তথ্য গোপন করে চীন থেকে আমদানি করে বাংলাদেশে আনা হয় রিকন্ডিশন (ব্যবহৃত) এসির কম্প্রেসার। পরে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে নতুন পণ্য হিসেবে তা খালাস করা হয়। শুধু গাড়ি ছাড়া অন্য কোনো ধরনের ইলেকট্রনিক্স পণ্য পুরনো বা রিকন্ডিশন আমদানি করা যাবে না এমন নীতিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে এভাবেই দেশের বাজারে প্রবেশ করে এসির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পার্টস ‘কম্প্রেসার’-এর ডুপ্লিকেট ভার্সন ‘রিকন্ডিশন কম্প্রেসার’। এখানেই শেষ নয়। এরপর এসব ব্যবহৃত কম্প্রেসার নিয়ে আসা হয় ঢাকায়। গোডাউনে রেখে দ্বিতীয় দফায় চলে জালিয়াতি। চীনে আগে ব্যবহৃত এসব কম্প্রেসারে লাগিয়ে দেওয়া হয় নামি-দামি বিভিন্ন ব্র্যান্ড ও কোম্পানির স্টিকার, সিল ও ট্যাগ। ক্রেতারা প্রয়োজন অনুসারে সে সব ব্যবহৃত ও নকল কম্প্রেসারই আসল দাম দিয়ে কিনে লাগিয়ে নেন নিজের এসিতে। ফলে তৈরি হয় মারাত্মক ঝুঁকি। আরাম আর শান্তির জন্য হাজার হাজার টাকা খরচ করে কেনা শখের এসিতেই যে পুরো পরিবারের মৃত্যুর পরোয়ানা জারি হতে পারে, সেটি হয়তো ওই ব্যক্তির ধারণাতে নেই।
আশঙ্কার কথা হচ্ছে, দীর্ঘদিন ধরে অসাধু সিন্ডিকেটের হাত ধরে এসির নকল কম্প্রেসার দেশের বাজারে বিক্রি হচ্ছে। এখন পর্যন্ত ঠিক কত হাজার নকল কম্প্রেসার মানুষের এসিতে টাইম বোমা হয়ে অবস্থান করছে, তার কোনো হিসাব নেই। এসব কাজের সঙ্গে জড়িয়ে আছে প্রায় ১৫টির বেশি আমদানিকারক ও বিক্রয় প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিরা। তারা খোদ রাজধানীতে প্রশাসনের নাকের ডগায় বসে দিনের পর দিন এমন মারাত্মক অপরাধ করে আসছেন। নজরদারির অভাব আর ম্যানেজ করে নেওয়ার অদৃশ্য ক্ষমতায় তারা হয়েছেন বেপরোয়া। বড় কথা হচ্ছে, এসি এখন আর বিলাসী পণ্য নয়। জলবায়ুগত পরিবর্তন আর তাপমাত্রার অস্বাভাবিক বৃদ্ধি উচ্চবিত্তের পাশাপাশি মধ্যবিত্তের কাছেও এসিকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য হিসেবে পরিচিত করিয়েছে। ফলে, গত কয়েক বছর ধরে এসির চাহিদা বেড়েছে কয়েক গুণ। বিশেষ করে চলতি বছরের তাপপ্রবাহের সময় এসির বুকিং দিতে শো-রুমগুলোতে মানুষজনকে সিরিয়াল দিয়েও দাঁড়াতে দেখা গেছে। তবে, এমন অবস্থার বিপরীত প্রতিক্রিয়াও রয়েছে। বিগত বছরগুলোতে দেশে আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে এসির বিস্ফোরণের ঘটনা। শান্তি ও স্বস্তির জন্য লাগানো যন্ত্রটিই মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছেÑ এটি বিশ্বাস করতেও চান না অনেকে। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, এসির নকল কম্প্রেসারই বিস্ফোরণ ও দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে অন্যতম ভূমিকা পালন করছে।
অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে এসির রিকন্ডিশন (সেকেন্ড হ্যান্ড) কম্প্রেসার আমদানিকারক এবং তাতে নামি-দামি কোম্পানির ট্যাগ লাগিয়ে নকল কম্প্রেসার বিক্রির মূলহোতাদের পরিচয়। অনুসন্ধান বলছে, রাজধানী ঢাকার অন্তত ১৬টি আমদানিকারক ও হোলসেলার প্রতিষ্ঠান সরাসরি এসব কাজের সঙ্গে জড়িত। প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছেÑ ওয়ারী এলাকার জয়কালী মন্দির রোড ও বিসিসি রোডের রুবেল রেফ্রিজারেশন, এমএআর ট্রেডার্স, সেজান এন্টারপ্রাইজ, মাসুম রেফ্রিজারেশন, বিএস এন্টারপ্রাইজ, রাফি এন্টারপ্রাইজ, ভাই ভাই রেফ্রিজারেশন, রুহুল আমিন রেফ্রিজারেশন, বিসমিল্লাহ রেফ্রিজারেশন, খোকন রেফ্রিজারেশন, মুনিয়া রেফ্রিজারেশন, মারুফ রেফ্রিজারেশন, মেসার্স নাঈম এন্টারপ্রাইজ, নয়াপল্টন এলাকার সজীব এন্টারপ্রাইজ, টয়েনবি সার্কুলার রোডের রাফি ইন্টারন্যাশনাল ও উত্তরার একিউরেট ইঞ্জিনিয়ারিং। এ ছাড়াও নামসর্বস্ব কিছু প্রতিষ্ঠান এসব কারবারে জড়িত। প্রতিষ্ঠানগুলো রিকন্ডিশন কম্প্রেসার আমদানির নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে মিথ্যা তথ্য দিয়ে চীন থেকে দেশে নিয়ে আসছে এসব ব্যবহৃত কম্প্রেসার। যা পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন ধাপ অবলম্বন করে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে ঢাকাসহ সারা দেশে। আর দুর্ঘটনার মূল মাস্টারমাইন্ড হিসেবে ব্যবহৃত কম্প্রেসারগুলো ভূমিকা রাখছে। একই সঙ্গে গ্রাহকের আর্থিক ক্ষতি তো হচ্ছেই। জানা গেছে, সারা দেশেই রয়েছে তাদের ডিলার। বিভিন্ন শহর, জেলা, থানা এমনকি ইউনিয়ন পর্যায়ে তাদের এসব নকল কম্প্রেসার সাপ্লাই দেওয়া হচ্ছে। কয়েক বছর আগে রাজধানীর পল্টন ও ওয়ারী থানায় নকল কম্প্রেসার বিক্রির অভিযোগে এখানকার বেশ কয়েকটি কোম্পানির নামে মামলাও হয়েছিল। তবে, সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যের কাছে মামলা ধোপে টেকেনি। দেশে ব্যবহৃত কম্প্রেসারগুলো চায়না থেকেই সম্পূর্ণ প্রস্তুত হয়ে আসে। দেশের আমদানিকারকদের শর্ত অনুযায়ী কোথাও লেখা থাকে না ‘রিকন্ডিশন’। ফলে বন্দর কর্তৃপক্ষের নজর এড়াতে এটি বড় আশীর্বাদ হিসেবে ভূমিকা পালন করে। নতুন প্যাকেটে আমদানি করা পুরনো এসব কম্প্রেসারে শুধুমাত্র মডেল নম্বর লেখা থাকে। পরবর্তী সময়ে বন্দর থেকে পণ্য খালাস হয়ে ঢাকায় আসার পর গোডাউনে সম্পন্ন করা হয় বাকি কাজ। সেখানেই ক্রেতার চাহিদা ও বাজারদর অনুযায়ী বিভিন্ন ব্র্যান্ডের স্টিকার লাগানো হয়। এ ক্ষেত্রে প্রাধান্য পায় এলজি, প্যানাসনিক, হিতাচি, এমারসনসহ দেশীয় বিভিন্ন ব্র্যান্ড। তবে, এগুলোর মধ্যে চাহিদা বেশি থাকায় এলজি ও এমারসন কোম্পানির কম্প্রেসার সবচেয়ে বেশি নকল করা হয় বলেও অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে। এ ছাড়া ব্যবহৃত কম্প্রেসারগুলো চীনে থেকে আসার আগে ওয়ার্কশপে রি-ওয়েল্ডিং (দুই খণ্ড ধাতুকে উত্তাপের সাহায্যে গলিত বা অর্ধগলিত অবস্থায় এনে চাপে বা বিনা চাপে স্থায়ীভাবে জোড়া দেওয়ার প্রণালীকে ওয়েল্ডিং বলে) করা হয়। ফ্যাক্টরিতে তৈরি হওয়া এসব কম্প্রেসার চীনে একবার ব্যবহৃত হওয়ার পর ওয়ার্কশপে কেটে ঠিক করে ফের জোড়া লাগানো হয়। ফলে এর গুণগত মান মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়। যা পরবর্তী সময়ে বিস্ফোরণের ঝুঁকি তৈরি করে।
