ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) সাবেক মহাপরিচালক (ডিজি), সাবেক র্যাব কর্মকর্তা মেজর জেনারেল (বরখাস্ত) জিয়াউল আহসানকে জিজ্ঞাসাবাদ করবেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন টিম। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের অভিযোগে গ্রেপ্তার জিয়াউল আহসানকে একদিনের জন্য জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল।
বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল গতকাল মঙ্গলবার এ আদেশ দিয়েছেন। ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম এই আবেদন করেন। এসময় প্রসিকিউটর গাজী এইচ তামিম ও বিএম সুলতান মাহমুদ উপস্থিত ছিলেন।
এদিকে জিয়াউল আহসান, তারেক সিদ্দিকীসহ ৯ র্যাব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ দাখিল করেছেন ১৩ বছর আগে র্যাবের গুলিতে পা হারানো ঝালকাঠির লিমন হোসেন।
জিয়াউল আহসানের বিরুদ্ধে আদেশের পর চিফ প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, জিয়াউল আহসানের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ, তার বিরুদ্ধে অভিযোগের অন্ত নেই। এর মধ্যে অসংখ্য হত্যাকাণ্ড ও গুমের ঘটনা রয়েছে। তদন্ত সংস্থায় তার বিরুদ্ধে অসংখ্য অভিযোগ এসেছে। তদন্ত সংস্থা ইতোমধ্যে তার বিরুদ্ধে প্রমাণ পেয়েছে। এই পূর্ণাঙ্গভাবে তদন্ত হলে তার ব্যাপারে সব জানা যাবে। তিনি অলরেডি গ্রেপ্তার আছেন। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা দরকার। কার মাধ্যমে তিনি এ হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটিয়েছেন। সেটা জানার স্বার্থে আইন অনুসারে তাকে একদিনের জন্য জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি চেয়েছি। আদালত অনুমতি দিয়েছেন। নির্ধারিত তারিখে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে গত ৫ আগস্ট দেশ থেকে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। এর দুইদিন পর ৭ আগস্ট ভোররাতে রাজধানীর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের এমিরেটসের ফ্লাইট-৫৮৫ রানওয়ে থেকে বোর্ডিং ব্রিজে ফিরিয়ে আনার পর জিয়াউল আহসানকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর তাকে রিমান্ডে নেওয়া হয়।
দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পাওয়ার আগ পর্যন্ত জিয়াউল আহসান ২০২২ সাল থেকে ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। এর আগে তিনি ওই কোম্পানির পরিচালক ছিলেন। ২০০৯ সালের র্যাব-২-এর সহঅধিনায়ক হন জিয়াউল আহসান। একই বছর তিনি লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদে পদোন্নতি পান এবং র্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখার পরিচালক নিযুক্ত হন। সে সময় থেকেই তার বিরুদ্ধে গুম ও গুপ্ত হত্যার অভিযোগ ওঠে।
একটি মামলার তদন্ত শেষ হতে কতদিন লাগে : সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিরাপত্তা উপদেষ্টা তারেক আহমেদ সিদ্দিকী, সাবেক র্যাব কর্মকর্তা জিয়াউল আহসান ও মেজর রাশেদসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ দাখিল করেছেন ১৩ বছর আগে গুলিতে পা হারানো ঝালকাঠির লিমন হোসেন। গতকাল মঙ্গলবার ট্রাইব্যুনালের প্রধান কৌঁসুলির কার্যালয়ে স্বশরীরে হাজির হয়ে লিমন এ অভিযোগ দাখিল করেন।
