-->

কীটনাশকে গলাকাটা ব্যবসা

ভোরের আকাশ প্রতিবেদক
কীটনাশকে গলাকাটা ব্যবসা

কৃষকের ফসল সুরক্ষার কাজে ব্যবহৃত প্রয়োজনীয় উপকরণ পেস্টিসাইড (বালাইনাশক) এখন সিন্ডিকেটের খপ্পরে। পেস্টিসাইড ব্যবসায়ী নেতাদের একটি অংশ এই পণ্যের দাম বাড়িয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে, জিম্মি করছে অসহায় কৃষকদের। তারা পেস্টিসাইডসংশ্লিষ্ট কমিটির সদস্য হয়ে নিজেদের স্বার্থ হাসিলে কৃষকের স্বার্থবিরোধী নীতি তৈরি করিয়ে নিচ্ছে। তারপরও ওই নীতি পুরোপুরি মানছে না। রাজস্ব কর্মকর্তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে পণ্য আমদানি করছে। এতে নিম্নমানের পণ্যের পাশাপাশি রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার।

জানা গেছে, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাধ্যমে ৭৫০টির মতো বেসরকারি পেস্টিসাইড কোম্পানিকে আমদানির জন্য প্রায় ১২ হাজার ব্র্যান্ড অনুমোদন দিয়েছে। অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে এই রাসায়নিক উপাদানের বাজার প্রায় ছয় হাজার ৫০০ কোটি টাকার। এই চাহিদার ৯০ শতাংশই আমদানিনির্ভর এবং বাকি ১০ শতাংশ কাঁচামাল আমদানির মাধ্যমে বাংলাদেশে উৎপাদন করা হয়। পণ্যটি আমদানিনির্ভর হওয়ায় কৃষকদের জিম্মি করার সুযোগও বেশি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ‘মানিক ২০ এসপি’ বালাইনাশকটি ধানের বাদামি গাছ ফড়িং, সবজির ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকা, জাব পোকা, সাদা মাছি ও বিভিন্ন ধরনের শোষক পোকা দমনের কাজে ব্যবহার করা হয়। বিদেশ থেকে প্রতি কেজি এই পণ্য কেনা হচ্ছে বাংলাদেশি মুদ্রায় ৬৯৬ টাকায়। কিন্তু কৃষকের কাছে এই বালাইনাশক বিক্রি করা হচ্ছে তিন হাজার ২৪০ টাকায়।

পেস্টিসাইড ব্যবসায়ী মিলন রহমান জানান, বিদেশ থেকে কেনার পর আমদানি ব্যয়, পরিবহন, প্যাকিং খরচ, অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন, বাজারজাত-সব মিলিয়ে প্রতিটি পণ্যে সর্বোচ্চ ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ খরচ হয়। সে হিসাবে ৬৯৬ টাকার পণ্যে সর্বোচ্চ ২৪৪ টাকা পর্যন্ত বাড়তি ব্যয় হতে পারে। এর সঙ্গে ১২ শতাংশ লাভ হিসাবে যোগ হতে পারে আরো ১১২ টাকা। পণ্যটি কৃষকের কাছে এক হাজার ৫২ টাকায় বিক্রি করা উচিত, কিন্তু বিক্রি করা হচ্ছে তিন হাজার ২৪০ টাকায়। অন্য একটি বালাইনাশকের রাসায়নিক নাম কারটাপ। এক হাজার ২০ টাকায় কিনে বিক্রি করা হচ্ছে তিন হাজার ৪০০ টাকায়। ‘ম্যানকোজেব মেটাল এক্সিল’ প্রতি কেজি ৪৩৮ টাকায় কিনে বিক্রি করা হচ্ছে দুই হাজার ১০ টাকায়। ব্যবসায়ীদের একটি অংশ এভাবেই বেশি লাভে (২৫০ থেকে ৩০০ শতাংশ) বিক্রি করে কৃষকদের ঠকিয়ে আসছে। বেশি মূল্যে কীটনাশক বিক্রি করায় কৃষিপণ্যের উৎপাদন খরচও বাড়ছে।

