একুশে টেলিভিশনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বক্তব্য প্রচারের অভিযোগে ওই টিভির চেয়ারম্যান আব্দুস সালাম, দুই সাংবাদিক মাহাথীর ফারুকী ও কনক সারওয়ারকে আসামি করে ২০১৫ সালের ৮ জানুয়ারি তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে মামলা করে সে সময়কার সরকার। ওই মামলায় তারেক রহমানকেও আসামি করা হয়। আব্দুস সালামের সঙ্গে যোগসাজশে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকি সৃষ্টির অভিযোগে তারেক রহমানকে এই মামলায় আসামি করা হয়। তারেক রহমানের বিরুদ্ধে জারি করা হয় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা। এই মামলার বৈধতা নিয়ে হাইকোর্টে মামলা করেন আব্দুস সালাম। মামলায় যথাযথ উপাদান না থাকায় গত ৩১ অক্টোবর হাইকোর্ট ওই মামলা বাতিল করে দিয়েছেন। ফলে প্রায় ১০ বছর পর মামলা থেকে খালাস পেয়েছেন তারেক রহমান, আব্দুস সালামসহ সকল আসামি। একই সঙ্গে চাঁদাবাজির অভিযোগে ১৭ বছর আগে ২০০৭ সালে করা ৫টি মামলায় তারেক রহমানকে খালাস দিয়ে গত ২৩ ও ২৪ অক্টোবর রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট।
শুধুই এই ৬টি মামলা নয়, গত তিন মাসে আদালতের রায়ে ৩২ মামলা থেকে খালাস পেয়েছেন তারেক রহমান। এখনও তার বিরুদ্ধে একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলা, জিয়া এতিমখানা ট্রাস্ট মামলা, জ্ঞাত আয় বহির্ভূতভাবে সম্পদ অর্জনের অভিযোগের মামলাসহ অর্ধশত মামলা চলমান। এরমধ্যে একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলাসহ যে ৬টি মামলায় তারেক রহমানের সাজা হয়েছে সে সব মামলাই তার দেশে ফেরার ক্ষেত্রে প্রধান বাধা হিসেবে দেখা হচ্ছে। এসব মামলাও আদালতের মাধ্যমে নিষ্পত্তির পথে হাঁটছেন তারেক রহমান। এ লক্ষ্যে তার আইনজীবী প্যানেলকেও প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত তারেক রহমানের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলোর ভবিষ্যৎ নিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা শুরু হয়েছে। তারেক রহমানের বিরুদ্ধে করা মামলাকে রাজনৈতিক মামলা হিসেবে উল্লেখ করে তা প্রত্যাহারের জন্য বিএনপির পক্ষ থেকে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে দাবি জানানো হয়েছে। কিন্তু গত তিনমাসে সরকারের পক্ষ থেকে মামলা প্রত্যাহারের কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি। এমন অবস্থায় আদালতের মাধ্যমেই তারেক রহমানের সব মামলা নিষ্পত্তির পথে হাঁটছেন তার আইনজীবীরা।
এ বিষয়ে তারেক রহমানের আইনজীবী ও বিএনপির কেন্দ্রীয় আইনবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল ভোরের আকাশকে বলেন, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সবসময় আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই তিনি তার মামলায় আইনগতভাবে মোকাবিলা করার জন্য আইনজীবী টিমকে নির্দেশনা দিয়েছেন। আমরা সেভাবেই কাজ করছি। তিনি বলেন, দলীয় নেতাকর্মীসহ দেশবাসী জানেন যে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে যেসব মামলা করা হয়েছে তা রাজনৈতিকভাবে প্রতিহিংসামূলক। তাকে রাজনীতি ও দেশের সেবা করা থেকে দূরে রাখতেই এইসব মামলা করা হয়েছে। তিনি বলেন, এরইমধ্যে বেশ কিছু মামলায় আদালত তারেক রহমানকে খালাস দিয়েছেন। কয়েকটি মামলা বাদীপক্ষ প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। ফলে এখন যেসব মামলা রয়েছে তা আইনগতভাবে মোকাবিলা করা হবে। যেসব মামলায় সাজা হয়েছে সেসব মামলা এই মুহূর্তে তারেক রহমানের দেশে ফেরার ক্ষেত্রে বাধা কি-না জানতে চাইলে ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বলেন, কোনো মামলাই তারেক রহমানের দেশে ফেরার ক্ষেত্রে বাধা নয়। তিনি উপযুক্ত সময়েই দেশে ফিরবেন।
প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, একই ঘটনায় বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে করা মামলায় ২০ বছর, জিয়া এতিমখানা মামলায় ১০ বছর, জ্ঞাত আয় বহির্র্ভূতভাবে সম্পদ অর্জনের অভিযোগের মামলায় ৯ বছর, বিদেশে অর্থ পাচারের অভিযোগের মামলায় ৭ বছর এবং শেখ মুজিবুর রহমানকে কটূক্তি করার অভিযোগে মানহানির মামলায় দুই বছরের কারাদণ্ড হয়েছে তারেক রহমানের। সবগুলো মামলায় তারেক রহমানকে পলাতক দেখিয়ে সাজা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া তার বিরুদ্ধে আর যেসব মামলা রয়েছে তার অধিকাংশই মানহানির অভিযোগে করা।
