-->

মামলায় পুলিশের অনীহা

এমদাদুল হক খান
মামলায় পুলিশের অনীহা

রাজধানীর মিরপুরের বাসিন্দা মোশাররফ হোসেন লিটন সম্প্রতি জাকারিয়া সায়িম নামে এক যুবকের কাছ থেকে দুটি আইফোন ১৪ প্রো ম্যাক্স কেনেন। দাম পরিশোধে দেন ব্যাংক চেক। কিন্তু চেকটি ডিজঅনার হয়। এরই মধ্যে গা-ঢাকা দেন মোশাররফ। বাধ্য হয়ে আইনি সহায়তা নিতে পল্লবী থানায় অভিযোগ নিয়ে যান জাকারিয়া। কিন্তু পুলিশ অভিযোগ নিতে অস্বীকার করে আদালতে মামলা করার পরামর্শ দেয়। বেশ কয়েক দিন ঘোরাঘুরির পর অবশেষে ওই থানায় সাধারণ ডায়েরি করতে সক্ষম হন জাকারিয়া।

শুধু এখানেই শেষ নয়, প্রতিদিনই রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় কোথাও না কোথাও ছিনতাইকারীর কবলে পড়ছেন সাধারণ মানুষ। কখনও হাঁটা পথে, কখনো বা বাসের জানালা দিয়ে কেড়ে নেওয়া হচ্ছে তাদের জিনিসপত্র। এছাড়া সাধারণ মানুষ রিকশায় যাতায়াতের সময় মোটরসাইকেল থেকে ছোঁ মেরে টাকা, মোবাইল ফোন ও জিনিসপত্রসহ ব্যাগ নিয়ে যাচ্ছে ছিনতাইকারীরা। কিন্তু পুলিশের খাতায় এসব ঘটনা নথিভুক্ত হচ্ছে জিডি হিসেবে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ৫ আগস্টের পর মামলা নিতে অনীহা প্রকাশ করছে পুলিশ। শুধু রাজনৈতিক মামলা ছাড়া অন্য কোনো মামলা নিতে চাচ্ছে না তারা। আগের চেয়ে থানায় মামলার সংখ্যা কমেছে অনেক। এছাড়া এখনো গতিও ফেরেনি পুলিশের কাজে। গত তিন মাসে মামলার তদন্ত প্রতিবেদনও দাখিল হয়নি। এদিকে, বর্তমান সরকার সংশ্লিষ্ট আসামিরা ছাড়া চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি, হত্যা, ধর্ষণ, প্রতারণা, মারামারি, জালিয়াতিসহ অন্যান্য খাতের নতুন আসামি গ্রেপ্তারের সংখ্যা শূন্যের কোটায় নেমে এসেছে। গত ৩০ অক্টোবর ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালত ও সাধারণ নিবন্ধন শাখা থেকে এসব তথ্য জানা গেছে। সাধারণত থানায় মামলা দায়েরের পরে মামলার নথি থানা থেকে জিআর শাখায় পাঠানো হয়। সেখানে আসামির রিমান্ড বা জামিন শুনানির তদারকি করা হয়।

ডিএমপির অপরাধ পরিসংখ্যানে জানা গেছে, গত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে মে, জুন ও জুলাই মাসে রাজধানীতে ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে ৮টি, ছিনতাই-দস্যুতা ৫০টি, খুন ৮৮টি, অপহরণ ১১টি, সিঁধেল চুরি ১১৭টি, বর্তমান সরকারের প্রথম তিন মাসে রাজধানীতে ডাকাতির ঘটনা ঘটে ১৪টি, ছিনতাই-দস্যুতা ৩৯টি, খুন ৩৫২টি, অপহরণ ৪৮টি, সিঁধেল চুরি ৯৬টি। এ ব্যাপারে ডিএমপির মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার ওবায়দুর রহমান বলেন, ৫ আগস্টের পর যেসব মামলা হয়েছে, এর অধিকাংশ ঘটনাই পুরনো।

