-->
ইউরোপের তিন রুটে জাহাজ চলাচল বন্ধ

চট্টগ্রাম-করাচি রুট টিকবে?

ভোরের আকাশ প্রতিবেদক
চট্টগ্রাম-করাচি রুট টিকবে?

বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে বাণিজ্যের যে আকার, তাতে করাচি থেকে চট্টগ্রামে সরাসরি জাহাজ রুট কতটা লাভজনক হবে, সেই প্রশ্নে সামনে আসছে ইউরোপের চালু হওয়ার পর লোকসানের কারণে বন্ধ হয়ে যাওয়া তিনটি রুটের স্মৃতি। করাচি-চট্টগ্রাম বলা হলেও এই রুটটি কেবল দুই বন্দরের মধ্যে নয়। আরও কিছু যুক্ত করা আছে। এর মধ্যে সংযুক্ত আরব আমিরাতও আছে। এই রুটে বাংলাদেশে স্থানীয় প্রতিনিধি হিসেবে যে প্রতিষ্ঠানটি যুক্ত আছে, তার একজন কর্মকর্তাও বলেছেন, কোনো রুট টিকে থাকে সেটি লাভজনক হয় কি না, তার ওপর। বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের যে বৈদেশিক বাণিজ্য, সেটি না বাড়লে ইউরোপের তিন রুটের মতই পরিণতি হতে পারে বলে জাহাজ পরিচালনার সঙ্গে জড়িত একজন ব্যবসায়ী মন্তব্য করেছেন।

বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে বছরে বৈদেশিক বাণিজ্যের পরিমাণ এক বিলিয়ন ডলারও না। গত ৫ অগাস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের তিন মাস পর করাচি থেকে চট্টগ্রাম এই পণ্যবাহী জাহাজ আসার খবরে তোলপাড় হয়েছে এ কারণে যে, স্বাধীনতার ৫৩ বছর পর এটিই প্রথম। এই আলোচনায় সামনে আসছে আড়াই বছর আগে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ইউরোপের তিন গন্তব্য ইতালি, স্পেন ও নেদারল্যান্ডের সঙ্গে সরাসরি কন্টেইনারবাহী জাহাজ চলাচল শুরুর পর দেখা দেওয়া বাস্তবতার কথা। এই উদ্যোগে ইউরোপের বাজারে বাংলাদেশের রপ্তানি বাড়ার সম্ভাবনার কথাও বলাবলি হচ্ছিল। কিন্তু চালুর এক বছরের মাথায় তিনটি রুটেই বন্ধ করে দেয় জাহাজ পরিচালনাকারী সংস্থাগুলো। ২০২২ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ইতালির রেভেনা বন্দরের সঙ্গে সরাসরি জাহাজ চালাচল শুরু হয়। পণ্যের অভাবে ওই বছরের ডিসেম্বরেই বন্ধ করে দেওয়া হয় এই সেবাটি। ওই বছরের মে মাসে স্পেনের বার্সেলোনা ও নেদারল্যান্ডের রটারড্যাম বন্দরের সঙ্গে সরাসরি জাহাজ চলাচল শুরু হয়। ওই বছরের শেষ নাগাদ এই সেবাটিও বন্ধ হয়ে যায়। দুটি রুটে বিদেশি জাহাজ পরিচালনা সংস্থার স্থানীয় সংস্থা ছিল রিলায়েন্স শিপিং অ্যান্ড লজিস্টিকস লিমিটেড।

