১৯৮৭ সালের ২০ মে যাত্রা শুরু করে আইসিবি ইসলামী ব্যাংক। তখন এর নাম ছিল আল-বারাকা ব্যাংক। ১৯৯০ সালে এটি ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত হয়। ১৯৯৪ সালে এটি ‘সমস্যাযুক্ত ব্যাংকে’ পরিণত হয়। তখন ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে ত্রুটিযুক্ত ব্যাংকগুলোতে পর্যবেক্ষক নিয়োগের প্রথা চালু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে ২০০৪ সালে ব্যাংকটি পুনর্গঠিত হয় এবং নাম পরিবর্তন করে ওরিয়েন্টাল ব্যাংক রাখা হয়। ব্যাপক অনিয়ম ধরা পড়ার পর ২০০৬ সালের জুনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ বিলুপ্ত করে দেয়। আনুমানিক ৩৪ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ২০০৫ ও ২০০৬ সালে ৩৪টি মামলা হয়। তখন বাংলাদেশ ব্যাংক এটির পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেয় এবং আমানতকারীদের অর্থ সুরক্ষার জন্য ব্যাংকের প্রশাসক হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন নির্বাহী পরিচালককে নিয়োগ দেয়। ২০০৭ সালের আগস্টে ব্যাংকটির অধিকাংশ শেয়ার বিক্রির জন্য দরপত্র আহ্বান করে বাংলাদেশ ব্যাংক। তখন এশিয়া ও আফ্রিকায় ব্যাংকিং ব্যবসা পরিচালনাকারী সুইস ও মালয়েশিয়ার আইসিবি গ্রুপের দুজন দরপত্রে অংশ নেন। ২০০৮ সালে ব্যাংকটির নাম পরিবর্তন করে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক করা হয়। তবে ব্যাংকটির সিংহভাগ শেয়ার আইসিবি ব্যাংকিং গ্রুপ মালয়েশিয়ার। এটি বাংলাদেশের দ্বিতীয় প্রজন্মের ব্যাংক। মুহাম্মদ শফিক বিন আবদুল্লাহ ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক। তার সঙ্গে ব্যাংকের সমস্যা, সংকট, সমাধান এবং আর্থিক খাত নিয়ে আলাপ করেছেন দৈনিক ভোরের আকাশের বিশেষ প্রতিবেদক সাজেদা হক। সংকট কাটিয়ে উঠতে তিনি গ্রাহকদের কাছে আস্থা রাখার আহ্বান জানান।
ভোরের আকাশ: কেমন চলছে আপনাদের কার্যক্রম?
মুহাম্মদ শফিক বিন আবদুল্লাহ: আলহামদুলিল্লাহ। আমি এই ব্যাংকের দায়িত্ব নিয়েছি ২০১৩ সালে। তখন এই ব্যাংকের ইমেজ প্রায় ছিল না বললেই চলে। মূলত এই ব্যাংকের বিনিয়োগকারীদের একটা বড় অংশই ছিল মালয়েশিয়ান ব্যবসায়ীদের। তারাই আমাকে এই ব্যাংকের হাল ধরতে বাংলাদেশে পাঠান। আমি তখন থেকেই ব্যাংকের উন্নয়নে কাজ করছি। আশা করছি, শিগগিরই সব সমস্যা কাটিয়ে উঠবো।
ভোরের আকাশ: এই মুহূর্তে কোন কোন সমস্যা মোকাবিলা করছেন?
মুহাম্মদ শফিক বিন আবদুল্লাহ: সমস্যা তো অনেক। তারল্য সংকট আছে (লিকুইড মানি), গ্রাহক নেই, ঋণখেলাপির হার অনেক বেশি। আর্থিক সংকট নিরসনে গত ৩১ জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে জামানতহীন ৫০ কোটি টাকা অর্থ সহায়তার আবেদন করেছিলাম; তা নামঞ্জুর করে দিয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কার্যক্রম শুরু করলে গত সপ্তাহে আমি গভর্নরের সঙ্গে বসেছিলাম। তিনি আশ্বাস দিয়েছেন। আশা করি, আমরা আমাদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবো।
ভোরের আকাশ: কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রা কী?
মুহাম্মদ শফিক বিন আবদুল্লাহ: মালিকানা নিয়ে চলমান মামলা সুরাহা হয়নি। এটি এখনও বড় ইস্যু। আমরা চেষ্টা করছি যত দ্রুত সম্ভব মালিকানার সমস্যা সমাধান করার। ওরিয়েন্টালের কারণে ব্যাংকের ইমেজ অনেকখানি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, ইমেজ সংকট কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছি। তারল্য সংকট একটা সমস্যা, তা নিয়েও কাজ করছি। সবার ওপরে গ্রাহকের আস্থা যাতে আবার ফিরে আসে, তা নিয়ে কাজ করছি। আমাদের প্রধান কাজই হচ্ছে গ্রাহকদের মধ্যে আস্থার বন্ধন তৈরি করা।
ভোরের আকাশ: আস্থা বাড়াতে আপনাদের উদ্যোগ কী?
