দুই কোটি মানুষের শহর ঢাকায় প্রতিদিন বিভিন্ন কারণে ঘটছে সড়ক দুর্ঘটনা। এতে মারা যাচ্ছেন অনেকে, আহতরা কর্মহীন হয়ে হচ্ছেন পরিবারের বোঝা। মানুষের তুলনায় এ শহরে রাস্তা কম। একটি আদর্শ শহরে ২৫ শতাংশ রাস্তা থাকার কথা, কিন্তু ঢাকায় রয়েছে মাত্র ৮ শতাংশ। যেটা যানজট ও দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে ঢাকা রোড ট্রাফিক সেফটি প্রজেক্টের (ডিআরএসপি) উদ্যোগে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) অর্থায়নে সড়ক নিরাপত্তার কার্যক্রম শুরু হয়। জাইকা বিশেষজ্ঞ দলের (জেইটি) সমন্বয়ে ঢাকার সড়ক দুর্ঘটনা রোধে একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। প্রকল্পের আওতায় তৈরি করা হয়েছে ডিএমপির ডাটাবেজ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস অব রোড ক্র্যাশ (DARC) ‘ডার্ক’ নামে একটি সফটওয়্যার। সফটওয়্যারটিতে মূলত তথ্য দেবেন ট্রাফিক বিভাগের সার্জেন্টরা। তারা দুর্ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে এই অ্যাপসে দুর্ঘটনার বিভিন্ন তথ্য ইনপুট দেবেন। সেসব তথ্য ডিএমপির সদর দপ্তরে জমা হবে এবং ভবিষ্যতে কীভাবে সড়ক দুর্ঘটনা শূন্যের কোঠায় নামানো যায়- সে বিষয়ে ব্যবস্থা নেবেন ডিএমপির ঊর্ধ্বতনরা।
এ সফটওয়্যার বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন ডিএমপির ৮৫০ ডিসি, এডিসি, এসি, টিআই ও সার্জেন্ট। ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর ডিএমপিতে রদবদলের কারণে প্রশিক্ষণ নেওয়া বেশ কয়েকজন সার্জেন্ট বদলি হয়েছেন। তবে ডিএমপিতে নতুন যারা যোগদান করেছেন তাদের ডার্ক সফটওয়্যারের ওপর প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে শিগগির। ঢাকা শহরে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে ৬৭টি ফিল্ডের একটি ফরমে দুর্ঘটনার তথ্য পূরণ করতো পুলিশ। ফরমটি পূরণের পর থানায় রেকর্ড হতো। বাস্তবতা হলো যদি কোনো দুর্ঘটনার পর কোনো এক পক্ষ থানায় মামলা বা জিডি করে তখনই শুধু ৬৭টি ফিল্ডের ফরম পূরণ করে থানায় জমা রাখা হতো। অন্যথায় দুর্ঘটনার শিকার উভয় পক্ষ যদি মীমাংসা করতো তবে ফরমটি আর পূরণ করতো না পুলিশ। সড়কে যতগুলো দুর্ঘটনা ঘটে তার বেশিরভাগই থানা-পুলিশের ঝামেলা এড়াতে উভয়পক্ষ মীমাংসা করে ফেলে। এতে বাস্তবতা হলো দুর্ঘটনার অনেক তথ্যই উঠে আসে না।
ডিএমপি বলছে, ফরমটি ছিল সম্পূর্ণই কাগজে-কলমের, অর্থাৎ অ্যানালগ। এক মাস পর থানা থেকে ডিএমপি সদর দপ্তরের অপারেশন্স বিভাগে জমা হতো দুর্ঘটনার ওই ফরমের তথ্য। পরবর্তীসময়ে একটি পুরাতন অফলাইন সফটওয়্যারের মাধ্যমে দুর্ঘটনার তথ্যগুলো রেকর্ড করা হতো। হাতে লেখা ফরমে দুর্ঘটনার একটি বড় অংশের তথ্য রেকর্ড থাকতো না। আবার যে রেকর্ডগুলো থানা থেকে আসতো সেগুলো ত্রুটিপূর্ণ থাকতো। এজন্য ডিআরএসসি অনলাইন বেসিসে একটি সফটওয়্যার তৈরি করে। যার নাম দেওয়া হয় ‘ডার্ক’ সফটওয়্যার। ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের ‘ড্রাইভার’ সফটওয়্যারের আদলে প্রয়োজন অনুসারে ‘ডার্ক’ সফটওয়্যার তৈরি করা হয়। ডিএমপিতে ৯০০ ট্রাফিক কর্মকর্তাকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। প্রশিক্ষণ শেষে ডিএমপির ৮ বিভাগের সার্জেন্টরা মাঠে কাজ শুরু করেছেন এবং তারা ডাটা ইনপুট দিচ্ছেন।
