দেশব্যাপী চলমান অভিযানে ছয় হাজারের বেশি অবৈধ অস্ত্র ও প্রায় দুই লাখ রাউন্ড গোলাবারুদ উদ্ধার করেছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। এসব অবৈধ অস্ত্র ও গোলাবারুদের সঙ্গে সম্পৃক্ত ২৫শ এর বেশী ব্যক্তি গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সেনাবাহিনী কত দিন মাঠে অবস্থান করবে—এই প্রশ্নে তিনি বলেন, অন্তবর্তী সরকার যত দিন চাইবে, ততদিন সেনাবাহিনী থাকবে। গতকাল বুধবার সেনা সদরে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান মিলিটারি অপারেশন পরিদপ্তরের কর্নেল ইন্তেখাব হায়দার খান।
সেনাবাহিনী মাঠে থাকা অবস্থায় মানবাধিকার লঙ্ঘন ও নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে কিনা, ঘটলে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কিনা? এমন প্রশ্নের জবাবে এই সেনা কর্মকর্তা বলেন, মানবাধিকার লঙ্ঘন কিংবা বিচারবহির্ভূত হত্যা প্রতিরোধের বিষয়ে সেনাবাহিনী অত্যন্ত সচেতন রয়েছে। এ বিষয়ে আমাদের সর্বোচ্চ নেতৃত্বের আদেশ রয়েছে। যেকোনো ধরনের পরিস্থিতিতে যেন আমরা বিচারবহির্ভূত হত্যা সংঘটিত হতে না দেই, আমাদের সেই চেষ্টা রয়েছে। মানবাধিকার লঙ্ঘন যেন না ঘটে, এ ক্ষেত্রেও আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা রয়েছে।
৫ আগস্টের পর সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে সড়কেও কাজ করছে সেনাবাহিনী। আর সড়কে ট্রাফিক পুলিশ সক্রিয় থাকলেও ট্রাফিক ব্যবস্থা এখনও নিয়ন্ত্রণহীন। ট্র্যাফিক ব্যবস্থাপনায় সেনাবাহিনীর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন করা হলে কর্নেল ইন্তেখাব হায়দার খান বলেন, দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় অগ্রাধিকার দিয়ে অনেক কাজ করতে হয়। সে ক্ষেত্রে ট্রাফিকিংয়ের বিষয়টি সামনে আসেনি। ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের মূল দায়িত্বটা পুলিশের। স্থায়ী সমাধানের চিন্তা করলে সেখানে সরকারের অনেকগুলো সংস্থার সংশ্লিষ্টতা আছে। যদি এমন কোনো কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়, যেখানে আমাদের সহায়তার প্রয়োজন, আমরা সহায়তা করতে প্রস্তুত আছি। আমরাও মনে করি এটার স্থায়ী একটা সমাধান দরকার।
কর্নেল ইন্তেখাব হায়দার খান আরও জানান, সেনাবাহিনী দেশের বিভিন্ন শিল্পাঞ্চলে ৬০০-এর অধিক অস্থিতিশীল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছে এবং কারখানাগুলোকে চালু রাখার জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বিজিএমইএসহ সংশ্লিষ্ট সকলের সমন্বয়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, যার ফলে বর্তমানে দেশের ২০৮৯টি গার্মেন্টস কারখানার মধ্যে প্রায় সবগুলোই এ মুহূর্তে চালু রয়েছে। এর পাশাপাশি ৭০০-এর অধিক বিভিন্ন ধরণের বিকৃঙ্খল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেছে, যার মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সংক্রান্ত ঘটনা ছিল ১৪১টি, সরকারি সংস্থা/অফিস সংক্রান্ত ৮৬টি, রাজনৈতিক কোন্দল ৯৮টি এবং অন্যান্য বিভিন্ন ধরনের ঘটনা ৩৮৮টি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সময়মতো কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণের কারণে অনেক অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এবং বহু মানুষের জান ও মালের ক্ষতি প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়েছে। বিদেশি