দীর্ঘ অনুসন্ধানে জানা গেছে, নকল কম্প্রেসার ক্রেতাকে গছিয়ে দিতে অসাধু চক্র অত্যন্ত চতুরতার আশ্রয় নেন। তারা পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করে অতি সন্তর্পণে। এ ক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়। এর মধ্যে প্রথম পদ্ধতি হিসেবে বাজারে বিদ্যমান আসল (অরিজিনাল) কম্প্রেসারের দামের চেয়ে ওই একই কম্প্রেসার (নকল) কম দাম বিক্রির টোপ ফেলা হয় ক্রেতাদের কাছে। আর কিছু টাকা বাঁচাতে গিয়ে ক্রেতারাও সেই ফাঁদে পা দেন। দ্বিতীয় পদ্ধতি হিসেবে ক্রেতার অজ্ঞতাকে বেছে নেয় অসাধু সিন্ডিকেট চক্র। কারণ, সাধারণ ক্রেতাদের মধ্যে শতকরা ৯৫ শতাংশেরই অরিজিনাল ও ডুপ্লিকেট কম্প্রেসার বাইরে থেকে দেখে শনাক্ত করার সক্ষমতা নেই। এ সুযোগ অসাধু চক্র লুফে নেয়। ব্র্যান্ডের কম্প্রেসারের সমান দাম নিয়েও ক্রেতাকে তারা গছিয়ে দেন নকল কম্প্রেসার। তৃতীয় পদ্ধতি হিসেবে এসব নকল কম্প্রেসারের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডররা ভূমিকা পালন করেন। বিভিন্ন নামি-দামি কোম্পানি, গার্মেন্টস, বাসাবাড়ির টেকনিক্যাল দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরা মোটা অঙ্কেকের কমিশনের বিনিময়ে ক্রেতা ও অসাধু কোম্পানির মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে দেন। আবার অনেক এসির টেকনিশিয়ানরাও এ কাজ করেন। ক্রেতার বিশ্বাসযোগ্যতাকে পুঁজি করে নষ্ট এসি ঠিক করার সময় অরিজিনাল কম্প্রেসারের টাকা নিয়ে লাগিয়ে দেন কম দামের নকল কম্প্রেসার। এভাবেই দিনের পর দিন ছড়িয়ে পড়েছে হাজার হাজার নকল কম্প্রেসার। শুধু রাজধানী ঢাকা নয় বরং সারা দেশেই নকল কম্প্রেসারের ছয়লাব হয়েছে।
জেনেশুনে ও মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে কেন গ্রাহকের হাতে ব্যবহৃত ও নকল এসির কম্প্রেসার তুলে দেওয়া হচ্ছে- এমন প্রশ্নের উত্তর মিলেছে অনুসন্ধানে। মূলত, নকল কম্প্রেসার বিক্রির পেছনে মোটা অঙ্কেকের লাভের লোভে পড়েছেন আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীরা। ফলে সজ্ঞানে ক্রেতার হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে মরণ বোমা। সাধারণত একটি নতুন ৪-৫ টনের কম্প্রেসার আমদানি করতে কোম্পানি ভেদে ৩৮০-৪০০ ডলার প্রয়োজন হয়। যার পরিমাণ বাংলাদেশি মুদ্রায় ৪৫-৪৮ হাজার টাকা। এর বিপরীতে মাত্র ৭০-১০০ ডলারের মধ্যেই চীন থেকে ব্যবহৃত কম্প্রেসার আমদানি করা যায়। যার পরিমাণ বাংলাদেশি মুদ্রায় মাত্র ৯-১২ হাজার টাকা। আমদানি