বেশ কয়েকজন সাবেক সচিবের গ্রেপ্তার ঘিরে আমলাতন্ত্রে দানা বেঁধেছে আতঙ্ক। অস্বস্তি, উদ্বেগ, উৎকণ্ঠার পারদ ক্রমাগত বাড়ছে। না জানি কি হয়! আটক বা গ্রেপ্তারের আশঙ্কায় বর্তমান ও সাবেক আমলাদের কেউ কেউ আইনজীবীর সঙ্গে যোগাযোগও বাড়িয়ে দিয়েছেন।
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। বিগত সরকারের সময়ে প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তারা এরপর একের পর এক মামলায় গ্রেপ্তার হচ্ছেন। এর মধ্যে বেশির ভাগই হত্যা মামলা। অতীতে শীর্ষ পদের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে এত হত্যা মামলা কখনো হয়নি। গ্রেপ্তার হওয়া সাবেক এই আমলারা বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় বিতর্কিত ভূমিকায় ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পাঁচ মুখ্য সচিবের বিরুদ্ধেই মামলা হয়েছে। ইতোমধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছেন সাবেক তিন বাঘা মুখ্য সচিব। গ্রেপ্তার হয়েছেন বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের ‘একান্ত অনুগত’ হিসেবে পরিচিত একাধিক সচিবও। সাবেক মুখ্য সচিব তোফাজ্জল হোসেন মিয়া আত্মগোপনে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাকে খুঁজছে বলে জানা গেছে। সাবেক মুখ্য সচিব আহমেদ কায়কাউসের বিরুদ্ধেও মামলা হয়েছে। তিনি দেশের বাইরে রয়েছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার আছেন একই তালিকায়। রউফ তালুকদারকে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে আনলে হাজার হাজার কোটি টাকার ভুয়া ঋণ লোপাটের বিস্তারিত সব পাওয়া যাবে- এমন বিশ্বাস করেন অন্তর্বর্তী সরকারের নীতিনির্ধারকদের অনেকেই। সবশেষ গ্রেপ্তার হয়েছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব মোস্তফা কামাল উদ্দিন ও নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সাবেক সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ। পৃথক দুই হত্যা মামলায় সাবেক এই প্রভাবশালী দুই আমলা পুলিশের রিমান্ডে রয়েছেন। এ ছাড়া এরই মধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছেন সাবেক আইজিপি, অতিরিক্ত আইজিপিসহ প্রশাসন ও পুলিশের সাবেক একাধিক শীর্ষ কর্তা। গত ১২ অক্টোবর ভারতে পালানোর সময় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা সীমান্তে বিজিবির হাতে আটক হন জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের যুগ্ম সচিব এ কে এম জি কিবরিয়া মজুমদার। তিনি সাবেক রেলমন্ত্রী মুজিবুল হকের একান্ত সহকারীও (পিএস) ছিলেন।
সাবেক মন্ত্রী পরিষদ সচিব শফিউল আলম, খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম, কবির বিন আনোয়ার কি তালিকায় আছেন? সাবেক ও বর্তমান আমলারা একে অপরকে কাছে পেলেই এই প্রশ্ন করছেন। ২০১৪, ২০১৮ সালের অতি বিতর্কিত নির্বাচনে স্বরাষ্ট্র, আইন, নির্বাচন কমিশনের সচিব যারা ছিলেন তাদের কি কোনোভাবে গ্রেপ্তার এড়ানো সম্ভব হবে?
অভিযোগ রয়েছে, বিগত আওয়ামী লীগের শাসনামলে আমলা, পুলিশসহ বেসামরিক কর্মকর্তাদের কেউ কেউ পুরোমাত্রায় রাজনৈতিক ক্ষেত্রবিশেষ অতিমাত্রায় রাজনৈতিক আচরণ করেছেন। বিরোধী মত দমন-পীড়ন করে একতরফা নির্বাচন করে সরকার গঠন করা যায়- শেখ হাসিনার এই চিন্তার সফল বাস্তবায়নের মূল কুশীলব আমলাতন্ত্র ও পুলিশে কারা? সেই তালিকা প্রস্তুত বলেই বদ্ধমূল ধারণা প্রায় সব মহলের।
সাবেক সিনিয়র সচিব সাজ্জাদুল হাসান, আকতার হোসেন, আবু হেনা রহমাতুল মুনিম, আনোয়ার হোসেন, ফয়েজ আহমেদ, শহীদুল্লাহ খন্দকার, মুহীবুল হক, আব্দুল মালেক, কে এম আলী আজম, শহিদুজ্জামান, ইউসুফ হারুন, লোকমান হোসেন মিয়া, তপন কান্তি ঘোষ উদ্বেগে দিন পার করছেন। সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক, সাবেক গভর্নর আতিউর রহমান, ফজলে কবির, সাবেক দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদই বা কতটা স্বস্তিতে? ২০১৮ সালের রাতের ভোটের আইজিপি জাভেদ পাটোয়ারী এখন কোথায়? সাবেক সচিব জিল্লার রহমান, ফরিদউদ্দীন চৌধুরী কোথায়? সাবেক আইজিপি হাসান মাহমুদ খন্দকার? সাবেক-বর্তমান কর্মকর্তাদের অনেকেই তাদের খুঁজছেন।
কিংবা যেসব কর্মকর্তা ২০২৪ সালের একতরফা সংসদ নির্বাচন পরিচালনায় তেজগাঁওয়ে ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগ অফিসে বসেছিলেন? তারা কারা? তাদের তালিকায় সালমান রহমান, গ্রেপ্তারকৃত সাবেক মুখ্যসচিব আবুল কালাম আজাদ, কামাল আবদুল নাসের চৌধুরীর কাছেই তো আছে। তারা কি একতরফা, বিতর্কিত, কারচুপির ও ভোট ডাকাতির নির্বাচনের দায় এড়াতে পারবেন?
সাবেক প্রভাবশালী কর্মকর্তারা তাদের কৃতকর্ম নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন বলেই জানিয়েছেন সাবেক-বর্তমান আমলাদের অনেকেই। যে আমলাতন্ত্র এতদিন শুধু রাজনীতিকদের ঘাড়ে বন্দুক রেখে ফায়ার করতেন তাদের একাংশও এখন আইনের আওতায় আসছেন।
সচেতন মহল বলছেন, এসব দেখে বর্তমান আমলারা নিশ্চয়ই ইতিবাচক শিক্ষা নেবেন। নিশ্চয়ই গড়ে উঠবে বৈষম্যহীন এক জনপ্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসন ব্যবস্থা। এমনটা কি আমরা আশা করতে পারি? তবে বিগত হাসিনা সরকারের আমলে বিভাগীয় কমিশনার, ডিআইজি, ডিসি-এসপিসহ যারা স্পর্শকাতর সরকারি পদে ছিলেন তাদের কপালের ভাঁজ বাড়ছে।
ভোরের আকাশ/রন
মন্তব্য