সিএমএম আদালতে গিয়ে দেখা গেছে, গণঅভ্যুত্থানের পরে ২৮নং আদালতে ৬০টি মামলা, ২৭নং আদালতে ২৭৭টি, ৬নং আদালতে ২১৯টি, ৫নং আদালতে ৬৪টি, ৪নং আদালতে ১৮৩টি, ৭নং আদালতে ৩৬৯, ৮নং ১৪৯টি, ৯নং আদালতে ৬১৭টি, ১০নং আদালতে ৪০০টি, ১১নং আদালতে ১৯১টি, ১২নং আদালতে ১৬৪টি, ১৩নং আদালতে ৭৬টি, ১৪নং আদালতে ৩৫৮টি, ১৫নং আদালতে ৬০৪টি, ১৬নং আদালতে ১৪৮টি, ১৭নং আদালতে ৪১৯টি, ২০নং আদালতে ২৭৬, ২১নং আদালতে ১২১টি, ২২নং আদালতে ৬৮টি, ২৩নং আদালতে ১১৮, ২৪নং আদালতে ৩৮৪, ২৫নং আদালতে ১৯৬টি, ২৬নং আদালতে ৭০টিসহ বিভিন্ন আদালতে আরও মামলা দায়ের করা হয়েছে।

খিলগাঁও সাধারণ নিবন্ধন শাখা থেকে জানা গেছে, গত আগস্ট মাসে মাত্র দুটি মামলা হয়েছে। এ ছাড়া সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে ১০৮টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। তেজগাঁও জিআর শাখায় দেখা গেছে, তিন মাসে ২৫টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। হাতিরঝিলে ১৬টি, মিরপুর থানায় ৩৮ ও শেরেবাংলা নগর থানায় ২৫টি, কদমতলী থানায় ৯২টি, হাজারীবাগ থানায় ৩৯টি, কোতোয়ালি থানায় ১৬টি, বংশাল থানায় ১৫টি, পল্লবী থানায় ৭৫টি, কাফরুল থানায় ৩৯টি, ভাষানটেক থানায় ২০টি, বাড্ডা থানায় ২৭টিসহ অন্য বাকিসব থানায় গড়ে ৩০-৩৫টি করে মামলা দায়ের করা হয়েছে। এসব থানায় গণঅভ্যুত্থানের আগে প্রতিদিন গড়ে ৭-৮টি মামলা দায়ের করা হতো। আর মাসে তিনশতের ওপরে মামলা দায়ের হতো।

সিএমএম আদালতের সাধারণ নিবন্ধন শাখা (জিআর) শাখায় গিয়ে দেখা গেছে, বেশিরভাগ মামলা জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের সময় সহিংসতার অভিযোগে দায়ের করা। আদালতের জিআরও শাখায় এগুলো রাজনৈতিক মামলা হিসেবেই পরিচিত। এ ছাড়া গত তিন মাসে আদালতে পুরাতন মামলা বা জুলাই-আগস্টের সহিসংতার ঘটনায় কোনো মামলার চার্জশিট-চূড়ান্ত প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করা হয়নি। এমনকি, আসামি গ্রেপ্তারের সংখ্যা শূন্যতে নেমে এসেছে।

মিরপুর থানার সাধারণ নিবন্ধন কর্মকর্তা (জিআরও) উপ-পরিদর্শক জালাল হোসেন বলেন, গত তিন মাসে আদালতে মামলা দায়েরের সংখ্যা অনেক কমে গেছে; যা সংখ্যা বিবেচনায় আগের তুলনায় এক-তৃতীয়াংশ। তিনি বলেন, গণঅভ্যুত্থানের পরে ঢাকার বেশির ভাগ মামলা আদালতে দায়ের করা হয়। থানা থেকে শুধু মামলাগুলো এফআইআর হিসেবে গ্রহণ করে আদালতের জিআর শাখায় পাঠানো হয়, সেখানে নতুন মামলা নম্বর হিসেবে এন্ট্রি হয়।

জিআরও জালাল আরও বলেন, গণঅভ্যুত্থানের আগে রাজধানীতে প্রতিদিন অনেক মামলা হতো। এর মধ্যে মাদক, ছিনতাই, প্রতারণা, নারী নির্যাতন, মারামারি, হত্যাচেষ্টা, খুন, ডাকাতি, চুরিসহ বিভিন্ন ধারায় মামলা দায়ের হতো। কিন্তু বর্তমানে জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পরে শুধু সহিংসতার মামলা হচ্ছে। সাধারণ অপরাধের জড়িত মামলা কম। তিনি বলেন, তবে চলতি সপ্তাহ থেকে যৌথবাহিনীর অভিযানের পর থেকে কিছু মাদক ও ছিনতাইয়ের মামলাও হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, তিন মাসে মিরপুর থানায় ৩৮ ও শেরেবাংলা নগর থানায় ২৫টি মামলা দায়ের করা হয়েছে।