জানা গেছে, ফৌজদারি আইনের বিধান অনুযায়ী যেসব মামলায় সাজা হয়েছে সেসব মামলায় জামিন আবেদন করতে হলে সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণ করতে হবে। আত্মসমর্পণ ছাড়া জামিন আবেদন করার সুযোগ নেই। আর যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের ক্ষেত্রে আত্মসমর্পণ করেই সেদিনই আদালত থেকে জামিন পাওয়ার সুযোগ কম। তাই এক্ষেত্রে তাকে কিছুদিন কারাভোগ করতে হতে পারে। আইনের এই বিধান অনুযায়ী এই মুহূর্তে তারেক রহমান দেশে ফিরলে ওই ছয় মামলায় তাকে আদালতে হাজির হতে হবে তথা আত্মসমর্পণ করে জামিন চাইতে হবে। যেহেতু একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় তার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে, তাই এই মামলায় আত্মসমর্পণের দিনই নিম্ন আদালত থেকে জামিন পাওয়ার সুযোগ কম। ফলে নিম্ন আদালত তাকে জামিন না দিলে তাকে কারাগারে যেতে হবে। একবার কারাগারে গেলে সহসাই তিনি জামিন পাবেন- এমন নিশ্চয়তা কেউই দিতে পারবেন না এই মুহূর্তে। কারণ দেশের বর্তমান রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও বিচারিক ব্যবস্থা পুরোপুরি বিএনপির অনুকূলে নয়।
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের জেরে গত ৫ আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। কিন্তু তার শাসনামলে নিয়োগ পাওয়া বিচারকরা এখন দেশের সব বিচারালয়ে পরিপূর্ণ। তাদের কাছ থেকে তারেক রহমান ন্যায়বিচার পাবেন- এমন প্রত্যাশা করেন না তার আইনজীবীরা। তারেক রহমানের আইনজীবীদের এই শঙ্কার কারণ, অতীতে তারেক রহমানের সঙ্গে বিচারকদের করা আচরণ। একটি মামলায় (বিদেশে অর্থ পাচার করার অভিযোগ) তারেক রহমানকে নিম্ন আদালত খালাস দিলেও হাইকোর্ট সে মামলায় তারেক রহমানকে ১০ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন। ওই মামলায় রায়ের আগে নিম্ন আদালতের বিচারককে ডেকে নেওয়া হয়েছিল হাইকোর্টের এক বিচারপতির বাসায়। সেখানে তার মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে তারেক রহমানকে সাজা দিতে বলা হয়েছিল। কিন্তু তিনি তাতে রাজি না হওয়ায় তাকে দেশ ছাড়তে হয়। আওয়ামী লীগ সরকারের কথা মেনে না নেওয়ায় দেশের প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহাকে দেশ ছাড়তে হয়। এসব প্রক্রিয়ার সঙ্গে যারা যুক্ত ছিলেন তাদের অনেকেই এখনও প্রশাসনে রয়েছেন। এমনকি প্রশাসনে যারা আছেন তাদের অধিকাংশই আওয়ামী ঘরানার। এই আওয়ামী ঘরানার কর্মকর্তাদের কাছ থেকে তারেক রহমান কোনো ছাড় পাবেন না বলেই ধারণা। এছাড়া গত তিন মাসে তারেক রহমানের কোনো মামলাই সরকার প্রত্যাহার করেনি। ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা ও তার দল আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বক্তব্য দেওয়ার পাশাপাশি বিএনপির বিরুদ্ধে বক্তব্য দিচ্ছেন বর্তমান সরকারের চালিকা শক্তি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা। কয়েকদিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিএনপির ছাত্র সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের পোস্টার সাটানোর বিরুদ্ধে মিছিলও হয়েছে। এসব বিবেচনায় সকল মামলা নিষ্পত্তি হওয়ার পরই তারেক রহমান দেশে ফিরবেন বলে আইনজ্ঞ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মত।
এক-এগারোর তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে ২০০৭ সালের ৭ মার্চ তারেক রহমানকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাকে গ্রেপ্তারের পর রিমান্ডেও নেওয়া হয়। ১৮ মাস কারাভোগের পর ২০০৮ সালের ৩ সেপ্টেম্বর মুক্তি পান তিনি। ওই ১৮ মাসে ১৩ মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয় তারেককে। ১৩ মামলায় ধাপে ধাপে তাকে জামিন দেওয়া হয়। কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার আট দিন পর ওই বছরের ১১ সেপ্টেম্বর তিনি লন্ডনের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেন। সেই থেকে তিনি লন্ডনেই আছেন।
যেসব মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হন তারেক রহমান:
