বাংলাদেশের ৪৫টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর একটি ‘গারো’। ভারতের মেঘালয় ছাড়াও আসামের কামরূপ, গোয়ালপাড়া ও কারবি আংলং জেলায় এবং বাংলাদেশের ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, সিলেট, শেরপুর, জামালপুর, নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, ঢাকা ও গাজীপুর জেলায় তাদের বসবাস। ভাষা অনুযায়ী তারা বোডো মঙ্গোলীয় ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। জাতিগত পরিচয়ের ক্ষেত্রে অনেক গারোই নিজেদেরকে মান্দি বলে পরিচয় দেন। গারোদের ভাষায় ‘মান্দি’ শব্দের অর্থ হলো ‘মানুষ’। গারোদের সমাজে মাতৃসূত্রীয় পরিবার প্রথা প্রচলিত। শ্বশুরবাড়িতে জামাই হয়ে যায় এই সমাজের পুরুষ।
বাংলাদেশে বসবাসরত গারো ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সার্বিক অবস্থার বিষয়ে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং বলেন, সার্বিক বিবেচনায় গারোরা ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। শিক্ষায় এগিয়ে গেলেও হারিয়েছে নিজেদের ভিটেমাটি ও সহায় সম্পত্তি। বেঁচে থাকার প্রয়োজনে গারোরা আজ শহরমুখী হয়ে পড়েছেন।
ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসব: গারোদের আদি ধর্মের নাম ‘সাংসারেক’ হলেও তাদের প্রায় ৯৮ শতাংশ এখন খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণ করেছেন। তাই তাদের সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালনেও এসেছে অনেক পরিবর্তন। বিষয়টি তুলে ধরে ‘ঢাকা ওয়ানগালা’ এর নকমা (সমাজ প্রধান) শুভজিৎ সাংমা জানান, গারোদের প্রধান ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসবের নাম ‘ওয়ানগালা’ যাতে দেবতা মিসি আর সালজংয়ের উদ্দেশে উৎপাদিত ফসল উৎসর্গ করা হয়। ১৮৬২ সালে খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণের পর থেকে বর্তমানে ৯৮ ভাগ গারোই খ্রিস্ট ধর্মে বিশ্বাসী। খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণের পর থেকে তাদের সামাজিক নিয়ম-কানুন, আচার-অনুষ্ঠানে বেশ পরিবর্তন এসেছে। গারোদের প্রধান দেবতার নাম তাতারা রাবুগা। এছাড়াও অন্যান্য দেবতারা হলেন- মিসি সালজং, সুসমি, গয়ড়া প্রমুখ।
খ্রিস্টান হওয়ার পরও সীমিত পরিসরে গারো এলাকাগুলোতে ওয়ানগালা উৎসব পালন করা হয়ে থাকে জানিয়ে শুভজিৎ সাংমা জানান, ওয়ানগালা ধন্যবাদ বা কৃতজ্ঞতা প্রকাশের উৎসব। আদিবাসী গারোদের বিশ্বাস, শস্য দেবতা বা ‘মিশি সালজং’ পৃথিবীতে প্রথম ফসল দিয়েছিলেন এবং তিনি সারা বছর পরিমাণ মতো আলো-বাতাস, রোদ-বৃষ্টি দিয়ে ভালো শস্য ফলাতে সহায়তা করেন। তাই নবান্নে নতুন ফসল ঘরে তোলার সময় ‘মিশি সালজং’কে ধন্যবাদ জানাতে উৎসবের আয়োজন করে গারোরা। ফসল দেবতাকে উৎসর্গ না করে তারা কোনো খাদ্য ভোগ করে না।
‘ওয়ানগালা’ আদিবাসী মান্দি বা গারোদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব। গত দেড় যুগ ধরে প্রতিবছর নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে ঢাকায় বসবাসরত গারোরা এ উৎসব আয়োজন করছে। যুগ যুগ ধরে গারোরা তাদের শস্য দেবতাকে এই ফসল উৎসর্গ করে আসছে। খ্রিস্ট ধর্মে দীক্ষিত হওয়ার পর গারোদের ঐতিহ্যবাহী সামাজিক প্রথাটি এখন ধর্মীয় ও সামাজিকভাবে একত্রে করে পালন করা হয়। অর্থাৎ এক সময় তারা তাদের শস্য দেবতা মিসি সালজংকে উৎসর্গ করে ওয়ানগালা পালন করলেও এখন তারা নতুন ফসল কেটে যিশু খ্রিস্ট বা ঈশ্বরকে উৎসর্গ করে ওয়ানগালা পালন করেন। এ সময় সামাজিক নানা আয়োজনসহ ধর্মীয় নানা আচার-অনুষ্ঠানাদিও পালন করা হয় বলে জানান শুভজিৎ সাংমা।