সূত্রাপুর থানার সাধারণ নিবন্ধন কর্মকর্তা (জিআরও) রণপ কুমার ভক্ত বলেন, গত তিন মাসে আদালতে মামলার সংখ্যা একবারে কমে গেছে। থানা থেকে নতুন কোনো মামলাই আসছে না। এ ছাড়া আগে প্রতিদিন আসামি গ্রেপ্তার হলেও এখন হাতে গোনা দুই একজন গ্রেপ্তার হন। জিআর শাখায় কাজ কমে গেছে বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, গণঅভ্যুত্থানের পরে থানা ভেঙে দেওয়ার কারণে মামলা কম হয়েছে। এ ছাড়া থানায় পুলিশ কর্মকর্তা না থাকার কারণেও মামলা কম হয়েছে বলে শুনেছি। আদালতে আগের মতো রিমান্ড, জামিন শুনানি বা কর্মচাঞ্চল্য নেই।

আসামি গ্রেপ্তারে পুলিশের বিরুদ্ধে অনীহার অভিযোগ উঠেছে। নামপ্রকাশের অনিচ্ছুক পুলিশ সূত্র বলছে, এখনও তারা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। যদিও সেনাবাহিনীকে তাদের সহযোগিতা করতে বলা হয়েছে। তারপরও তারা টহলে যেতে ততোটা নির্ভার হচ্ছেন না। নির্ধারিত পোশাক পরা দেখলে এখনও মানুষ তাদের দিকে অন্যভাবে তাকায়। যদিও জুলাই আগস্টের ঘটনার সঙ্গে সব পুলিশ জড়িত না। ওই সূত্রের দাবি, পুলিশ জনতার জন্য তৈরি, তাদের নিরাপত্তার জন্য এখন তারা প্রস্তুত, তবে জনতার সমর্থন ও তাদের সহযোগিতা ছাড়া পুলিশ কিছু কিছু ক্ষেত্রে অসহায়।

পুলিশের গ্রেপ্তারি কাজে অনীহা নিয়ে সুজন মোল্লা নামের এক ভুক্তভোগী বলেন, গত ১১ আগস্ট ঢাকার সিএমএম আদালতে তার বৃদ্ধ বাবাকে হত্যাচেষ্টার অভিযোগে তিনি বাদী হয়ে মামলা করেন। সেই মামলা দায়েরের পরে আদালত এফআইআর হিসেবে গ্রহণের জন্য থানাকে নির্দেশ দেন। থানা কর্তৃপক্ষ এফআইআর গ্রহণ করলেও আসামি গ্রেপ্তার করছেন না। তিনি তার অভিযোগে আরও বলেন, শ্যামপুর থানার ওসির কাছে কয়েকবার গিয়েছি। তাকে আসামি গ্রেপ্তারের বিষয়ে বলা হলে তিনি বলেন, থানায় এখন অস্ত্র নেই। গণঅভ্যুত্থানের পরে বেশিরভাগ অস্ত্র লুট হয়ে গেছে। এ ছাড়া আমাদের ফোর্সের সংখ্যাও নেই। এ সময় আসামি গ্রেপ্তার করা অনিরাপদ।

সুজন আরও বলেন, আমরা মামলা করে উল্টা বিপদের মধ্যে আছি। থানা আসামি গ্রেপ্তার না করার কারণে আসামি উল্টো আমাদের হয়রানি করছেন। তবে, বর্তমান বাব অবস্থাও বুঝতে পারছি।