খরচ, বন্দরের শুল্ক, পরিবহন খরচসহ সবমিলিয়ে নতুন কম্প্রেসার শো-রুম পর্যন্ত আনতে খরচ হয় ৫৩-৫৪ হাজার টাকা। যা পরবর্তীতে বিক্রি করা হয় ৫৫-৬০ হাজার টাকায়। আর পুরাতন একটি কম্প্রেসারে আমদানি খরচ, বন্দরের শুল্ক, পরিবহন খরচসহ সবমিলিয়ে শো-রুম পর্যন্ত আনতে খরচ হয় মাত্র ১২-১৫ হাজার টাকা। যা পরবর্তী সময়ে নতুন হিসেবে বিক্রি করা হয় ৪৫-৬০ হাজার টাকা পর্যন্ত। এ ক্ষেত্রে ক্রেতা বুঝে দামদর ঠিক করেন তারা। মূলত, অল্প খরচে অধিক পরিমাণ লাভের এ মধু পান করতেই অসাধু আমদানিকারকরা দিনের পর দিন এমন কর্মকাণ্ড চালিয়ে আসছেন। ওই অসাধু সিন্ডিকেট প্রায় ১৫ বছর ধরে গোপনে ও প্রকাশ্যে এসব কাজ করছেন। এ সময়ে তারা কত হাজার কম্প্রেসার বিক্রি করেছেন, তার কোনো হিসাব নেই। বিষয়টি নিয়ে নাম-পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে একজন এসির টেকনিশিয়ান বলেন, আমরা যখন বাসাবাড়ি, মসজিদ, ফ্যাক্টরিতে এসির কাজ করতে যাই তখন দেখেই বুঝতে পারি কোনটা আসল কম্প্রেসার আর কোনটা নকল কম্প্রেসার। গত কয়েক বছর ধরে ঘন ঘন কম্প্রেসার নষ্ট হওয়ার সমস্যাই বেশি দেখেছি। দেশের হাতে গোনা কয়েকটি মাত্র প্রতিষ্ঠান ব্র্যান্ড নিউ কম্প্রেসার আমদানি করে। তবে, সেগুলোর দাম বেশি থাকায় ক্রেতারা কিনতে চান না। তারা কম দাম পেয়ে নকল কম্প্রেসার লাগিয়ে নেন। এ ক্ষেত্রে আবার অনেক টেকনিশিয়ানরাও কমিশনের লোভে এজেন্ট হিসেবে এ কারবার করেন। যেখানে একটি অরিজিনাল কম্প্রেসার চার থেকে ছয় বছর পর্যন্ত সার্ভিস দেয় সেখানে নকল কম্প্রেসারগুলো এক থেকে দেড় বছরের মধ্যেই নষ্ট হয়ে যায়। আর বিস্ফোরণের ঝুঁকি তো রয়েছে। আমার বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, রিপেয়ার এসির প্রায় ৯০ শতাংশ কম্প্রেসারই এখন নকল লাগানো আছে।
গত কয়েক বছর ধরে এসির চাহিদা যেমন বেড়েছে তেমনি বেড়েছে এসি সংক্রান্ত বিভিন্ন দুর্ঘটনাও। সারা দেশে এসি বিস্ফোরণে সংখ্যা ও মৃত্যুর ঘটনা নেহায়েত কম নয়। চলতি বছরের ১৫ জুন রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় এসি বিস্ফোরণে একই পরিবারের চারজন মারা যান। ১৭ এপ্রিল সাভারের একটি কাপড়ের দোকানে এসি বিস্ফোরণের ঘটনায় দগ্ধ হয়ে আমজাদ হোসেন নামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়। ২৮ মার্চ বরিশাল নগরীর চকবাজার এবায়দুল্লাহ জামে মসজিদে জোহরের নামাজ চলাকালীন এসি বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। তবে, সৌভাগ্যক্রমে কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।
