সারাদেশে গ্যাসের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে গ্রাহকদের। আবাসিকে সরবরাহ কিছুটা বাড়লেও চাপ অনেক কম। খোদ রাজধানীর অনেক জায়গায় চুলা জ¦লছে না। অন্যদিকে বেশির ভাগ সময় শিল্প-কারখানাগুলোতে বন্ধ রাখতে হচ্ছে উৎপাদন। গুণতে হচ্ছে লোকসান। এমন পরিস্থিতি দীর্ঘস্থায়ী হলে কারখানা বন্ধ করে দেওয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না বলছেন ব্যবসায়ীরা। তাদের একটাই প্রশ্ন- এই সংকট কাটবে কবে? তবে পেট্রোবাংলা বলছে, সংকট কাটাতে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। দ্রুত সংকট কেটে যাবে।
জানা গেছে, দেশে গ্যাসের চাহিদা প্রায় ৩ হাজার ৮৮৩ এমএমসিএফটি। সরবরাহ রয়েছে গত বুধবারের হিসেব অনুযায়ী ২ হাজার ৮৬৪ এমএমসিএফটি। সেই হিসাবে দিনে গ্যাসের ঘাটতি প্রায় ১০০০ এমএমসিএফটি। গ্যাস স্বল্পতায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত খাত হচ্ছে শিল্প। চাহিদার চেয়ে ৩০ শতাংশ কম গ্যাস পাচ্ছে শিল্প-কারখানা। এতে ব্যাহত হচ্ছে উৎপাদন। অনেক কারখানা বন্ধের পথে। বাধ্য হয়ে শ্রমিক ছাঁটাই করছেন মালিকরা। গ্যাস সংকটের দ্রুত সমাধান না হলে অর্থনীতিতে অশনিসংকেত দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। ব্যবসায়ীরা জানান, ভোগান্তি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, কারখানা চালু রাখার চেয়ে বন্ধ রাখলেই লাভ। গ্যাস না থাকলেও শ্রমিকদের বসিয়ে বসিয়ে বেতন দিতে হচ্ছে; কারখানা বন্ধ রাখলে অন্যান্য আনুষাঙ্গিক খরচ অন্তত বেঁচে যায়। এ দিকে গ্যাস সংকটের কারণে সিএনজি স্টেশনগুলোতে দীর্ঘ সময় লাইনে থেকে গ্যাস সংগ্রহ করতে হচ্ছে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের মতে, শিগগিরই গ্যাস সংকট দূর হবে না। বিগত দিনগুলোতে দেশীয় গ্যাসের অনুসন্ধানের চেয়ে আমদানিতেই সরকারের ঝোঁক বেশি ছিল। সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও দীর্ঘদিন ধরে গ্যাস অনুসন্ধানে চরম অবহেলা করা হয়েছে। এতে গ্যাসের উৎপাদন কমেছে। অন্যদিকে চাহিদা দিন দিন বেড়েছে। ফলে সংকট ঘনীভূত হয়েছে। উচ্চমূল্যের কারণে পর্যাপ্ত এলএনজি আমদানি করা সম্ভব হচ্ছে না।
বর্তমানে দেশে গ্যাসের চাহিদা রয়েছে দিনে প্রায় ৩ হাজার ৮৮৩ এমএমসিএফটি। বিপরীতে এলএনজিসহ গড়ে সরবরাহ করা হচ্ছে মাত্র ২ হাজার ৮৬৪ এমএমসিএফটি (বুধবারের হিসেব)। এর মধ্যে আমদানি করা গ্যাস (এলএনজি) ৯০৩ এমএমসিএফটি। বিদ্যুতে দেওয়া হয়েছে ৯১৬ এমএমসিএফটি; শিল্পে ১২০০ এমএমসিএফটি; সার কারখানায় ২০১ এমএমসিএফটি; ফিলিং স্টেশনে ১২০ এমএমসিএফটি; আবাসিকে ২৭৫ এমএমসিএফটি এবং চা শিল্পে ১ এমএমসিএফটি দেওয়া হয়। তবে পেট্রোবাংলার একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এই প্রতিবেদককে জানিয়েছেন; বর্তমান সরবরাহের সাথে আর ৫০০ এমএমসিএফটি গ্যাস যোগ করা গেলে সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।
