-->
শিরোনাম

এনবিআরের ব্যবস্থার মুখে জেনেক্স

ভোরের আকাশ প্রতিবেদক
এনবিআরের ব্যবস্থার মুখে জেনেক্স

ভ্যাট আদায়ের যতগুলো যন্ত্র বসানোর কথা ছিল তা করা হয়নি, ভিন্ন ব্র্যান্ডের যন্ত্র সরবরাহ করে ভাঙা হয়েছে শর্ত; চুক্তির এমন আরও কিছু শর্তের ‘বরখেলাপের’ অভিযোগে জেনেক্স ইনফোসিস লিমিটেডের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। তথ্যপ্রযুক্তি খাতের এ কোম্পানির বিরুদ্ধে তদন্ত করে বাস্তবে ও কারিগরি কাজের ক্ষেত্রে চুক্তির ‘গুরুতর অসঙ্গতির’ এসব প্রমাণ পেয়েছে এনবিআরের দুটি কমিটি। এরপর প্রতিবেদনের তথ্য বিশ্লেষণ করে কোম্পানিটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার অংশ হিসেবে নোটিশ দেওয়া হয়েছে। এতে ২৮ দিনের মধ্যে জবাব দিতে বলা হয়েছে।

নোটিশে জেনেক্স ইনফোসিসের বিরুদ্ধে যথাসময়ে নির্দিষ্ট পরিমাণ ইএফডি মেশিন বসাতে না পারা, বসানো ইএফডি ঠিকঠাক স্থাপন না করা, সঠিক ব্র্যান্ডের ইএফডি না বসানো এবং যেগুলো বসিয়েছে তাতে বিক্রির তথ্য সংরক্ষণসহ বিভিন্ন ফিচারের কমতি থাকার অভিযোগ আনা হয়েছে। এছাড়া চুক্তির আওতায় কর্মকর্তা ও মেশিন ব্যবহারকারীদের প্রশিক্ষণের কথা থাকলেও সেটি না করার কথাও বলছে এনবিআর। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস (ইএফডি) স্থাপনের মাধ্যমে ভ্যাট আদায়কে ডিজিটাল করার কাজে এনবিআরের একটি প্রকল্পের কাজে যুক্ত ছিল পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিটি। ইএফডি মেশিন বসানো এবং এ প্রকল্পের বাস্তবায়ন, মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট বাড়ানো ও কর্মকর্তাদের সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য চুক্তিবদ্ধ হলেও অনেক ক্ষেত্রেই সেগুলোর ‘ব্যত্যয়’ করেছে বেসরকারি কোম্পানিটি। তবে দুই বছরের মাথায় বিভিন্ন দায়িত্ব যথাযথ পরিপালন করতে না পারায় ‘চুক্তির বিভিন্ন ব্যত্যয়কে’ সামনে এনে কোম্পানিটির বিরুদ্ধে ‘কেন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না’ সেই ব্যাখ্যা চেয়ে গত ২৮ অক্টোবর নোটিশ দিয়েছে এনবিআর। জেনেক্সের করপোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স প্রধান আশিকুর রহমান এ নোটিশ পাওয়ার কথা বলেছেন। তাদের জনসংযোগ কোম্পানির মাধ্যমে নোটিশে তোলা অভিযোগগুলোর বিষয়ে কোম্পানির অবস্থান তুলে ধরেছেন। তবে নোটিশের জবাব দেওয়া হয়েছে কি না বা তা কবে এনবিআরকে দেবেÑ সে বিষয়ে কোনো তথ্য দেওয়া হয়নি।

এনবিআরের চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খানের পাঠানো নোটিশে জেনেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে ২৮ দিনের মধ্যে বক্তব্যের স্বপক্ষে প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত ও দালিলিক প্রমাণ উপস্থাপনের জন্য বলা হয়েছে।

নির্ধারিত কার্যদিবসের মধ্যে কোনো জবাব না পাওয়া গেলে এটি বিবেচনা করা হবে যে, এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানের কোনো বক্তব্য নেই। সেক্ষেত্রে বর্তমানে প্রাপ্ত ও রক্ষিত তথ্যের ভিত্তিতেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে। এ বিষয়ে এনবিআরের চেয়ারম্যানের সঙ্গে বারবার বিভিন্ন মাধ্যমে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও পাওয়া যায়নি।

জানা গেছে, কর বৃদ্ধি ও আহরণ বাড়াতে জেনেক্স ইনফোসিসকে দায়িত্ব দিয়ে প্রথমবারের মত কোনো বেসরকারি কোম্পানিকে ২০২২ সালের নভেম্বরে নিজেদের কাজে যুক্ত করেছিল দেশের প্রধান রাজস্ব আদায়কারী প্রতিষ্ঠান এনবিআর। তখন দরপত্রের মাধ্যমে ইএফডি প্রকল্পের জন্য মনোনীত হয় জেনেক্স। খুচরা পর্যায়ের ভ্যাট আদায়ের লক্ষ্যে আগামী পাঁচ বছরে ঢাকা ও চট্টগ্রামে তিন লাখ ইএফডি ও এসডিসি (সেলস ডাটা কন্ট্রোলার) ডিভাইস স্থাপন ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পায় কোম্পানিটি। চুক্তির আওতায় কোম্পানিটি বিনামূল্যে বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও বিপণিবিতানে ইএফডি মেশিন বসাবে; বিনিময়ে প্রতি ১০০ টাকা ভ্যাটে ৫২ পয়সা কমিশন পাবে।