গত বছরের (২০২৩ সাল) ৪ মার্চ রাজধানীর গুলশান নিকেতন এলাকায় একটি বাসার এসি বিস্ফোরিত হয়ে বেশ কয়েকজন দগ্ধ হন। এর আগের বছর অর্থাৎ ২০২২ সালের ২১ ডিসেম্বর রাজধানীর মিরপুর ১৩ নম্বর সেকশনে এসি বিস্ফোরণের ঘটনায় হাজেরা বেগম ও গৃহকর্মী আরিয়ান নামের দুজন মারা যান। ৭ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জে কবি ও গায়ক এস এ শামীম চৌধুরীর বাড়ির নিচ তলার একটি রুমে স্থাপিত রেকর্ডিং স্টুডিওতে গান রেকর্ডিংয়ের সময় এসির বিস্ফোরণ হয়। ওই বছরের ২৫ জুলাই গাজীপুর সদর উপজেলার হোতাপাড়া বোরকান এলাকার এলিগ্যান্ট ক্যাসিওপিয়া ফ্যাশন লিমিটেডে এসির কম্প্রেসার বিস্ফোরণে দুজন নিহত হন। তারা দুজনই ছিলেন এসি মেরামতকারী। ১৯ জুন রাজধানীর নিকেতনে এসি বিস্ফোরণে দগ্ধ হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মাশরুর আহমেদ মারা যান।
২০২১ সালের ১৩ জানুয়ারি গুলশান-২ নম্বরের ৯৩ নম্বর রোড এলাকায় ১৪ তলা ভবনের নিচ তলায় এসি বিস্ফোরণের ঘটনায় ঘটে। তবে, স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ এসি দুর্ঘটনা ঘটে ২০২০ সালে। ওই বছরের ৪ সেপ্টেম্বর এশার নামাজ আদায়ের সময় নারায়ণগঞ্জে মসজিদে এসির বিস্ফোরণ হয়। এতে প্রাণ হারান ২৪ জন মানুষ।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের বার্ষিক প্রতিবেদনেও দেখা গেছে এসি সংক্রান্ত দুর্ঘটনা বাড়ার প্রবণতা। প্রতিবেদনটি বলছে, ২০২৩ সালে এসি থেকে সংঘটিত আগুনের ঘটনা ঘটেছে ৮৬টি, ২০২২ সালে ঘটেছে ৪৮টি, ২০২১ সালে ৩৯টি, ২০২০ সালে ৩২টি। অর্থাৎ কয়েক বছর ধরে এর পরিমাণ বেড়ে চলেছে। কিন্তু আশ্চর্যজনক বিষয় হচ্ছে, এখন পর্যন্ত এসব দুর্ঘটনার তদন্ত আলোর মুখ দেখেনি কিংবা তদন্ত প্রতিবেদন ফলাও করে প্রকাশ করা হয়নি। অথবা জনগণকে সচেতন করতে নেওয়া হয়নি কোনো ব্যবস্থা।
মানহীন, নকল ও কম দামি পণ্য ব্যবহার করার ফলে অগ্নিদুর্ঘটনার ঝুঁকি বেড়ে যায় বলে মন্তব্য করেছেন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের সিনিয়র স্টাফ অফিসার মো. শাহজাহান শিকদার। তিনি বলেন, আমাদের পেশাগত অভিজ্ঞতা হচ্ছে, বৈদ্যুতিক গোলযোগের কারণে এ দুর্ঘটনাগুলো বেশি ঘটে। আর মানুষের মধ্যে মানহীন সরঞ্জাম ব্যবহারের একটি প্রবণতা রয়েছে। তারা বৈদ্যুতিক লাইন স্থাপন এবং এসির ক্ষেত্রে বিভিন্ন মানহীন সরঞ্জাম ব্যবহার করে থাকেন। যা পরবর্তী সময়ে মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থা তৈরি করে। তিনি বলেন, আবার অনেক সময় দেখা যায় দীর্ঘদিন ধরে একই পণ্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই ব্যবহার করা হচ্ছে। এটিও ঠিক নয়। দুর্ঘটনা রোধে ইলেকট্রনিক্স পণ্য নিয়মিত পরীক্ষা করা উচিত। আপনাদের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের প্রতি আমাদের পরামর্শ থাকবে, সবসময় সিঙ্গেল লাইন ডায়াগ্রাম করে বিদ্যুতের সংযোগ নিতে হবে। মানহীন সরঞ্জাম ব্যবহার থেকে বিরত থাকতে হবে। কারণ, একটি প্রতিষ্ঠান যখন ক্ষতিগ্রস্ত হয় তার সব বিনিয়োগ পুড়ে যায়। মানহীন সরঞ্জাম ব্যবহারের কারণে তাৎক্ষণিকভাবে পাঁচ টাকার লাভ হলেও পরবর্তীতে পাঁচ লাখ টাকা ক্ষতির ঝুঁকি তৈরি হয়।
