পার্বত্য তিন জেলার দারিদ্র্য বিমোচনে ৪৬৫ কোটি ৮২ লাখ টাকা ব্যয়ের একটি প্রকল্প প্রস্তাব করেছে প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। এ প্রকল্পের মাধ্যমে চট্টগ্রাম বিভাগের ২৬টি উপজেলার ১২৮টি ইউনিয়নের ৭২ হাজার ২৭টি পরিবারকে বিনামূল্যে গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগি, ভেড়া দেওয়া হবে। যার মাধ্যমে এসব পরিবারের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ঘটবে। রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি জেলার প্রাণিজ আমিষের উৎপাদন বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে নেওয়া প্রকল্পটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘৩টি পার্বত্য জেলায় সমন্বিত প্রাণিসম্পদ উন্নয়ন’। সরকারি অর্থায়নে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে। সম্প্রতি পরিকল্পনা কমিশনে প্রকল্পটির ওপর মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন পরিকল্পনা কমিশনের কৃষি, পানিসম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের সদস্য (সচিব) জাহাঙ্গীর আলম।
প্রকল্পের প্রস্তাবনা (ডিপিপি) সূত্রে জানা গেছে, প্রকল্পটির মূল উদ্দেশ্য হলো দেশের তিনটি পার্বত্য জেলায় (রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি) প্রাণিজ আমিষের উৎপাদন বৃদ্ধি করা। তবে প্রকল্পের সমীক্ষা প্রতিবেদনে সেই জেলাগুলোর প্রাণিজ আমিষের চাহিদা, ঘাটতি বা সরবরাহের তেমন কোনো তথ্যও পাওয়া যায়নি, যা নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে পরিকল্পনা কমিশন। প্রকল্পের তিনটি কম্পোনেন্ট (খাত) প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রথম কম্পোনেন্টটি হলোÑ পার্বত্য এলাকার জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য ৭২ হাজার ২৭টি পরিবারকে অনুদান হিসেবে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে বিভিন্ন ধরনের প্রাণীÑ যেমন- গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগি, ভেড়া বিতরণ করা হবে। সাধারণত দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ সমবায়ের মাধ্যমে ক্ষুদ্র ঋণ মডেলের আওতায় এ ধরনের কাজ করে থাকে। তবে বিনামূল্যে অনুদান হিসেবে উপকরণ সহায়তা দিয়ে টেকসই আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন কতটা ফলপ্রসূ, তার জন্য ক্ষুদ্রঋণ মডেলের সঙ্গে কোনো তুলনামূলক বিশ্লেষণ সমীক্ষা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়নি। প্রকল্পের দ্বিতীয় কম্পোনেন্ট হলোÑ রাঙামাটি জেলায় অবস্থিত পিগ ফার্ম আধুনিকীকরণ। এর জন্য ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে ৩৮ কোটি ২৭ লাখ টাকা। রাঙামাটি জেলায় অবস্থিত পিগ ফার্মটি রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের অধীন প্রতিষ্ঠান এবং রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা। তাই রাঙামাটি জেলায় অবস্থিত পিগ ফার্মটি উন্নয়নে পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আওতায় রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের মাধ্যমে করতে হবে বলে মনে করে পরিকল্পনা কমিশন। প্রস্তাবিত প্রকল্পের তৃতীয় কম্পোনেন্টটি হলোÑ বান্দরবান জেলায় একটি ইনস্টিটিউট অব লাইভস্টক সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি (আইএলএসটি) স্থাপন করা। এ আইএলএসটি স্থাপনের বিষয়ে প্রকল্পের ফিজিবিলিটি স্টাডিতে প্রস্তাব করা হলেও ফিজিবিলিটি স্টাডি রিপোর্টের ডিমান্ড অ্যানালাইসিস অংশে বাংলাদেশ লাইভ স্টক ডিপ্লোমা গ্র্যাজুয়েটদের কোনো কোনো ক্ষেত্রে কাজের সুযোগ রয়েছে সেটি নেই। এসব ক্ষেত্রে কী পরিমাণ ডিপ্লোমা গ্র্যাজুয়েটের চাহিদা রয়েছে, বর্তমানে প্রতি বছর কী পরিমাণ ডিপ্লোমা গ্র্যাজুয়েট বের হচ্ছে ইত্যাদি বিষয়ে তেমন কোনো তথ্য উল্লেখ নেই। ফলে অসম্পূর্ণ ফিজিবিলিটি স্টাডির ভিত্তিতে প্রকল্পটি তৈরি করা হয়েছে। এসব বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয় পিইসি সভায়।
প্রস্তাবিত চার বছর মেয়াদি প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য এডিপি (বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি) থেকে প্রতি বছর গড়ে প্রায় ১১৬ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রয়োজন হবে। কিন্তু মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মধ্যমেয়াদি বাজেট কাঠামো থেকে দেখা যায়, চলতি অর্থ বছরের এক হাজার ১২২ কোটি ৭৪ লাখ টাকা ও আগামী অর্থ বছরের ৬২৬ কোটি ২১ লাখ টাকার ঘাটতি রয়েছে। এ অবস্থায় এডিপিতে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের বাজেট সিলিংয়ের মধ্যে থেকে এ প্রকল্পের অর্থায়ন কীভাবে করা হবে, সে বিষয়েও কোনো পরিকল্পনা সম্ভাব্যতা সমীক্ষা প্রতিবেদনে উল্লেখ নেই বলে জানিয়েছে পরিকল্পনা কমিশন।
পিইসি সভায় উপস্থিত পরিকল্পনা কমিশনের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, সব দিক থেকেই পাহাড়ি এলাকায় প্রাণিজ আমিষের উৎপাদন বাড়ানোর প্রকল্প প্রস্তাবনাটি অসম্পূর্ণ। কীভাবে এ প্রকল্পের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য পূরণ হবে কিংবা প্রকল্পে আয়-ব্যয়ের সংস্থান কীভাবে হবেÑ সম্ভাব্যতা সমীক্ষা প্রতিবেদনে এর কিছুই উল্লেখ নেই। অনেকটা দায়সারাভাবে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে বলেই প্রতীয়মান হয়। এসব বিষয় নিয়ে পিইসি সভায় আপত্তি জানানো হয়েছে। প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় নিজস্ব কিছু ব্যাখ্যা দিয়েছে। তবে সেগুলো সন্তোষজনক মনে হয়নি। পরিকল্পনা কমিশন তাদের পর্যবেক্ষণ দিয়েছে। ওগুলো আমলে নিয়ে নতুন করে প্রস্তাব পাঠাতে বলা হয়েছে। পর্যবেক্ষণের কারণে প্রকল্পটির ব্যয় আরও কমবে।
ভোরের আকাশ/রন
মন্তব্য