পরে লিমন সাংবাদিকদের বলেন, ২০১১ সালে আমাকে ধরে নিয়ে আমার পায়ে গুলি করে র্যাব। আমাকে ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এই হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে বাধার সৃষ্টি করেন সেসময়কার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন। এনিয়ে আমি একট মামলা করি। কিন্তু পরে র্যাব গুলি করার কথা অস্বীকার করে। তিনি বলেন, ওই সময় প্রথমদিকে মানবাধিকার কমিশন বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখলেও পরে আমাকে আপোষ করার প্রস্তাব দেয় কমিশন। তিনি বলেন, হাইকোর্ট আমার চিকিৎসার খরচ দিতে সরকাররের প্রতি নির্দেশ দিলেও সেই আদেশ মানেনি তখনকার ফ্যাসিস্ট সরকার। তিনি বলেন, গত ১৩ বছর ধরে আমি ও আমার পরিবার হয়রানির শিকার হয়ে আসছি। একটি রাষ্ট্রীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে মামলা করলাম। একটি মামলায় এ যাবত পাঁচবার নারাজি দিয়েছি এবং দুই/তিনবার রিভিউ আবেদন করেছি। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনো সুরাহা পাইনি। এখন সিআইডি তদন্ত করছে। আমার প্রশ্ন হলো একটি মামলার তদন্ত শেষ করতে কতদিন লাগে? তিনি বলেন, আমি ন্যায়বিচারের, সুষ্ঠু বিচারের জন্য ঘুরছি। আমার পক্ষে নয়, আমি সুষ্ঠু বিচার চাই। আমি ও আমার পরিবার ২০১১ সালের পর থেকেই ফ্যাসিস্ট সরকারের দোসরদের কর্তৃক বারবার হামলা-মামলার শিকার হয়েছি। তাই আমি ও আমার পরিবারের সকলের নিরাপত্তা চাই রাষ্ট্রের কাছে। তিনি পা হারানোর জন্য ক্ষতিপূরণ দাবি করেন।
২০১১ সালের ২৩ মার্চ ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলার সাতুরিয়া গ্রামে বরিশাল র্যাব-৮ এর সদস্যরা লিমনকে গুলি করে। তখন র্যাবের পক্ষ থেকে বলা হয়, দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী মোর্শেদ জমাদ্দারের সহযোগী লিমন। মোর্শেদকে গ্রেপ্তারে অভিযান চালানোর সময় কলেজছাত্র লিমন হোসেন গুলিবিদ্ধ হন। পরে ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে (নিটোর) চিকিৎসা চলাকালে লিমনের বাঁ পা হাঁটু থেকে কেটে ফেলতে হয়। ওই ঘটনায় লিমনের মা হেনোয়ারা বেগম বাদী হয়ে ২০১১ সালের ১০ এপ্রিল ঝালকাঠির আদালতে একটি হত্যাচেষ্টা মামলা করেন। সেই মামলার তদন্তই এখনো শেষ হয়নি। সে সময় বরিশাল র্যাব-৮ এর উপ-সহকারী পরিচালক-ডিএডি লুৎফর রহমান, কনপোরাল মাজহারুল ইসলাম, কনস্টেবল মো. আব্দুল আজিজ, নায়েক মুক্তাদির হোসেন, সৈনিক প্রহ্লাদ চন্দ এবং কার্তিক কুমার বিশ্বাসসহ অজ্ঞাতনামা আরও ছয় র্যাব সদস্য ওই মামলার আসামি। র্যাবের ভাষ্য ছিল, অভিযান চালানোর সময় কিশোর লিমন গুলিবিদ্ধ হন। তবে লিমন বলছেন, র্যাবের সদস্যরা তার হাঁটুতে পিস্তল ঠেকিয়ে গুলি করেছিলেন। লিমনকে গুলি করে উল্টো তার বিরুদ্ধে অস্ত্র ও বিস্ফোরক আইনের দুটি পৃথক মামলা করে র্যাব। মামলায় তার কাছ থেকে অস্ত্র ও বিস্ফোরক উদ্ধারের অভিযোগ আনা হয়। মামলাগুলোতে লিমনের বয়স লেখা হয়েছিল ২৫ বছর। অথচ বিদ্যালয়ের সনদ অনুযায়ী তখন লিমনের বয়স ১৬ বছর তিন মাস। পুলিশ দুই মামলাতেই তার বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দিলে মামলা বিচারের জন্য আদালতে যায়। এক পা নিয়ে লিমনকে ঘুরতে হয় আদালতে। ২০১৩ সালে আদালত মামলা দুটি খারিজ করে দেয়। ওই সময় দেশের বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন এবং নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা লিমনের পাশে দাঁড়ান। বিচারের দাবি উঠতে থাকে সারা দেশে। ঢাকা, ঝালকাঠিসহ বিভিন্ন স্থানে লিমনের মুক্তি ও বিচারের দাবিতে মানববন্ধনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালিত হয়। লিমনের পায়ে গুলি করা হয়েছিল তার উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার কয়েকদিন আগে। তাই ওই বছর আর পরীক্ষা দেওয়া হয়নি। পরের বছর পিরোজপুরের কাউখালী উপজেলার কাঁঠালিয়া পিজিএস বহুমুখী স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর সাভারের গণবিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হন। বর্তমানে তিনি সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনের শিক্ষক।
ভোরের আকাশ/রন
মন্তব্য