মুহাম্মদ শফিক বিন আবদুল্লাহ: আমাদের বর্তমানে নতুন করে কোনো ঋণখেলাপি নেই। এখন যেসব ঋণ দেয়া হচ্ছে, তা সঠিকভাবে যাচাই-বাছাই করেই দেয়া হচ্ছে। ফলে নতুন কোন ডিফল্টার হচ্ছে না। পুরোনো ঋণখেলাপিদের থেকে টাকা আদায় করতে পারছি না। ফলে তারল্য সংকটটা রয়েই যাচ্ছে। যদিও স্টাফ স্যালারি দেয়া নিয়ে একটা গুজব আছে যে আমরা স্টেপ বাই স্টেপ স্যালারি দিচ্ছি, তা ঠিক নয়। আমাদের স্টাফ স্যালারি এখন নিয়মিত হয়েছে। এটা একটা উন্নতি।
ভোরের আকাশ: সরকারের সহায়তা আপনার কাছে যথেষ্ট মনে হচ্ছে কি?
মুহাম্মদ শফিক বিন আবদুল্লাহ: হ্যাঁ, এখন পর্যন্ত খুবই পজেটিভ সাড়া পেয়েছি। কিছু আইনের পরিবর্তন করতে হবে। সরকারকে আইন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বসে কিছু সমস্যার সমাধান করতে হবে। কারণ অনেক মামলা ঝুলে আছে। দীর্ঘমেয়াদি মামলার কারণে আমাদের বিপাকে পড়তে হয়। এজন্য সরকারকে দ্রুততার সাথে এসব মামলার সমাধান করার উদ্যোগ নিতে হবে।
ভোরের আকাশ: সরকারের কাছে আরও কী কী উদ্যোগ চান?
মুহাম্মদ শফিক বিন আবদুল্লাহ: সত্যিকার অর্থে বলতে গেলে বাংলাদেশের আইন অনেক, কিন্তু প্রয়োগ অনেক কম। আমাদের দেশ মালয়েশিয়ায় যদি কেউ ঋণখেলাপি হয়, তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হয়। সেই ঋণখেলাপিকে সব ধরনের নাগরিক সুযোগ-সুবিধা থেকে সাময়িক সময়ের জন্য বঞ্চিত করা হয়। ঋণ পরিশোধ করার পর তাকে তার নিয়মিত নাগরিক সেবা দেয়া হয়। আর বাংলাদেশে একজন ঋণখেলাপিকে সম্মাননা দেয়া হয়; যা অত্যন্ত দুঃখজনক। তবে ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ও সুশাসন ফিরিয়ে আনতে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে ভালো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এই উদ্যোগও প্রশংসনীয়।
ভোরের আকাশ: সাধারণ গ্রাহকদের উদ্দেশে কিছু বলুন?
মুহাম্মদ শফিক বিন আবদুল্লাহ: শুধু এটুকু বলবো—আমরা চেষ্টা করছি, ইমেজ সংকট কাটিয়ে ওঠার। এটি সম্পূর্ণ ইসলামী শরীয়াহ মোতাবেক চলা ব্যাংক। বাংলাদেশের ৯০ ভাগ মানুষ মুসলমান; সুতরাং আমরা একটা সুযোগ চাই। আরেকবার আমাদের বিশ্বাস করুন। আমাদের কাছে আপনাদের অর্থ আমানত হিসেবে হেফাজতে থাকবে। আমরা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল করেছি। কিছু ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তারল্য সহায়তা পেয়ে যাচ্ছে, কিন্তু আমাদের ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। আশা করছি, আমাদের তারল্য সংকট আর থাকবে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ৪২৫ কোটি টাকা দায়সহ অধিকাংশ ইস্যু লিগ্যাসি ইস্যু এবং ঋণ বিতরণসহ সব ধরনের ব্যাংকিং কার্যক্রম স্বাভাবিকভাবে চলছে। আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের ৩৩টি শাখায় ৩৫০ জন কর্মী আছেন। শরীয়াহভিত্তিক ব্যাংকটিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়োজিত পর্যবেক্ষক রয়েছে, যারা সব সময় তদারকি করছে। সুতরাং আমাদের ওপর আস্থা রাখুন, আমরা আপনাদের নিরাশ করবো না।
ভোরের আকাশ: আপনাকে ধন্যবাদ।
মুহাম্মদ শফিক বিন আবদুল্লাহ: আপনাকেও ধন্যবাদ।
ভোরের আকাশ/রন
মন্তব্য