দুর্ঘটনার ফলে থানায় যে মামলাগুলো হচ্ছে, সেই তথ্য এই সফটওয়্যারে ইনপুট দেওয়া হবে। একই সঙ্গে মামলা না হলেও যে কোনো দুর্ঘটনার তথ্য সফটওয়্যারটিতে ইনপুট দেবে পুলিশ। সফটওয়্যারটিতে আটটি ক্যাটাগরি রয়েছে। সফটওয়্যারের মূল উদ্দেশ্য- যে কোনো সড়ক দুর্ঘটনা ডাটাবেজের মাধ্যমে নিয়ে আসা এবং প্রকৃতপক্ষে ঢাকা শহরের সামগ্রিক দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকাগুলো চিহ্নিত করা। আগে যে ফরম ছিল সেখানে দুর্ঘটনার প্রকৃত স্থান চিহ্নিত করা যেত না। বর্তমানে সফটওয়্যারটিতে পিন-পয়েন্ট লোকেশনের জন্য জিপিএস ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এতে প্রকৃত লোকেশন পাওয়া সম্ভব। দুর্ঘটনার সময়, তারিখ, রিপোর্টটি কোন অফিসার ইনপুট দিচ্ছেন তার তথ্য, জিপিএসে লোকেশনের তথ্য, হতাহতের তথ্য, দুর্ঘটনার ধরন, দুর্ঘটনার পেছনে সহায়ক কারণ, দুর্ঘটনার সময় আবহাওয়া কেমন ছিল (বৃষ্টি, কুয়াশা কিংবা রোদ) ও দুর্ঘটনার চিত্র। একজন ট্রাফিক সার্জেন্ট খুব সহজেই ছবি তুলে দুর্ঘটনার প্রকৃত চিত্র সফটওয়্যারে ইনপুট দিতে পারবেন। ঢাকার কোনো সড়কে দুর্ঘটনা ঘটলে ওই এলাকার দায়িত্বরত সার্জেন্ট ঘটনাস্থল থেকে সফটওয়্যারে তথ্য দেবেন। প্রথমে তার মোবাইলে থাকা সফটওয়্যারে আইডি ও পাসওয়ার্ড দিয়ে লগইন করবেন। এরপর দুর্ঘটনার সময়, তারিখ, জিপিএস লোকেশন, দুর্ঘটনার কারণ, এমনকি বৃষ্টি, কুয়াশা কিংবা রোদ সেসব তথ্যও একজন সার্জেন্ট খুব সহজেই ছবি তুলে সফটওয়্যারে ইনপুট দিতে পারবেন।
ঢাকা রোড ট্রাফিক সেফটি প্রজেক্টের (ডিআরএসসি) ট্রাফিক ইঞ্জিনিয়ার মো. মাহমুদ হাসান বলেন, দুর্ঘটনার তথ্য সংগ্রহ করা ফরমটি ছিল সম্পূর্ণই কাগজে-কলমে অর্থাৎ অ্যানালগ। হাতে লেখা ফরমে দুর্ঘটনার একটি বড় অংশের তথ্য রেকর্ড থাকতো না। আবার যে রেকর্ডগুলো থানা থেকে আসতো সেগুলো ত্রুটিপূর্ণ থাকতো। এজন্য ডিআরএসসি অনলাইন বেসিসে একটি সফটওয়্যার তৈরি করে। যার নাম দেওয়া হয় ডার্ক সফটওয়্যার। ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের ‘ড্রাইভার সফটওয়্যার’ রয়েছে। সেই সফটওয়্যারের আদলে ডিএমপির প্রয়োজন অনুসারে মোডিফাই করে ডার্ক সফটওয়্যার তৈরি করা হয়। তিনি বলেন, ‘সফটওয়্যারের মূল উদ্দেশ্য- যেকোনো সড়ক দুর্ঘটনা ডাটাবেজের মাধ্যমে নিয়ে আসা এবং প্রকৃতপক্ষে ঢাকা শহরের সামগ্রিক দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকাগুলো চিহ্নিত করা। আগে যে ফরম ছিল সেখানে দুর্ঘটনার প্রকৃত স্থান চিহ্নিত করা যেত না। বর্তমান সফটওয়্যারটিতে পিন পয়েন্ট লোকেশনের জন্য জিপিএস ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এতে প্রকৃত লোকেশন পাওয়া সম্ভব।
ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) খোন্দকার নজমুল হাসান বলেন, সড়ক দুর্ঘটনার কারণে যদি এজাহার দায়ের হয় তবে সেই ডাটাগুলো ডিএমপিতে সংগ্রহ করা হতো। এখন ডার্ক সফটওয়্যারের মাধ্যমে যেকোনো দুর্ঘটনা- মামলা হোক কিংবা না হোক ছবিসহ সব ডাটা সংগ্রহ করা হচ্ছে। এতে দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকা চিহ্নিত করে দুর্ঘটনা রোধের জন্য ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হবে। সমগ্র ঢাকা শহরের তথ্য যখন আমাদের কাছে থাকবে তখন খুব সহজেই বলতে পারবো কোন কোন স্পটে বারবার দুর্ঘটনা ঘটছে। কী কী কারণে ঘটছে এবং কেন ঘটছে এসব তথ্য উঠে আসবে। তিনি বলেন, ডার্ক সফটওয়্যার ব্যবহারের জন্য জাইকার তত্ত্বাবধানে ডিএমপিতে ৮৫০ ট্রাফিক অফিসারকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। প্রশিক্ষণ শেষে ডিএমপির আট বিভাগের সার্জেন্টরা মাঠে কাজ শুরু করেছেন, ডাটা ইনপুট দিচ্ছেন। যেহেতু এটি একটি নতুন সফটওয়্যার তাই কিছুটা হলেও সময় লাগবে।
এ বিষয়ে ডিএমপি কমিশনার মো. মাইনুল হাসান বলেন, ডিএমপির ট্রাফিক সদস্যদের দক্ষতা উন্নয়নে জাইকা আমাদের দেশে কাজ করার পাশাপাশি ডিএমপির অফিসারদেরও তাদের দেশে নিয়ে বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। এই দক্ষতা কাজে লাগিয়ে আমাদের অফিসাররা ঢাকা মহানগর এলাকায় ট্রাফিক ব্যবস্থা উন্নত করতে সক্ষম হবেন। ডার্ক সফটওয়্যারের মাধ্যমে সড়কে দুর্ঘটনার চিত্র তুলে আনা সম্ভব হবে। এতে দুর্ঘটনার কারণ জানা ও সমাধান করা যাবে। তিনি বলেন, যে সফটওয়্যারটি উদ্বোধন করা হয়েছে সেটি একটি অত্যাধুনিক সফটওয়্যার। এই সফটওয়্যার প্রশিক্ষণে যে সব অফিসার ও ফোর্স অংশ নিয়েছে তারা প্রশিক্ষণ শেষে তাদের সেই অভিজ্ঞতা সঠিকভাবে কর্মক্ষেত্রে যদি প্রয়োগ করতে পারেন, তাহলে দুর্ঘটনা কমে আসবে। পাশাপাশি সড়কের শৃঙ্খলা ফিরবে।
ডিআরএসপি প্রজেক্টের জাইকা এক্সপার্ট টিমের তাকেশি মাতসুনুমা বলেন, এই মুহূর্তে ডিএমপির কাছে মহানগর এলাকায় দুর্ঘটনার পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করার মতো পর্যাপ্ত তথ্য নেই। ডার্ক সফটওয়্যারের মাধ্যমে নির্ভুলভাবে তথ্য, লোকেশনসহ দুর্ঘটনার প্রকৃত কারণ সংগ্রহ করা যাবে। এটি ব্ল্যাক স্পট (দুর্ঘটনাপ্রবণ স্থান) শনাক্ত করতে এবং দুর্ঘটনার কারণ বিশ্লেষণ করতে সহায়তা করবে। এরপর ডিএমপি পয়েন্ট ধরে ধরে দুর্ঘটনার বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে পারবে। এক্ষেত্রে রোড ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে সিটি করপোরেশনসহ অন্য সংস্থার সঙ্গে সহযোগিতা করতে পারে।
ভোরের আকাশ/রন
মন্তব্য