সংস্থাটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ রাশেদ বলেন, দর পড়ে যাওয়া এবং পর্যাপ্ত কার্গো না মেলায় পরিষেবাগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়। তবে বাংলাদেশ থেকে রপ্তানিমুখী কন্টেইনার শ্রীলংকার কলম্বো বা সিঙ্গাপুরের বন্দর হয়ে ইউরোপের দেশগুলোতে যাচ্ছে। চট্টগ্রাম বন্দর সচিব ওমর ফারুক বলেন, সরাসরি জাহাজ সার্ভিস যে উদ্দেশ্যে চালু হয়েছিল তা সফল হয়নি। শুরুর দিকে কার্গো মিললেও পরবর্তীতে তা না হওয়ায় কার্যকারিতা কমে যায়। বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে চীনের সঙ্গে সরাসারি এবং কোস্টাল শিপিংয়ের আওতায় ভারতের সঙ্গে সরাসরি জাহাজ সেবা চালু রয়েছে।

সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই থেকে পাকিস্তানের করাচি হয়ে চট্টগ্রাম আসে আসা জাহাজটি পানামার পতাকাবাহী ‘ইউয়ান শিয়াং ফা ঝাং‘। শুধু করাচি থেকে চট্টগ্রাম নয়, কয়েকটি বন্দর মিলিয়ে একটি রুট তৈরি করা হয়েছে। পাকিস্তানের সঙ্গে সরাসরি জাহাজ কতটুকু ফলপ্রসূ হবে জানতে চাইলে শিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক খায়রুল আলম সুজন বলেন, ব্যবসায়ীরা সবসময় নতুন নতুন রুট খোঁজে। সে হিসেবে একটি জাহাজ পরিচালনাকারী সংস্থা কয়েকটি গন্তব্য মিলিয়ে একটি রুট তৈরি করেছে। জাহাজটি দুবাই থেকে করাচি হয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে এসেছে। এটি পরীক্ষামূলক সার্ভিস বলে মনে হয়। করাচি থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে পানামার পতাকাবাহী জাহাজ ‘ইউয়ান শিয়াং ফা ঝাং’ আসে ১০ নভেম্বর, পণ্য খালাসের পর সেটি ইন্দোনেশিয়ার বেলোয়ান বন্দরের উদ্দেশে চট্টগ্রাম ত্যাগ করে পরের দিন। এই সার্ভিসের স্থানীয় শিপিং এজেন্ট রিজেন্সা লাইন্সের জ্যেষ্ঠ নির্বাহী পরিচালক আনিস উদ দৌলা বলেন, জাহাজটি করাচি থেকে সরাসরি চট্টগ্রাম বন্দরে এসে ৩৭০ টিইইউ (প্রতিটি ২০ ফুট দৈর্ঘ্যরে) কন্টেইনার খালাস এবং রপ্তানি পণ্যবাহী ৩১৯ টিইইউ কনটেইনার বোঝাই করেছে। সংস্থাটির এক কর্মকর্তা জানান, পাকিস্তানের করাচি থেকে সরাসরি কন্টেইনার নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর এলেও সেটি যাত্রা শুরু করে আরব আমিরাতের দুবাই থেকে। চট্টগ্রাম থেকে সেটি ইন্দোনেশিয়ার বেলোয়ার, মালয়েশিয়ার পোর্ট কেলাং, ভারতের মুন্দ্রা বন্দর হয়ে আবারও দুবাই পৌঁছাবে।

স্থানীয় শিপিং এজেন্ট রিজেন্সা লাইন্স ও বন্দর কর্তৃপক্ষ থেকে জানা গেছে, পাকিস্তান থেকে এ জাহাজে আমদানি করা পণ্যের পরিমাণ ৬ হাজার ৩৪০ টনের মত। এর বেশিরভাগই ভোগ্যপণ্য ও শিল্প-কারখানার জন্য ব্যবহৃত কাঁচামাল। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, সোডিয়াম কার্বনেট বা সোডা অ্যাশ, কাচ তৈরির উপাদান ভাঙা কাচ, ডলোমাইট, চুনাপাথর, ম্যাগনেশিয়াম কার্বনেট, তৈরি পোশাক শিল্পের জন্য কাপড় ও রং, গাড়ির যন্ত্রাংশ ইত্যাদি। পেঁয়াজ ও আলুও আনা হয়েছে। খাতুনগঞ্জের কয়েকজন আমদানিকারক এবং দেশীয় বিভিন্ন শিল্পগ্রুপ এসব পণ্য আমদানি করেছে বলে ঘোষণায় বলা হয়েছে।