জানা গেছে, শিল্পের মধ্যে গ্যাসের ব্যবহার বস্ত্র খাতেই বেশি হয়ে থাকে। বস্ত্রকলে স্টিম বা বাষ্প তৈরিতে কাঁচামাল হিসেবে গ্যাস ব্যবহার করা হয়। এই খাতে দুই বছর ধরেই গ্যাস সংকট চলছে। তবে নতুন করে গ্যাস সংকট উৎপাদন কাঠামোকে এলোমেলো করে দিয়েছে। উদ্যোক্তারা জানান, বর্তমানে বস্ত্রকলগুলোর উৎপাদন সক্ষমতার তুলনায় ৬৫ শতাংশ কম। দিনে গ্যাসের চাপ থাকছে না। গ্যাসের চাপ যেখানে ১৫ পিএসআই (পাউন্ড পার স্কয়ার ইঞ্চি) থাকার কথা, সেখানে পাওয়া যাচ্ছে ১ থেকে ২ পিএসআই। এত কম চাপের কারণে জেনারেটর চালু হয় না। এ কারণে উৎপাদন বন্ধ অনেক বস্ত্রকলে। বস্ত্রকলগুলোতে সাধারণত গ্যাসের ৭৫ শতাংশ ব্যবহার বাষ্প তৈরিতে; বাকি ২৫ শতাংশ ব্যবহৃত হয় বিদ্যুৎ উৎপাদনে।
টেক্সটাইল মিল অ্যাসোসিয়েশন সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল বলেন, গ্যাসের সংকটের কারণে কর্মসংস্থান ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এলএনজি সরবরাহ কমে যাওয়ায় গ্যাস সংকট চলছে। তিনি বলেন, আমরা (শিল্প) প্রতি কিউবিক মিটার গ্যাসের জন্য বিল দিচ্ছি ৩০ টাকা। এখন উৎপাদন না করেই বিল দিতে হচ্ছে। আমরা জানতে পেরেছি নভেম্বর থেকে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি কেনা হবে। তিনি বলেন, আমরা যেহেতু নগদ টাকা বিল দিচ্ছি তাহলে আমাদেরকে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহের ব্যবস্থা করা হোক।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতি তিনটা কূপ খনন করলে একটাতে গ্যাস পাওয়া যায়। কিন্তু বিগত সরকার কূপ খননের দিকে খেয়াল না দিয়ে আমদানির দিকে বেশি নজর দিয়েছে। আবার আমাদের গ্যাসের সমস্যা রয়েই গেছে। প্রতিবছর গ্যাসের চাহিদাও বাড়ছে। সরকার এখন সংকটে পড়ে গ্যাস উত্তোলন বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু সেটা করতেও সময় লাগবে। আবার স্পট মার্কেটে এলএনজির এখন আকাশছোঁয়া দাম, আমদানি সম্ভব হবে না। কাজেই লোডশেডিং থেকে শিগগির মুক্তি মিলছে না। তারা বলছেন, বিগত সরকার ভেবেছে, যেহেতু বিশ^বাজারে গ্যাসের দাম কম, আমাদের নিজস্ব টাকা খরচ করে গ্যাস অনুসন্ধানের ঝুঁকি নেব কেন? গ্যাস আমদানি করে আনব, বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে দিয়ে দেব, যা দাম হবে, জনগণ দিয়ে দেবে। কিন্তু স্পট মার্কেটে গ্যাসের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে।
জ¦ালানি সংশ্লিষ্ট অনেকের মতে, ছোট-খাটো গ্যাসক্ষেত্রের জন্য যা টাকা খরচ হয়, তাতে পোষায় না। আমাদের চাহিদার অনুপাতে সম্প্রতি আবিষ্কৃত গ্যাস ক্ষেত্রগুলোতে যে পরিমাণ গ্যাসের মজুদ পাওয়া গেছে তা উল্লেখ করার মতো না। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমাদের মাটির নিচে, সমুদ্রের নিচে প্রচুর গ্যাস আছে, সেটাও মনে হয় না। কিন্তু যতটা আছে, সেটা যদি ঠিকঠাক অনুসন্ধান ও আহরণ করা হতো, তাহলে আজকের এ সংকটে পড়তে হতো না।
এ বিষয়ে পেট্রোবাংলার উৎপাদন ও বিপণন বিভাগের মহাব্যবস্থাপক মো. ইমাম উদ্দিন শেখ দৈনিক ভোরের আকাশকে জানান, বিগত সরকার গ্যাস ক্ষেত্র খুজতে মানসিকভাবে তৈরি ছিল না।
বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক ও জ¦ালানি বিশেষজ্ঞ ড. এজাজ বলেন, গ্যাসের সংকট চলছে। অথচ এখনও সাপ্লাই বাড়ানোর কোনো প্রচেষ্টা নাই। প্রাইয়োটাইজেশন নাই। প্রায় ৩ বছর ধরে চলমান রেশনিং সিস্টেমও ঠিক ভাবে হচ্ছে না। সরকারকে অবিলম্বে এটাকে প্রাইওরিটির ভিত্তিতে করতে হবে। তিনি বলেন, এলএনজি আমদানি করার জন্য সরকার ঘোষণা দিচ্ছে; এটা পত্রিকায় নিউজ হচ্ছে; কিন্তু সরকারের উচিত কাউকে কিছু না বলে প্রয়োজন মতো এলএনজি আমদানি করে চাহিদা মেটানো : কারণ গ্রাহক বিল পরিশোধ করছে।