ঢাকার সিএমএম আদালতের ৩৪টি এজলাসে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গণঅভ্যুত্থানের পরে অনেক মামলার সংখ্যা কমে গেছে। গণঅভ্যুত্থানের আগে যেখানে প্রতিদিন ৮-১০টা মামলা হতো সেখানে প্রতিদিন গড়ে ২-৩টি মামলা দায়ের করা হচ্ছে। এর কারণ হিসেবে আইনজীবীরা বলেন, আদালতে মামলা দায়ের করা হলে আদালত বেশির ভাগ মামলাই তদন্ত দেন। এখন থানায় তদন্ত সংক্রান্ত কাজ সেভাবে হচ্ছে না বিধায় এবং গ্রেপ্তারি পরোয়ানা দিলেও পুলিশ আসামিকে গ্রেপ্তার করছে না বিধায় বাদীর মধ্যে এক ধরনের মামলা দায়েরে অনীহা দেখা গেছে।

বিষয়ে ঢাকার আদালতের ফৌজাদারি আইনজীবী আব্দুল্লাহ আল মনসুর রিপন বলেন, গণঅভ্যুত্থানের পরে থানা ভেঙে দেওয়ার কারণে ও পুলিশ সদস্য কিছু মারা যাওয়ার কারণে মাম দায়েরের সংখ্যা কমে গেছে। তিনি বলেন, গণঅভ্যুত্থানের পরে পুলিশ থানায় না থাকার কারণে ও থানায় লজিস্টিক সাপোর্ট না থাকার কারণে অনেক মামলা হয়নি। তিনি বলেন, অনেক পুলিশ কর্মকর্তা কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকায় ও নতুন পুলিশ সদস্য বদলি হয়ে আসার কারণে মামলা দায়েরের সংখ্যা কমে গেছে।

ঢাকার সিএমএম আদালতের সহকারী বেঞ্চ সহকারী রিপন মিয়া বলেন, গত তিন মাসে আদালতে কোনো মামলার চার্জশিট না আসায় বিচারের জন্যও নতুন মামলা আসছে না। পুরাতন মামলার কার্যক্রমই চলছে। তবে নতুন কিছু মামলা আদালতে দায়ের করা হয়েছে।

রিপন মিয়া আরও বলেন, বেশির ভাগই জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের সময় সহিংসতার মামলা। তিনি বলেন, গত তিন মাস ৬৪টি মামলা আদালতে দায়ের করা হয়েছে। এরমধ্যে চেক প্রতারণা, যৌতুক নিরোধ আইন, প্রতারণা, জালিয়াতি এবং জুলাই-আগস্টের সহিংসতার মামলা রয়েছে।

তিনি বলেন, আদালতে দায়ের করা মামলাগুলো বেশির ভাগই তদন্তে পাঠানো হচ্ছে, কিন্তু থানা থকে বা তদন্ত সংস্থা মামলার প্রতিবেদন বা রিপোর্ট আসছে না। এতে মামলার বিচারকাজে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে।

ঢাকা রেলওয়ে থানা পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) পদমর্যাাদার এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করা শর্তে বলেন, এখন কোনো অপরাধী গ্রেপ্তার করতে গেলে জীবন নিয়ে টানাটানি শুরু হয়। কারণ, ভাসমান মাদক কারবারি, চোর-ছিনতাইকারী গ্রেপ্তার করতে গেলে পুলিশ উল্টো বিপদের মুখে পড়ে। এ ছাড়া আদালতের ওয়ারেন্ট মোতাবেক আসামি গ্রেপ্তার করতে গেলেও বাধার মুখে পড়তে হয়। তবে, বর্তমানে সিনিয়র স্যারদের সহযোগিতায় পুলিশ ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। প্রতিদিনই যৌথবাহিনীর অভিযানে আসামি গ্রেপ্তার হচ্ছে। দ্রুত অবস্থার পরিবর্তন হবে বলে জানান তিনি।

ডিএমপির মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন বিভাগের উপ-কমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান জানান, পুলিশে আস্থা ফেরাতে কাজ চলছে। ইতোমধ্যে পুরোদমে থানার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। থানায় মামলা নিতে অনীহার অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, কেউ মামলা করতে গিয়ে ফেরত এলে সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। যেকোনো ঘটনায় ভুক্তভোগীরা যাতে থানায় গিয়ে আইনি সহযোগিতা পান সে বিষয়ে ডিএমপি কমিশনারের স্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া আছে।

 

ভোরের আকাশ/রন

মন্তব্য

Beta version