ওয়ানগালা উৎসব পালনের নানা দিক তুলে ধরে শুভজিৎ সাংমা বলেন, উৎসবের দিন সকালে দেবতাদের পূজার মাধ্যমে শুরু হয় ‘ওয়ানগালা উৎসব’। ‘আমুয়া’, ‘রুগালা’র মতো ধর্মীয় আচার পালন করা হয়। নতুন ধানের চালের গুঁড়া পানিতে মিশিয়ে বাড়ি ও মানুষের কপালে বা শরীরে ছাপ দেওয়া হয়। ধূপ পুড়িয়ে, দামা বাজিয়ে রাজকীয় বেশে ‘নকমা’ বা সমাজ প্রধান ও ‘খামাল’ বা পুরোহিত নৃত্য করতে করতে গান গাইতে গাইতে দল বেঁধে রাজ্যের প্রজাদের নিয়ে নির্দিষ্ট জায়গায় ‘দু’ বা মুরগি এবং ‘চু’ বা মদ দিয়ে তাততারা রাবুকা বা বাঁশ দিয়ে বানানো প্রতিমা রাক্কাসীর প্রতি ধন্যবাদ জানান। আর পিছে থাকে কালো বা লম্বা বাঁশ দিয়ে বানানো বাঁশি, দামা বা লম্বা ঢোল, বোম বা মহিষের শিং দিয়ে বানানো বাঁশি নিয়ে রাজ্যের সাধারণ গারোরা। প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী জুম ওয়ানগালা আজ শুধু একটি অনুষ্ঠান নয়, বর্তমানে এটি গারোদের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি রক্ষার আন্দোলনের প্রতিকৃতিও বলে জানান শুভজিৎ সাংমা।
মাতৃসূত্রীয় সমাজ ব্যবস্থা: গারো সমাজে মাতৃসূত্রীয় রীতি বিদ্যমান। মাতৃসূত্রীয় রীতির নানা ইতিবাচক দিক তুলে ধরে গারো গবেষক ও লেখক সঞ্জীব দ্রং বলেন, মাতৃসূত্রীয় সমাজ হচ্ছে সেসব পরিবার বা জনগোষ্ঠী, যাদের পরিবারের দায়িত্ব থাকে একজন নারীর ওপর এবং বংশের ধারাও নির্ধারিত হয় নারীর দিক থেকে। মায়ের পরিবার থেকেই উত্তরাধিকার ও বংশ-পদবি নির্ধারিত হয়। প্রজন্মের পর প্রজন্ম এ ব্যবস্থায় মাতৃসূত্রীয় বংশানুক্রমিক ধারা অব্যাহত থাকে। প্রাচীনকাল থেকে মাতৃতান্ত্রিক ধারার কিছু জনগোষ্ঠী অদ্যাবধি জীবনধারণ করছে। বাংলাদেশ ও উত্তর-পূর্ব ভারতের খাসিয়া ও গারো নৃগোষ্ঠী মাতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা অনুসরণ করে। এছাড়া ইন্দোনেশিয়ার মিনানকাবাও, চীনের মোসুও, স্পেনের বাস্কোস, দক্ষিণ আফ্রিকার চরোকি, চক্টো, গিটস্কান, হাইডা, হপি, ইরোকুইস, উত্তর আমেরিকার লিঙ্গট, পশ্চিম সুমাত্রা, মালেশিয়ার নিজারে সিম্বিলান, কেরালার নায়ার, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার চাম সম্প্রদায় মাতৃসূত্রীয় সমাজব্যবস্থা লালন করে। পিতৃকেন্দ্রিক সমাজে বিয়ের পর স্ত্রীকে যেখানে স্বামীর বাড়িতে যেতে হয় এবং স্বামীর সঙ্গে অবস্থান করতে হয়, সে ক্ষেত্রে মাতৃসূত্রীয় সমাজে বিয়ের পর পুরুষকে স্ত্রীর বাড়িতে চলে যেতে হয়। এই সমাজব্যবস্থায় সম্পত্তির উত্তরাধিকার মায়ের দিক থেকে আসে। মেয়েরাই পরিবারের সব সম্পত্তির উত্তরাধিকারিণী। ছেলেরা কখনো পারিবারিক সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হতে পারে না; এমনকি ছেলেরা বিয়ের আগে উপার্জিত সম্পদও বিয়ের পরে দাবি করতে পারে না। এই সমাজব্যবস্থা হওয়ায় গারো পরিবারে মেয়েরাও বংশানুক্রমে পারিবারিক সম্পত্তির উত্তরাধিকারিণী হয়ে থাকে। একই পরিবারে একাধিক মেয়ে থাকলে সবাই সাধারণত সম্পত্তির উত্তরাধিকারিণী হতো না। সে ক্ষেত্রে সর্বকনিষ্ঠ কন্যা সন্তান উত্তরাধিকারিণী হয়। অবশ্য বর্তমানে অনেক মাতৃসূত্রীয় সম্প্রদায়ে সব মেয়েই সমানভাবে মায়ের সম্পত্তির উত্তরাধিকারিণী হয়। মাতৃসূত্রীয় সমাজ নারী শাসিত হতে হবে এমন নয়, তবে সমাজব্যবস্থা মাতৃসূত্রীয় হতে হয়।