জেনেক্সের সঙ্গে চুক্তির শর্ত বাস্তবায়নের অগ্রগতি পর্যালোচনায় এনবিআর একটি ‘টেকনিক্যাল’ ও একটি ‘ফাংশনাল’ কমিটি গঠন করে। কমিটি দুটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জেনেক্সের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী আইসিনো করপোরেশনের ইএফডি/এসডিসি আমদানির কথা থাকলেও ভিন্ন উৎস থেকে ১৫ হাজার ৬০০টি যন্ত্র আমদানি করে বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে বসানো হয়েছে। ইএফডিতে দুই বছরের তথ্য সংরক্ষণের ক্ষমতা, ডিজিটাল সার্টিফিকেট ফিচার, ফাইভ-জি নেটওয়ার্ক সিম, এসডিসি স্ট্যাটাস ডিসপ্লে মডেল, করদাতার তথ্য সংরক্ষণসহ বিভিন্ন ফিচার থাকার কথা থাকলেও তা এসব যন্ত্রে নেই। নোটিশে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালের ৩ নভেম্বর চুক্তির এক বছরের মধ্যে ২০ হাজার ইএফডি বসানোর কথা ছিল। পরে সমন্বয় সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী একই সংখ্যক মেশিন বসানোর জন্য ২০২৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত সময় বেঁধে দেওয়া এনবিআর। তবে জেনেক্স বাস্তবে তিনটি জোনে যন্ত্র বসাতে পেরেছে ১৫ হাজার ৯৯৫টি। এর মধ্যে ১২ হাজার ডিভাইস প্রকৃতভাবে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে স্থাপন করা হয়েছে এবং বাকি ডিভাইসগুলো সিস্টেমে ‘পেয়ারিং’ অবস্থায় ছিল। এ অভিযোগের বিষয়ে জেনেক্সের করপোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স প্রধান আশিকুর রহমানের দাবি এসিনো করপোরেশন থেকে যন্ত্র বসানোর কথা থাকলেও তাদের ‘অপারেশন বন্ধ’ হয়ে যাওয়ায় গ্রাহকদের পরবর্তী প্রযুক্তিগত সহায়তা দেওয়ার জটিলতা (আফটার সেল সার্ভিস) বিবেচনায় অন্য ব্র্যান্ডের আরও উন্নত মানের যন্ত্র সরবরাহ করা হয়েছে। এসব মেশিনের ইন্টারন্যাল মেমোরির মাধ্যমে দুই বছরের ডাটাবেজ সংরক্ষণ করা যাচ্ছে। ফলে ফিসক্যাল মেমোরির বিষয়টা আমাদের জন্য কোনো অসুবিধা তৈরি করছে না। এসিনোর যন্ত্র ‘ফোরজি সাপোর্ট’ করলেও তাদের সরবরাহ করা অন্য যন্ত্রগুলো ‘ফাইভজি নেটওয়ার্ক সাপোর্ট’ করতে সক্ষম বলে দাবি তার।

চুক্তির আওতায়, চীন অথবা দুবাইয়ে কারখানা পরিদর্শন করানোর পাশাপাশি এনবিআর কর্মকর্তাদের সিস্টেম মনিটরিংয়ের জন্য বিদেশে প্রশিক্ষণ ও মেশিন ব্যবহারকারীদের রেকর্ড করা টিউটোরিয়াল সরবরাহ করার কথা ছিল। এছাড়া মানবসম্পদ পদায়ন, স্মার্ট কার্য সম্পাদন পরিকল্পনা প্রণয়ন, রাজস্ব আদায়ে অনিয়ম বিষয়ে তথ্যসংগ্রহে পরিকল্পনা তৈরির শর্ত থাকলেও ‘ফাংশনাল কমিটির’ প্রতিবেদন বলছে, এর কিছুই করা হয়নি। এসব অভিযোগের বিষয়ে জেনেক্স দাবি করেছে, ডলারে কৃচ্ছ্বতা সাধনের সরকারি আদেশকে আমলে নিয়ে এনবিআরের কর্মকর্তাদের জন্য চীনে উচ্চতর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়নি। তবে এই প্রকল্পের সফলতা বা ব্যর্থতার এটি কোনোভাবে প্রভাবিত করবে না।

কোম্পানির করপোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স প্রধান আশিকুর রহমান ইএফডি বসানোর প্রকল্পে প্রত্যাশা পূরণ করতে না পারায় মাঠ পর্যায়ে দোকান মালিক সমিতি ও খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে পুরোপুরি অসহযোগিতা পাওয়ার দাবি করেন। এমনকি জেনেক্স ইনফোসিসের কর্মীরা খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে লাঞ্ছিত হওয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে। এছাড়া খুচরা ব্যবসায়ী পর্যায়ে দোকানদারকে ডিভাইস বসানোর ব্যাপারে ‘বাধ্য করার কোনো পদ্ধতি’ তাদের হাতে না থাকার দাবি করে তিনি বলেন, ইএফডি মেশিন ব্যবহারের জন্য এনবিআরে মাঠ পর্যায়ের ফোর্স আরও বেশি গুরুত্বের সঙ্গে তদারক করলে আমাদের সফলতার হার আরও বেড়ে যেত।

 

ভোরের আকাশ/রন

মন্তব্য

Beta version