পাকিস্তান-চট্টগ্রামের জাহাজ রুট টিকে থাকা নিয়ে যে প্রশ্ন তার প্রধান কারণ দুই দেশের বাণিজ্যের পরিমাণ। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের হিসেব অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে আমদানি হয়েছে ৭৪ কোটি ৪৫ লাখ ডলারের পণ্য। ২০২১-২২ অর্থবছরে এটি ছিল ৮০ কোটি ডলারের মত। দেশটি থেকে বাংলাদেশে মূলত পোশাক শিল্পের কাঁচামাল, চামড়া, ক্লিংকার, ফেব্রিক্স, তুলা, পেঁয়াজ ও আলু আসে। বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানে রপ্তানি হয় চা, তৈরি পোশাক, কাঁচা পাট প্রভৃতি, সব মিলিয়ে এই রপ্তানি মূল্য ৬ কোটি ডলারের কিছু বেশি। জাহাজ পরিচালনার সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ীরা বলছেন, এই পরিমাণ আমদানি রপ্তানিতে সরাসরি জাহাজ পরিষেবা টিকে থাকা কঠিন। তবে অন্তর্বর্তী সরকারের একটি সিদ্ধান্ত পাকিস্তানের জন্য স্বস্তিদায়ক। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে পাকিস্তান থেকে পণ্য এলেও চট্টগ্রাম বন্দরে সেসবের শতভাগ কায়িক পরীক্ষার বাধ্যবাধকতা ছিল। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার জাতীয় রাজস্ব বোর্ড গত ২৯ সেপ্টেম্বর এক আদেশে পাকিস্তান থেকে আসা সকল পণ্যের ওপর শতভাগ কায়িক পরীক্ষার শর্ত তুলে দেয়।

মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে সরকার ক্ষমতায় আসার পর ঢাকায় পাকিস্তানের দূতাবাসের কর্মকর্তারা বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের বার্তা দিয়ে উপদেষ্টাদের সঙ্গে বেশ কিছু বৈঠক করেছেন। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধির কথা বলেছেন, তিনি ’৭১ প্রশ্নটির’ সমাধান চাওয়ার কথা বলেছেন। ঢাকায় পাকিস্তান দূতাবাসের কর্মীরাও অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের বার্তা দিয়েছে।শিপিং এজেন্টস অ্যাসেসিয়েশনের পরিচালক খায়রুল আলম সুজন বলেন, অতীতে পাকিস্তান থেকে সমুদ্রপথে পণ্য আমদানি হলেও তা আসত কলম্বো বন্দর হয়ে। এতে করে সময় কিছুটা বেশি লাগত। আমদানি বেশি হলেও বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানে পণ্য রপ্তানির পরিমাণ অনেক কম। এছাড়া দেশটি থেকে পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে কড়াকড়ি বর্তমান সরকার শিথিল করায় এ উদ্যোগ হয়ত এসেছে। এই জাহাজ সেবার রিজেন্সা লাইন্সের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, এ রুট নিয়মিত হবে কিনা তা নির্ভর করবে মুনাফার ওপর। একটি প্রতিষ্ঠান মাত্র শুরু করেছে। ইউরোপের তিন রুটে সরাসরি জাহাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ার উদাহরণ তিনিও তুলে ধরেন। বলেন, পাঁচ থেকে ছয়টি গন্তব্য মিলিয়ে এই (চট্টগ্রাম-করাচি) রুট। মূলত আর্থিক বিষয়ের উপরই রুটের সফলতা নির্ভর করে।

 

ভোরের আকাশ/রন

মন্তব্য

Beta version