালাল বলেন, বন্যার কারণে একটা প্রভাব থাকলেও মূল প্রভাব তৈরি হচ্ছে বড় বড় কোম্পানিগুলোর জন্য। তারা এই শেষ সময়ে মজুত করে সংকট দেখানোর চেষ্টা করছে।

সরকারকে ডিমের মতো চালের গুদামে অভিযান চালানোর পরামর্শ দিয়ে এই পাইকার বলেন, বলতে হবে হাজার হাজার বস্তা গুদামে রাখা আছে কেন। বড় বড় গ্রুপের যেসব মিল আছে সেগুলোতে অভিযান দরকার। আর বন্যা হয়েছে তাই অনেক কৃষকও ধান বিক্রি কমিয়েছে। ধান সংগ্রহকারীরাও আটকে দিছে। সবাই সংকট দেখাচ্ছে, তাই দাম বাড়ছে।

কারওয়ান বাজারের ঢাকা রাইস এজেন্সির বিক্রেতা মো. সায়েম জানালেন, তিনি ব্রি-২৮ চাল পাঁচদিন আগেও ৫৬ টাকা কেজি দরে কিনে বিক্রি করতেন ৫৮ টাকায়। এখন ৬০ টাকা কেজিতে কিনে ৬২ টাকায় বিক্রি করছেন। আগামী মাসে ব্রি-২৮ জাতের নতুন ধান এলেই দাম কমে আসবে বলে আশা করছেন এই বিক্রেতা। সায়েম বলেন, গত সপ্তাহেও তিনি মিনিকেট বিক্রি করেছেন ৭০ থেকে ৭২ টাকা কেজি, এখন ৭২ থেকে ৭৪ টাকা। পাইজাম আগে ছিল ৫৮ টাকা, এখন ৬০ টাকা, স্বর্ণা আগে ৪৮ থেকে ৫০ টাকা ছিল, এখন ৫০ থেকে ৫২ টাকা।

কারওয়ান বাজারের মেসার্স জনপ্রিয় রাইস এজেন্সির বিক্রেতা শফিকুল আলম জানালেন, এক সপ্তাহ আগে তিনি ব্রি ২৮ চাল বিক্রি করতেন ৫৭ টাকায়, এখন কেজি ৬০ টাকা। দাম আরও বাড়বে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণেই দাম বাড়তেছে। কুমিল্লা অঞ্চলে তো বন্যায় সব শেষ। এরপর আরো প্রভাব পড়ছে উত্তরাঞ্চলের বন্যায়। মৌসুম শেষে চালের দাম কেজিতে দুই-এক টাকা বাড়া ‘স্বাভাবিক’ মন্তব্য করে তিনি বলেন, দাম এখন আরও বাড়বে, নতুন চাল আসলে কমে যাবে।

কারওয়ান বাজারের ‘জনপ্রিয় রাইস এজেন্সি’ থেকে ৩৫০০ টাকা দরে সাত বস্তা মিনিকেট চাল কিনেছেন ইমন নস্কর। মিন্টো রোডে তার খাবারের হোটেল রয়েছে। সে জন্য তার একদিন পরপর চাল কিনতে হয়। ইমন নস্কর সবসময় জনপ্রিয় রাইস এজেন্সি থেকে চাল কেনেন। তাই জনপ্রিয় রাইস এজেন্সি কম দামে কেনা আগের চাল দিয়েছে তাকে। তিনি বলেন, যার কাছ থেকে কিনি সে বলল দুই দিনের ভিতরে নতুন চালের গাড়ি এলে দাম বস্তা প্রতি ১০০ টাকা করে নাকি বেশি হবে। ইমন নস্করের সঙ্গে কথা বলার সময় এগিয়ে এলেন ঢাকা রাইস এজেন্সির বিক্রেতা মো. সায়েম। তিনি বললেন, আমি আজ কিনেই আনছি ৩৫০০ টাকা বস্তা। আর আপনার কাছে এই দামে বিক্রি করছে। দেখেন, দুইদিন পরে আইসা ভুলেও পাইবেন না এই দামে।

পাইকারিতে দাম বৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে খুচরা বাজারেও। বিজয় সরণি এলাকার কলমিলতা কাঁচা বাজারে ইমরান রাইসের বিক্রেতা সালমান খুচরায় প্রতি কেজি গুটি স্বর্ণা ৬০ টাকা, ব্রি-২৮ কেজি প্রতি ৬৫ টাকা, মিনিকেট ৭২ টাকা ও নাজিরশাইল মানভেদে ৭৫ থেকে ৮০ টাকায় বিক্রি করছেন। তিনি বলেন, চালের সিজন শেষ। এখন একটু বাড়বেই। নতুন ধান আসলেই আবার দাম কমে যাবে। এখন সব চালেই দাম বাড়ছে। ব্রি-২৮ চালে বেশি বাড়ছে। প্রায় ৫ টাকা বাড়ছে। আর অন্যান্য চালে ২ টাকার মতো বাড়ছে।

মজুদদারির অভিযোগের বিষয়ে প্রশ্ন করলে বাংলাদেশ রাইস মিল মালিক সমিতির প্রচার সম্পাদক জয়নাল আবেদীন বলেন, আমাদের কুষ্টিয়ার মোকামে ব্রি-২৮ চালের প্রতি বস্তায় দাম বাড়ছে ৫০ টাকা করে। আর সব ধরনের চালেই এক টাকা করে বাড়ছে। প্রায় সব ধরনের প্রতি মণ ধানে দাম বাড়ছে ৬০ টাকার মতো। এখন ঢাকায় দাম কত বেশি নিচ্ছে সেটা তো বলতে পারব না। ঢাকায় চার টাকা এক কেজিত বাড়িয়ে ফেলবে এমন কোনো ঘটনা কুষ্টিয়ার মোকামে ঘটেনি। তারা আপনাদের কাছে যা বলে সেসব তো আমাদের সামনে বলবে না। এই মিল মালিক বলেন, এর আগে বন্যার কারণে মাঝখানে ধান বেচাকেনা কিন্তু প্রায় বন্ধ ছিল। তখন একবার প্রভাব পড়েছিল। কিন্তু এখন তো বেচাকেনা বন্ধ না। তবে মৌসুম শেষ পর্যায় তাই দাম একটু ওঠানামা করে। আগামী ২০-২৫ দিনের মধ্যে বাজার স্বাভাবিক হয়ে যাবেÑ এমন আশা দিয়ে তিনি বলেন, বাজারে স্বর্ণা, পাইজাম ও হাইব্রিডসহ মাঝারি মানের কিছু চাল আসবে আগামী মাসেই। তখন কেউ সংকট দেখাতে পারবে না।

জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ আলিম আখতার খান বলেন, আমরা সবসময় দাম কমানোর জন্য তৎপর আছি। যদি কেউ অযৌক্তিকভাবে দাম বাড়ায়, সেটা আমরা দেখব।

এদিকে চালের বাজার সহনীয় রাখতে গত রোববার আমদানি শুল্ক ও নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক হার কমানোর পাশাপাশি আগাম কর প্রত্যাহার করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআর। চালের ওপর বিদ্যমান আমদানি শুল্ক ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে করা হয়েছে ৫ শতাংশ। আর এখন যে ৫ শতাংশ আগাম কর দিতে হয়, তা-ও সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করা হয়েছে। এনবিআর বলছে, শুল্ক-কর কমানোয় চালের আমদানি ব্যয় প্রতি কেজিতে ১৪ টাকা ৪০ পয়সা কমবে।

 

ভোরের আকাশ/রন

মন্তব্য

Beta version