কূটনীতিক ব্যক্তিবর্গ ও দূতাবাসগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য কূটনৈতিক এলাকায় স্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে এবং সার্বক্ষণিক সেনা টহলের মাধ্যমে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হচ্ছে। এছাড়া সেনাবাহিনী অবৈধ মাদকদ্রব্য উদ্ধার ও মাদক ব্যবসায়ীদের গ্রেপ্তার করা, বিভিন্ন অপরাধী ও নাশকতামূলক কাজের ইন্ধনদাতা ও পরিকল্পনাকারীদের গ্রেপ্তার করার কাজেও সম্পৃক্ত রয়েছে। যৌথ অভিযানে ৭০০ জনের অধিক মাদক ব্যবসায়ী অথবা মাদকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং বিপুল পরিমাণ ইয়াবা, ফেনসিডিল, মদ, গাঁজাসহ অন্যান্য অবৈধ মাদকদ্রব্য উদ্ধার করা হয়েছে।
এই সেনা কর্মকর্তা আরও জানান, গত আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে দেশের পূর্বাঞ্চল ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল ভয়াবহ আকস্মিক বন্যায় আক্রান্ত হলে সেনাবাহিনীর সদস্যরা স্থানীয় প্রশাসনের অনুরোধে প্রত্যন্ত এলাকাসহ সকল দুর্গত এলাকায় স্থানীয় প্রশাসন ও স্বেচ্ছাসেবকদের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে বিপদগ্রস্থ মানুষদের উদ্ধার, ত্রাণ বিতরণ এবং জরুরি চিকিৎসাসেবা প্রদান করে। এছাড়া দুর্গত এলাকায় মোবাইল সংযোগ পুনঃস্থাপনে সহায়তা, মহাসড়কে ট্রাফিক চলমান রাখা, ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ ও সড়ক সংস্কার, এবং বন্যা পরবর্তী পুনর্বাসনেও সেনাবাহিনী সক্রিয় ভূমিকা রাখে, যা এখনো চলমান রয়েছে। এসময় বন্যা দুর্গতদের সাহায্যের জন্য দেশের আপামর জনসাধারণের অংশগ্রহণ ও সহমর্মিতা ছিল সত্যিই দৃষ্টান্তমূলক। পরবর্তীতে অক্টোবর মাসে দেশের মধ্য-উত্তরাঞ্চলের চারটি জেলা বন্যা আক্রান্ত হলে একইভাবে সেনাবাহিনীর সদস্যরা স্থানীয় প্রশাসনের অনুরোধে উদ্ধার, ত্রাণ বিতরণ এবং জরুরি চিকিৎসাসেবা কাজে অংশগ্রহণ করে। দায়িত্ব পালনের সুবিধার্থে গত ১৭ সেপ্টেম্বর সশস্ত্র বাহিনীর ক্যাপ্টেন ও তদূর্ধ্ব পদবীর অফিসারদের সরকার কর্তৃক নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেওয়া হয়, যা এখনো চলমান রয়েছে। ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা যাতে সুষ্ঠুভাবে এবং নিয়মতান্ত্রিকভাবে প্রয়োগ করা হয়, তার জন্য সেনাবাহিনীর সকল পর্যায়ে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এই বিশেষ ক্ষমতার কার্যকরী প্রয়োগের কারণে ইতোমধ্যে বেশ কিছু সঙ্কটপূর্ণ পরিস্থিতি যেমন চিহ্নিত অপরাধীদের গ্রেফতার, শিল্পাঞ্চলের বিশৃঙ্খলা, রাস্তা অবরোধ ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণসহ সার্বিক আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়েছে, সেনাবাহিনী প্রধানের দিকনির্দেশনাকে অনুসরণ করে এ মুহূর্তে দেশের ৬২টি জেলায় সেনাসদস্যরা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় অন্তর্বর্তী সরকার, সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়সমূহ, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, স্থানীয় প্রশাসন, বিভিন্ন সংস্থা, গণমাধ্যম এবং স্থানীয় জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে সার্বক্ষণিক সক্রিয়ভাবে দায়িত্ব পালন করছে। সামনের দিনগুলোতে এই সমন্বয় ও পারস্পরিক সহযোগিতা আরও বৃদ্ধি করে কর্মধারা অব্যাহত রাখতে সেনাবাহিনী অঙ্গীকারাবদ্ধ।
ভোরের আকাশ/রন
মন্তব্য