গারোদের বিয়ের ক্ষেত্রে যৌতুকের প্রচলন নেই। যেহেতু মেয়েরা সম্পত্তির উত্তরাধিকারিণী হয়, সেহেতু একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত গারো বিধবা বিয়ে করতে পারে না। উদ্দেশ্য হলো- নিজ পরিবারের সম্পত্তি রক্ষা করা। ছোট ছেলে বা সন্তান সাবালক না হওয়া পর্যন্ত তাকে অপেক্ষা করতে হয়। বর্তমানে অবশ্য এ অবস্থার পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। এখন গারো বিধবার বিয়ের জন্য তেমন অপেক্ষার প্রয়োজন হয় না।
শিক্ষায় এগিয়ে গারোরা: গারো সম্প্রদায়ের ৯০ ভাগ মানুষ বর্তমানে স্বাক্ষর জ্ঞানসম্পন্ন। আর শিক্ষার দিক থেকে গারো সম্প্রদায় এগিয়ে আছে বলেও দাবি করেন কেন্দ্রীয় আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং। তিনি বলেন, গারোদের নিজস্ব মাতৃভাষা থাকলেও তারা বাংলা ভাষাতেই পড়ালেখা করে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে। সঞ্জিব দ্রং বলেন, গারোদের শিক্ষাক্ষেত্রে মূলত অবদান রেখেছে আন্তর্জাতিক খ্রিস্টান-মিশনারীগুলো। মিশনারী কর্তৃক যে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পাহাড়ি জনপদে গড়ে উঠেছিল ব্রিটিশ শাসনামলে, সেই সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যে বাংলাদেশ সরকার এমপিওভুক্ত করে নিয়েছে।
জনসংখ্যা ও ভাষা: বাংলাদেশে গারো সম্প্রদায়ের মানুষের বসবাস গড়ে উঠেছে টাঙ্গাইল, জামালপুর, শেরপুর, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ, সিলেট, গাজীপুর জেলাসহ বিভিন্ন উপজেলায়। তবে ময়মনসিংহ জেলার হালুয়াঘাট, ধোবাউড়া, নেত্রকোনা জেলার দুর্গাপুর, কলমাকান্দা, শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ী, ঝিনাইগাতী, টাঙ্গাইল জেলার মধুপুর উপজেলায় তাদের বসবাস। দেশে প্রায় এক লাখ বিশ হাজার গারো জনগোষ্ঠীর বসবাস রয়েছে বলে জানান সঞ্জীব দ্রং।
গারোর ভাষা হচ্ছে চীনা-তিব্বতি ভাষা। এটি ভারতের মেঘালয় অঙ্গরাজ্যের গারো পাহাড় এলাকার অধিবাসীদের প্রধান ভাষা। তবে বাংলাদেশেও প্রচলিত। গারোরা নিজেদের মান্দি পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দবোধ করে। মেঘালয়ের প্রতিবেশী অঙ্গরাজ্যের আসামে প্রচলিত ‘বোডো ভাষা’র সঙ্গে এর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। গারো ভাষা লাতিন লিপিতে লেখা হয়। গারোদের নিজস্ব ভাষায় কোনো স্কুল কলেজ গড়ে উঠেনি। সঞ্জিব দ্রং প্রতিটি স্কুলে গারো ভাষায় পাঠদানের দাবি জানান।
গোত্র ভেদে গারোদের মধ্যে আলাদা আলাদা উপভাষার প্রচলন রয়েছে। আচিক উপভাষাটি বাংলাদেশের টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, শেরপুর, নেত্রকোনা এবং ভারতের মেঘালয় অঙ্গরাজ্যে বসবাসরত গারোদের মাতৃভাষা। তাদের নিজস্ব ভাষা ‘আচিক’ শব্দের অর্থ পাহাড়। অন্যান্য উপভাষার মধ্যে আছে আবেং, আওযে, চিসাক, দাক্কা, গাঞ্চিং, কামরূপ, মাতচি। বাংলাদেশে আবেং উপভাষাটিও প্রচলিত। গারো ট্রাইবাল ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা সমুয়েল চিরান বলেন, গারোদের ঐতিহ্য সংস্কৃতি আজ হারিয়ে যাচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে তাদের মাতৃভাষা। রাষ্ট্রীয়ভাবে গারোদের মাতৃভাষা রক্ষার্থে গারো অঞ্চলভিত্তিতে একটি করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দাবি করেন। যে বিদ্যালয়ে গারো শিশুরা তাদের মাতৃভাষায় শিক্ষা অর্জন করতে পারেন।
ভোরের আকাশ/রন
মন্তব্য