পেস্টিসাইড আমদানিকারকদের বাণিজ্য সংগঠনের নাম বাংলাদেশ ক্রপ প্রটেকশন অ্যাসোসিয়েশন। সংগঠনটির শীর্ষ পদের ক্ষমতা অপব্যবহার করে পেস্টিসাইড ব্যবসায়ীরা একটি সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। বলা হচ্ছে, এই সিন্ডিকেট ২৫০ থেকে ৩০০ শতাংশ মুনাফা তুলে নিচ্ছে অসহায় কৃষকদের কাছ থেকে। ‘মানিক ২০’-এর আমদানিকারক মিমপেক্স অ্যাগ্রোকেমিক্যালস লিমিটেড। কোম্পানিটির কর্ণধার এম সাইদুজ্জামান একই সঙ্গে বাংলাদেশ ক্রপ প্রটেকশন অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতিও। অভিযোগ সম্পর্কে তিনি বলেন, একটি গ্রুপ আমার ব্যবসায় ঈর্ষান্বিত হয়ে আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে।

পেস্টিসাইড টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজারি কমিটি (পিটাক) পেস্টিসাইডসংশ্লিষ্ট সব নীতি নির্ধারণ করে থাকে। পিটাকের সভাপতি কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের নির্বাহী চেয়ারম্যান। সদস্য সচিব হিসেবে থাকেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইংয়ের পরিচালক। কমিটিতে সদস্য হিসেবে বাংলাদেশ ক্রপ প্রটেকশন অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকও থাকেন। এই তিনটি সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তাদের নিয়েই সিন্ডিকেট। পিটাক যেহেতু পেস্টিসাইড রেজিস্ট্রেশন অনুমোদন দেওয়ার পাশাপাশি সব কিছুই নিয়ন্ত্রণ করে থাকে, তাই এই তিন সংস্থার সিন্ডিকেটের কারণেই কৃষকরা ঠকছেন বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করেন।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের এক সভায় সরকারি এক কর্মকর্তা একই পেস্টিসাইডের ক্ষেত্রে বিভিন্ন কোম্পানির দামের ব্যাপক পার্থক্য হওয়ায় দাম নির্ধারণ করে দেওয়ার প্রস্তাব রাখেন। কিন্তু এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন বাংলাদেশ ক্রপ প্রটেকশন অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এম সাইদুজ্জামান। তিনি ছয় বছর ধরে এই অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তবে তিনি তার বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, অন্য কোম্পানির পণ্যগুলোর সঙ্গে মিল রেখে আমাদের মূল্য নির্ধারণ করতে হয়। তবে পণ্যের গায়ে যে মূল্য লেখা থাকে তার চেয়ে অনেক কম মূল্যে আমরা পণ্য বিক্রি করে থাকি। যেভাবে মুনাফার তথ্য দেওয়া হয়েছে ততটা মুনাফা হয় না।

এই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে গত সপ্তাহে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন করে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ সোসাইটি। মানববন্ধনে এম সাইদুজ্জামানসহ সিন্ডিকেটে জড়িতদের বিচারের দাবি জানানো হয়। মানববন্ধনে অংশ নেওয়া বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ফোরামের সভাপতি অধ্যাপক ড. ইউসুফ মিয়া বলেন, বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষের প্রধান পেশা কৃষি। কিন্তু কৃষকের কাছে আমদানি করা নিম্নমানের বালাইনাশক ও অনিয়মতান্ত্রিকভাবে উচ্চ মূল্যে বিক্রির কারণে তারা পথে বসছেন এবং আমাদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে। নিম্নমানের বালাইনাশক আমদানির কারণে কৃষক তথা সর্বস্তরের জনগোষ্ঠী সমহারে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আমরা নিম্নমানের বালাইনাশক আমদানি রোধে সরকারের কঠোর পদক্ষেপ প্রত্যাশা করছি। ওই কর্মসূচিতে সংগঠনটির সহসভাপতি মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন, পেস্টিসাইড ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

