ঘড়ির কাটায় তখন সকাল ৯টা। খাসকামরা থেকে বেরিয়ে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতের এজলাসে আসেন বিচারক। বিচারকের ঠিক সামনেই আসামির কাঠগড়া। কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, সাবেক মন্ত্রী আনিসুল হক, রাশেদ খান মেনন, শাজাহান খান, প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার, জুনায়েদ আহ্মেদ পলক ও উপমন্ত্রী আবদুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকব। তাদের সবার বাঁ-হাতে হাতকড়া। গতকাল বুধবার সকালে আদালতকক্ষে বিচারের কার্যক্রম শুরু হলে উপস্থিত একজন পুলিশ কর্মকর্তা উঁচুস্বরে ডাকেন, ‘জনাব আবদুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকব।’ তখন কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা জ্যাকব ডান হাত উঁচু করেন।
এ সময় রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলিরা আদালতকে বলেন, রাজধানীর রূপনগরে গত ২০ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শামীম হাওলাদার নামের এক ব্যক্তিকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এই হত্যা মামলার একজন আসামি জ্যাকব। এই হত্যার রহস্য উদ্ঘাটনের জন্য তাকে রিমান্ডে নেওয়া জরুরি।
রিমান্ডের বিরোধিতা করেন জ্যাকবের আইনজীবী। এরপর জ্যাকব নিজেই আদালতে কথা বলেন। জ্যাকব বলেন, ‘মাননীয় আদালত, আমি ভোলার চরফ্যাশনের এমপি (সংসদ সদস্য) ছিলাম। আমি কোনো দিন ঢাকায় রাজনীতি করিনি। জন্মের পর কোনো দিন ঢাকার রূপনগরে যাইনি। অথচ আমার বিরুদ্ধে রূপনগর থানায় হত্যা মামলা দেওয়া হয়েছে। এটি হয়রানিমূলক মামলা। আমি আদালতের কাছে ন্যায়বিচার চাই।’ উভয়পক্ষের বক্তব্য শুনে আদালত এই হত্যা মামলায় জ্যাকবকে তিন দিন রিমান্ডে নেওয়ার অনুমতি দেন। এরপর আনিসুলের রিমান্ড শুনানি শুরু হয়। রাষ্ট্রপক্ষ থেকে আদালতকে বলা হয়, রাজধানীর উত্তরার জসীমউদ্দীন সড়কে গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের দিন ফজলুল করিম নামের এক যুবককে গুলি করে হত্যা করা হয়। এই হত্যা মামলার অন্যতম আসামি আনিসুল। এ হত্যার রহস্য উদ্ঘাটনের জন্য তাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা জরুরি। এ সময় রিমান্ডের বিরোধিতা করে আদালতে বক্তব্য রাখেন আনিসুলের আইনজীবী। আদালতকে তিনি বলেন, আনিসুল এ হত্যার ঘটনার সঙ্গে জড়িত নন।
আদালত উভয় পক্ষের বক্তব্য শুনে আনিসুলকে পাঁচ দিন রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার অনুমতি দেন। তখন আনিসুল বিমর্ষ অবস্থায় কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। আনিসুলের বিরুদ্ধে মোট ৫৫টি মামলা হয়েছে। ৭টি মামলায় এখন পর্যন্ত তার মোট ৪৩ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত।
জ্যাকব ও আনিসুলের রিমান্ড শুনানি সময় বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন কাঠগড়ার এক পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তখন একজন পুলিশ কর্মকর্তা ‘জনাব রাশেদ খান মেনন’, ‘জনাব শাজাহান খান’ ও ‘জনাব আনিসুল হক’ বলে ডাক দেন। তারা সাড়া দেন। তখন মোহাম্মদপুর থানার একটি হত্যা মামলায় তাদের গ্রেপ্তার দেখানোর আবেদন মঞ্জুর করেন আদালত।
ঘড়ির কাটায় তখন প্রায় সকাল সাড়ে ৯টা। তখন নারী পুলিশ সদস্যরা সাবেক শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনিকে এজলাসে নিয়ে আসেন। মাথা থেকে হেলমেট খোলার পর দীপু মনির সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলেন আগে থেকে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা সালমান। প্রায় দুই থেকে তিন মিনিট তাদের মধ্যে কথা হয়। এরপর পল্টন থানার একটি হত্যা মামলায় দীপু মনিকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। পরে দীপু মনির সঙ্গে কথা বলেন জুনাইদ, মেনন ও আনিসুল। এরপর মিরপুর থানার একটি হত্যা মামলায় কামাল আহমেদ মজুমদারকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। প্রায় ৪৫ মিনিট শুনানি শেষে বিচারক এজলাস ত্যাগ করেন। শুনানির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আদালতে দেখা যায়, আনিসুল, মেনন, শাজাহানসহ অন্যরা প্রত্যেকে তাদের নিজ নিজ আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলছেন। বিচারক এজলাস ত্যাগ করার পর প্রথমে মেননের মাথায় পুলিশের হেলমেট পরানো হয়। এরপর একে একে আনিসুল, শাজাহান, দীপু মনি ও জুনায়েদের মাথায় হেলমেট পরানো হয়। তারপর তাদের এজলাস কক্ষ থেকে নিয়ে যাওয়া হয় আদালতের হাজতখানায়। গতকাল বুধবার সকাল থেকে আদালত প্রাঙ্গণে পুলিশের পাশাপাশি সেনাসদস্যদের উপস্থিতি দেখা যায়।
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়। ১৩ আগস্ট প্রথম গ্রেপ্তার হন আনিসুল ও সালমান। পরদিন তাদের আদালতে তোলা হয়। সে সময় তাদের লক্ষ্য করে ডিম ছোড়া হয়েছিল। একইভাবে হেনস্তার শিকার হয়েছিলেন দীপু মনিসহ বেশ কয়েকজন নেতা। এর পর থেকে তাদের মামলার শুনানি হচ্ছে সাতসকালে। এ জন্য তাদের সকাল সাড়ে ছয়টার পর কারাগার থেকে প্রিজন ভ্যানে আদালতে আনা হয়। আজও তাদের সাতসকালে আদালতে আনা হয়। এখন পর্যন্ত সাবেক বেশ কয়েকজন মন্ত্রী, সরকারি আমলা, আওয়ামী লীগ নেতা, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন পেশার অন্তত ৯০ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে ঢাকাসহ সারা দেশে ২৫৩টি মামলা হয়েছে। সালমানের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ৪৮টি। রাশেদ খান মেননের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ২২টি। জুনাইদ আহমেদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ৪৭টি। দীপু মনির বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ২০টি।
ভোরের আকাশ/রন
মন্তব্য