রিকন্ডিশন কম্প্রেসার চীন থেকে আমদানির বিষয়টি পুরোপুরি অস্বীকার করেছেন অধিকাংশ আমদানিকারক। তারা বলছেন, যথাযথ প্রক্রিয়া অবলম্বন করেই চীন থেকে নতুন কম্প্রেসার আমদানি করা হচ্ছে। অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে রুবেল রেফ্রিজারেশনের মালিক রুবেল বলেন, এগুলা আমি বলতে পারব না। আমরা সব ইমপোর্ট (আমদানি) করি কোম্পানি থেকে। আমাদের সব নিউ (নতুন) কম্প্রেসার। আমরা এলসির মাধ্যমে কিনে আনি। আমদানির নীতি অনুযায়ী রিকন্ডিশন কম্প্রেসার আনা বৈধ নয়। তারপরও কীভাবে আপনারা এটি করছেন- জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা ওখান থেকে নতুন কিনে আনি। চীনে ওইগুলা ব্যবহৃত হয় কি না, তা আমি বলতে পারব না। আমরা অর্ডার করি কোম্পানিতে। সেখান থেকেই সাপ্লাই দেওয়া হয়। বিসমিল্লাহ রেফ্রিজারেশনের মালিক আব্দুল হান্নান বলেন, আমরা তো মাল (কম্প্রেসার) হাওয়া দিয়ে আনি না। ট্যাক্স দিয়ে আনি। আর জিনিসটা ভালো নাকি মন্দ, সেটা তো পোর্টেই দেখার দায়িত্ব। কথা হলো, আমি আমদানি করে এনেছি। যদি জিনিসটা খারাপ হয় তাহলে তারা কেন ছাড় দিল? তাদের খোঁজ নেন। এ দেশে অনেকগুলা ইম্পোর্টার আছে। তারা যেভাবে মাল আনে আমিও সেভাবে আনি।
এ বিষয়ে জানতে কাস্টম হাউস, চট্টগ্রামের কমিশনার মো. জাকির হোসেনের সঙ্গে টেলিফোনে এবং এডিশনাল কমিশনার মোহাম্মদ তফছির উদ্দিন ভূঁঞার সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়েছে। তারাও কেউ ফোন রিসিভ করেননি। আমদানি ও রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের প্রধান নিয়ন্ত্রক (অতিরিক্ত সচিব) শেখ রফিকুল ইসলাম বলেন, রিকন্ডিশন কোনো কিছুই বাংলাদেশে আনার বিষয়টি এখতিয়ারভুক্ত নয়। তারপরও এটি এনবিআর ও কাস্টমস বলতে পারবে। যেহেতু এমন অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে আমরা বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখব।
বাংলাদেশ রেফ্রিজারেশন অ্যান্ড এয়ারকন্ডিশনিং মালিক শ্রমিক কল্যাণ পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম রিকন্ডিশন কম্প্রেসারের ব্যাপারে বলেন, বিষয়টি আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়নি। যদি তথ্য-প্রমাণসহ এমন কিছু পাওয়া যায় তাহলে এর বিরুদ্ধে আমরা যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করব। মানুষের জন্য যা ক্ষতিকর সেটিতে আমরা কখনোই সায় দেব না। বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে বাংলাদেশ রেফ্রিজারেশন অ্যান্ড এয়ারকন্ডিশনিং মার্চেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের (ব্রামা) ২০২৩-২৫ সেশনের সভাপতি আসাদুজ্জামানের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তা বন্ধ পাওয়া যায়। অপরদিকে, সংগঠনটির ২০২১-২৩ সেশনের সভাপতি আবুল হোসেনের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি হাসপাতালে ভর্তি আছেন বলে জানান।
ভোরের আকাশ/মি
মন্তব্য