জানা যায়, কৃষকদের জিম্মি করার কৌশলের শুরু আমদানির প্রক্রিয়া থেকেই। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের দেওয়া তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ৬৮তম পিটাক সভায় বিভিন্ন কোম্পানি রেজিস্টার্ড পেস্টিসাইডের শুধু ল্যাবরেটরি পরীক্ষার মাধ্যমে উৎস (উৎপাদনকারী দেশ ও কোম্পানির নাম) পরিবর্তন করে আমদানির অনুমতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই সিদ্ধান্তের পর ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট নিজেদের মতো উৎস পরিবর্তন করে নেন। এর পরেই উৎস নির্দিষ্ট করার উদ্যোগ নেয় সিন্ডিকেট। ৭৭তম পিটাক সভায় উৎস নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়। সভায় সিদ্ধান্ত হয়, রেজিস্টার্ড পেস্টিসাইডের উৎস পরিবর্তনের ক্ষেত্রে রেজিস্ট্রেশনপ্রাপ্তির প্রথম দুই বছর উৎস পরিবর্তন করা যাবে না। একই সঙ্গে দুই বছর পর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ল্যাবরেটরি টেস্টের পাশাপাশি মাঠ পর্যায়ের পরীক্ষারও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই সিদ্ধান্তের তিন বছর পর অনুষ্ঠিত ৮৪তম পিটাক সভায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিসহ অন্য সদস্যদের আপত্তি উপেক্ষা করে একক উৎস নীতি অনুমোদন করায় উৎস উন্মুক্তকরণের পথ সরাসরি রুদ্ধ করে দেওয়া হয়। বলা হয়, উৎস উন্মুক্ত করা যাবে না। অথচ যে ব্যবসায়ী নেতাদের প্রস্তাবে এই নীতি নির্ধারণ করা হয়, তারাও এটি মানেননি।

বালাইনাশক শিল্পের আমদানি তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, আনুমানিক ৭৫০টি দেশীয় কোম্পানির মধ্যে একটি সিন্ডিকেট রেজিস্টার্ড সোর্সের বাইরে অনুমোদনহীন কোম্পানি থেকে বছরের পর বছর পণ্য আমদানি করে আসছে। অথচ সরকারকে নির্ধারিত ২৩ হাজার টাকা প্রতিটি চালানে জমা দিয়ে বালাইনাশক নীতিমালা অনুযায়ী উৎস পরিবর্তনের সুযোগ রয়েছে। এই পরিবর্তনের ক্ষেত্রে মাঠে বালাইনাশকের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হয়।

অভিযোগ রয়েছে, ওই সিন্ডিকেট এই নিয়মনীতিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে অবৈধ উৎস থেকে পেস্টিসাইড আমদানি করে প্রান্তিক কৃষক পর্যায়ে সরবরাহ করছে। এতে একদিকে যেমন সরকার একটি বড় অঙ্কের রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, সেই সঙ্গে এই নিম্নমানের বালাইনাশক ব্যবহার করে কৃষক আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

চলতি বছরের জুলাই মাসে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের নজরদারি জোরদারের ফলে চট্টগ্রাম পোর্ট থেকে অনুমোদনহীন উৎস থেকে আমদানি করা প্রায় এক হাজার কোটি টাকার বালাইনাশক আটক করা হয়। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তৎকালীন উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইংয়ের পরিচালক ও পিটাকের সদস্য সচিব আশরাফ উদ্দিনের মধ্যস্থতায় অবৈধভাবে এসব পণ্য ছাড় করা হয়। তিনি একটি সরকারি চিঠিতে কৃষি উৎপাদন ও সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন রাখার অজুহাত দেখান। কিন্তু এই বালাইনাশক কোনো ধরনের মাঠ পরীক্ষা ছাড়া কৃষকদের কাছে বিক্রি করলে কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্তও হতে পারেন—এই বিষয়টি তিনি এড়িয়ে যান। এ বিষয়ে আশরাফ উদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।

শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. জসীম উদ্দিন বলেন, কোনো রাসায়নিক দ্রব্য অবৈধ হলে সেগুলো বাজেয়াপ্ত এবং ধ্বংস করে ফেলতে হয়। অবৈধ উৎস থেকে আমদানি করা এসব পণ্য কখনো এতই নিম্নমানের হয় যে নির্দিষ্ট পরিমাণ কার্যকর উপাদান প্রায় শূন্য থাকে। এসব পেস্টিসাইডের রাসায়নিক পরীক্ষা এবং ফসলসংশ্লিষ্ট গবেষণাপ্রতিষ্ঠান থেকে মাঠ পরীক্ষারও সুযোগ থাকে না।

এই অভিযোগ সম্পর্কে এম সাইদুজ্জামান বলেন, আইন অনুযায়ী নির্ধারিত উৎসের বাইরে পেস্টিসাইড আমদানি করা ঠিক নয়। তবে খাদ্য নিরাপত্তার স্বার্থেই এমনটি করা হয়েছে। এ ছাড়া অনেক বালাইনাশকের নিবন্ধিত উৎস কোম্পানি তাদের বালাইনাশক ব্যবসা বন্ধ করার কারণে বাধ্য হয়ে উৎস পরিবর্তন করতে হয়েছে। তবে তার এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত নন অন্য ব্যবসায়ীরা।

 

ভোরের আকাশ/রন

মন্তব্য

Beta version