একদিকে টাকার জন্য সরকার এলএনজি আমদানি করতে পারছে না। অপরদিকে পেট্রোবাংলা বলছে গ্যাস বিল বকেয়া রয়েছে ৩০ হাজার কোটি টাকা। দেশে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে গত আগস্ট পর্যন্ত গ্যাসের বকেয়া বিল দাঁড়িয়েছে ৩০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর কাছে পাওনা ১৯ হাজার কোটি টাকার বেশি। সরকারি সার কারখানায় গ্যাস বিল পাওনা ২ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বকেয়া বিল আদায় করতে লাইন বন্ধ করে দিতে পারে সরকার। আইনের প্রয়োগ না করলে সংকট থেকে বের হওয়া কঠিন হবে বলেও জানান তারা।
গ্যাস সংকট সম্পর্কে তিতাস গ্যাসের পরিচালক অপারেশন প্রকৌশলী মোহাম্মদ সাইদুল হাসান ভোরের আকাশকে বলেন, গত মাস তিনেক হলো গ্যাস সংকট প্রকট হয়েছে। অনেক পুরোনো পাইপ লাইনের কারণেও অনেক এলাকায় গ্যাসের চাপ কম থাকে। চাহিদার দিকে খেয়াল রেখে ঢাকা এবং নারায়ণগঞ্জ শহরের পাইপলাইন নতুন করে বসানোর প্রস্তাব সরকারের কাছে দেওয়া হয়েছে অনেক আগে। কিন্তু এখনও সেই প্রস্তাব অনুমোদন হয়নি।
সংশ্লিষ্টরা বলেন, এখনও গ্যাস চুরির পরিমাণ কমানো যায়নি। অনিয়ম দুর্নীতিতে নিমজ্জিত ১৫ বছরে তৈরি হওয়া গহবর থেকে সহজে বের হওয়া যাবে না। বর্তমানে লাইন থেকে প্রায় ১০ শতাংশ গ্যাস উধাও হয়ে যায় ৪%-৫% গ্যাস লিকেজে গেলেও বাকিটা থাকতো যদি সঠিক মনিটরিং থাকতো। তারা বলেন, আবাসিক লাইনগুলো একেবারে বন্ধ না করে অল্প অল্প করে বাড়ালেও এত চুরি হতো না।
বাংলাদেশ তেল, গ্যাস, খনিজসম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা) বলছে, দীর্ঘদিন ধরে গ্যাস খাত চলছে রেশনিং (এক খাতে সরবরাহ কমিয়ে অন্য খাতে দেওয়া) করে। দেশীয় গ্যাসক্ষেত্র থেকে উৎপাদন বাড়ানো যাচ্ছে না। কয়েক মাস ধরে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) সরবরাহ ছিল সক্ষমতার অনেক কম। যদিও এখন একটু বেড়েছে কিন্তু এলএনজি সরবরাহ না বাড়ালে শিগগিরই কাটছে না চলমান গ্যাস-সংকট। এদিকে গ্যাস সংকটের আরেকটি কারণ অবৈধ গ্যাস সংযোগ। পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার বলেন, অবৈধ গ্যাস সংযোগ চিহ্নিত করতে না পারলে সিস্টেম লস থেকে বের হওয়া যাবে না। তিনি জানান, বর্তমানে ৫৫টি টিম সপ্তাহে তিন দিন অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করছে।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান বলেছেন, শেখ হাসিনার আমলে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে অপরিকল্পিত উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এসবের বেশির ভাগ ক্ষেত্রে যৌক্তিক মূল্যের চেয়ে অনেক বেশি খরচে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। তিনি বলেন, গ্যাসের সংকট বিষয়টি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সমাধানের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। পাশাপাশি গ্যাসের সরবরাহ বৃদ্ধির জন্য বর্তমান সরকারের পক্ষ থেকে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
ভোরের আকাশ/মি
মন্তব্য