আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে চলছে রদবদল। অনেকে চাকরি হারিয়েছেন। তারই ধারাবাহিকতা চলছে পুলিশেও। গত ১৫ দিনে পুলিশের প্রশিক্ষণরত এসআই পদমর্যাদার ৩১০ কর্মকর্তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে তাদের চাকরিচ্যুত করা হয়। অব্যাহতির জন্য শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণ দেখানো হলেও এর মূলে আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে তাদের সংশ্লিষ্টতাই মূল কারণ বলে মনে করছেন অব্যাহতি প্রাপ্তরা। কেননা, ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর বিএনপিসহ কয়েকটি দল প্রশিক্ষণরত পুলিশ কর্মকর্তাদের অব্যাহতির দাবি জানিয়ে আসছিল। ফলে প্রশিক্ষণরত পুলিশ কর্মকর্তাদের মধ্যে অব্যাহতি আতঙ্ক বিরাজ করছে।
অনেকেই বলছেন, আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকার কারণে তাদের বহিষ্কার করা হয়েছে। তবে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা দাবি করছেন, শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে তাদের চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। অপরাধ বিশ্লেষকরা বলেন, রাজনৈতিক পরিচয়ে কাউকে অব্যাহতি দেওয়া কাম্য নয়। কারণ সবারই রাজনৈতিক মতাদর্শ আছে। তাই এ অভিযোগে চাকরি থেকে অব্যাহতি খুবই খারাপ দৃষ্টান্ত। তারা পুলিশে নিয়োগের ক্ষেত্রে আরো সতর্কতা অবলম্বন করার অনুরোধ জানান।
গতকাল সোমবার রাজশাহীর সারদা পুলিশ একাডেমিতে প্রশিক্ষণরত ৫৮ জন উপ-পরিদর্শক (এসআই) ক্যাডেটকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। পুলিশ সদরদপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) ইনামুল হক সাগর এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, সারদা পুলিশ একাডেমিতে চূড়ান্তভাবে নিয়োগের জন্য সুপারিশপ্রাপ্ত ও প্রশিক্ষণরত আরও ৫৮ জন উপ-পরিদর্শক (এসআই) ক্যাডেটকে শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। গত মাসে প্রশিক্ষণরত ৫৯ জন উপ-পরিদর্শককে (এসআই) শোকজ করা হয়। প্রশিক্ষণ ক্লাসে এলোমেলোভাবে বসে হৈ চৈ করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির কারণে তাদেরকে নোটিশ দেওয়া হয়। এর মধ্যে ৫৮ জনকে অব্যাহতি দেওয়া হলো।
পুলিশের একটি সূত্র জানায়, ২০২৩ সালের ৪০তম ব্যাচের শিক্ষানবিশ এসআইদের মধ্যে ৮২৩ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। ওই ব্যাচের ৯৩ জন অমুসলিমসহ ২৫২ জনকে গত ২১ অক্টোবর অব্যাহতি দেওয়া হয়। আর ৫৯ জনকে শোকজ করা হয়। গতকাল সোমবার তাদের ৫৮ জনকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
এর আগে গত ২০ অক্টোবর চারঘাট পুলিশ একাডেমিতে ৬২ জন সহকারী পুলিশ সুপারের প্রশিক্ষণ সমাপনী কুচকাওয়াজ স্থগিত করা হয়েছিল। অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা এ জন্য রাজশাহীতেও এসেছিলেন। তখন তিনি সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, অনিবার্য কারণে এই কুচকাওয়াজ স্থগিত করা হয়েছে। তবে সেই ৬২ জনের শেষ পরিণতি এখনো জানা যায়নি।
এসআইরা ছাত্রজীবনে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকার কারণে তাদের অব্যাহতি দেওয়া হলো কিনা জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, একাডেমি তাদের শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণে বের করে দিয়েছে। এর চেয়ে আরও বেশি সংখ্যায় বের করা হয়। পুরো ব্যাচ ধরে কখনো বের করে দেওয়া হয়। বিজিবিতে একবার পুরো ব্যাচ ধরে বের করে দেওয়া হয়। এ রকম হতে পারে। ডিসিপ্লিন শব্দটা তো বিরাট বড়। এখানে কোনো রাজনৈতিক কারণ নেই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক বলেন, শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে পুলিশের যে কোনো সদস্যকে চাকরিচ্যুতির বিধান রয়েছে। তবে লঘু পাপে গুরুদণ্ড দেওয়া খুব একটা সুখকর নয়। পুলিশে নিয়োগের আগে ভালোভাবে যাচাই-বাছাই করা উচিত। সবারই রাজনৈতিক মতাদর্শ আছে। তবে সেটা পেশাগত জায়গায় প্রয়োগ না করলেই হলো। রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে কারো চাকরিচ্যুতি খুবই খারাপ দৃষ্টান্ত।