এক. রাজধানীর গুলিস্থানে বঙ্গবন্ধু এভিনিউ-এ আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয়ের সামনে শেখ হাসিনার সমাবেশে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনায় ২৪ জন নিহত হন। এ ঘটনায় পৃথক দুটি মামলা হয়। একটি হত্যা মামলা। অপরটি বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে মামলা। হত্যা মামলায় ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর নিম্ন আদালতে রায় হয়। রায়ে তারেক রহমানকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এই মামলায় সাবেক স্বরাষ্ট্র্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর ও সাবেক শিক্ষা উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। তারেক রহমানসহ ১৯ জনের যাবজ্জীবন এবং ১১ জনের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড হয়। এ মামলায় ডেথ রেফারেন্স ও কারাবন্দি আসামিদের করা আপিলের ওপর বিচারপতি একে এম আসাদুজ্জামানের নেতৃত্বাধীন হাইকোর্ট বেঞ্চে শুনানি চলছে।
দুই. একই ঘটনা থেকে উদ্ভূত বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের মামলায়ও একই আদালত থেকে রায় দেওয়া হয় ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর। বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের মামলায় তারেক রহমানকে ২০ বছর কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
তিন. বিদেশে অর্থ পাচারের অভিযোগে ২০১৩ সালের ১৭ নভেম্বর একটি মামলায় ঢাকার একটি বিশেষ জজ আদালত তারেক রহমানকে খালাস দেন। ওই মামলায় বিশিষ্ট ব্যবসায়ী গিয়াস উদ্দিন আল মামুনকে সাত বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। তারেক রহমানকে খালাসের রায়ের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) হাইকোর্টে আপিল করেন। ওই আপিল শুনানি শেষে হাইকোর্ট ২০১৬ সালের ২১ জুলাই বিচারিক আদালতের খালাসের রায় বাতিল করে তারেক রহমানকে সাত বছরের কারাদণ্ড দেন। এই মামলায় তারেক রহমানকে খালাস দেওয়ায় নিম্ন আদালতের বিচারক মোতাহার হোসেনকে দেশ ছাড়তে হয়। বিচারক মোতাহার হোসেনের অভিযোগ, হাইকোর্টের এক বিচারপতির বাসভবনে তাকে ডেকে নিয়ে মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে তারেক রহমানকে সাজা দিতে বলা হয়েছিল।
চার. জিয়া এতিমখানা ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় ঢাকার একটি বিশেষ জজ আদালত ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি এক রায়ে তারেক রহমানকে ১০ বছর কারাদণ্ড দেয়। এই মামলায় তার মা সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে ৫ বছর কারাদণ্ড দেওয়া হয়। তবে দুদকের আপিলে খালেদা জিয়ার সাজা বাড়িয়ে ১০ বছর করেন হাইকোর্ট।
পাঁচ. জ্ঞাত আয় বহির্র্ভূতভাবে সম্পদ অর্জন ও সম্পদের তথ্য গোপনের অভিযোগের মামলায় গতবছর ২ আগস্ট ঢাকার সিনিয়র বিশেষ জজ আদালত তারেক রহমানকে ৯ বছর ও তার স্ত্রী ডা. জোবাইদা রহমানকে ৩ বছর কারাদণ্ড দেয়।
ছয়. ২০১৪ সালের ১৬ ডিসেম্বর লন্ডনে যুক্তরাজ্য বিএনপি আয়োজিত এক সমাবেশে বঙ্গবন্ধুকে রাজাকার ও পাকবন্ধু আখ্যা দিয়ে বক্তব্য দেওয়ার অভিযোগে নড়াইলের মুক্তিযোদ্ধা শাহজাহান বিশ্বাস নড়াইল জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে তারেকের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করেন। এই মামলায় নড়াইলের একটি জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত ২০২১ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি তারেক রহমানকে দুই বছরের কারাদণ্ড দেয়।
২০০৭-০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলেই তারেকের বিরুদ্ধে ১৩টি মামলা হয়। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর মামলার সংখ্যা আরও বাড়তে থাকে। সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী তারেক রহমানের বিরুদ্ধে ৮০টি মামলা হয়েছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন থাকাবস্থায় সকল গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তারেক রহমানের বক্তব্য প্রচারের ওপর নিষেধাজ্ঞা ছিল। যা গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর প্রত্যাহার করা হয়।
ভোরের আকাশ/রন
মন্তব্য