সাবেক আইজিপি মোহাম্মদ নুরুল হুদা বলেন, পুলিশ অপরাধ করলে সেটা প্রথমে নিজ বাহিনীতে বিচার হয়। শাস্তির ব্যবস্থাটা ভালো। যেকোনো অপরাধের শাস্তি হলে শৃঙ্খলা থাকে। তবে বর্তমান সময়ে পুলিশের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ বাড়ছে, এসব বিষয়ে পুলিশের ওপর মহলের নজর বাড়ানো উচিত।
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, গত দেড় দশকে পুলিশে নতুন পদ সৃষ্টি হয়েছে ৮৩ হাজার। আর নিয়োগ হয়েছে ১ লাখ ২০ হাজারের মতো। নিয়োগ পাওয়াদের মধ্যে উপ-পরিদর্শক (এসআই) ও কনস্টেবল বেশি। অভিযোগ রয়েছে, পুলিশের এ নিয়োগের বড় অংশই ছিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে। সদ্য ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে তাদের ব্যবহার করা হয়েছে মূলত ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার হাতিয়ার হিসেবে।
নাম প্রকাশ না করে পুলিশ সদর দপ্তরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, বিভিন্ন সময়ে অভিযোগ উঠেছে, দলীয় বিবেচনায় পুলিশে ব্যাপক নিয়োগ হয়েছে। পদোন্নতি ও ভালো জায়গায় পদায়নে তদবির হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী-এমপি ও নেতাদের পাশাপাশি তালিকা করে স্বরাষ্ট্র সচিবও পুলিশপ্রধান ও জেলার এসপিদের কাছে তদবির করেছেন। তাদের চিহ্নিত করা হবে। ছাত্রজীবনে যারা ছাত্রলীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন, তাদের তালিকাও তৈরি করা হচ্ছে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে তারাই বেশি বেপরোয়া ছিল।
ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, পুলিশ সংস্কারের কাজ শুরু হয়েছে। পুলিশ সদর দপ্তরসহ সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো আন্দোলনে অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের ক্ষেত্রে যারা জড়িত ছিল তাদের বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়া প্রায় শেষ করে এনেছে। প্রাথমিকভাবে ওইসব কর্মকর্তাকে চিহ্নিত করে তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ও শেখ হাসিনার দেশত্যাগের পর পুলিশ সদর দপ্তরের পিআইএমএস (কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত তথ্যভাণ্ডার) হ্যাক হয়েছিল। সেখানে কর্মকর্তাদের বাসা-বাড়ির ঠিকানা ও ব্যক্তিগত তথ্য ছিল। প্রথমে এসব তথ্য না পেলেও মাসখানেক আগে তা পাওয়া যায়। এরই মধ্যে শতাধিক কর্মকর্তার কর্মকাণ্ড নজরদারি করা হচ্ছে।
পুলিশের ঊর্ধ্বতন আরেকজন কর্মকর্তা বলেন, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে দেশ-বিদেশে আলোচনা এখনো চলছে। তারা রাজনৈতিক বলয় থেকে বের হতে নানাভাবে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে। সব রাজনৈতিক দল পুলিশ বাহিনীকে ব্যবহার করে ফায়দা নেয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, এবার সময় এসেছে ‘একটু ঘুরে দাঁড়াতে’। অন্তর্বর্তী সরকার চেষ্টা করছে পুলিশ বাহিনী সংস্কার করতে। সংস্কার করতেই হবে। আইজিপি থেকে শুরু করে কনস্টেবল পর্যন্ত সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে। রাজনৈতিক সরকার পুলিশের কোনো কাজে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। দলীয় বিবেচনায় কাউকে নিয়োগ দিতে পারবে না। তিনি জানান, সংস্কারের অংশ হিসেবে পুলিশের পোশাক ও মনোগ্রাম পরিবর্তন হবে। দ্রুত সময়ের মধ্যে তা করার চেষ্টা চলছে।
২০০৭ সালে প্রস্তাবিত আইনের গুরুত্বপূর্ণ ধারাগুলো বাতিল করার জন্য সংস্কার কমিটিকে প্রস্তুব করা হয়েছে জানিয়ে ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, পুলিশকে রাজনীতিকীকরণই আজকের এ পরিস্থিতির জন্য দায়ী।
ভোরের আকাশ/রন
মন্তব্য