কোনো কাজেই আসছে না প্রায় ৫৮ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত গাজীপুরের বঙ্গবন্ধু হাইটেক সিটি রেলস্টেশন। প্রতিদিন গাজীপুর শিল্পাঞ্চল, ঢাকা ও উত্তরবঙ্গের ১২ হাজারের বেশি যাত্রী যাতায়াত করবে এমনটা ধরে নিয়ে ঢাকার কমলাপুরের আদলে স্টেশনটি নির্মাণ করা হয়েছিল। কিন্তু বিপুল ব্যয়ে নির্মিত এই ষ্টেশনে ট্রেন না থামায় পুরোপুরি বন্ধ যাত্রী সেবা। শুনশান নীরব স্টেশনে এখন শুধুই ভুতুড়ে নীরবতা আর মাদকসহ নানা অপরাধের আখড়া। নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন স্টেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও।
নির্মাণশৈলী, নান্দনিকতা আর আধুনিকতায় দেশের অন্যতম কালিয়াকৈরের বঙ্গবন্ধু হাইটেক সিটি রেলওয়ে স্টেশন। বঙ্গবন্ধু হাইটেক সিটি থেকে মাত্র ১০০ গজ দূরে নির্মিত স্টেশনটিতে রয়েছে একক প্ল্যাটফর্ম, একটি লুপ লাইন ও আধুনিক সিগন্যাল ব্যবস্থার মতো সুবিধাসমূহ। আধুনিক সুবিধাসম্পন্ন বিশাল পরিসরে এই স্টেশন ২০১৮ সালে উদ্বোধন করা হয়। উদ্বোধনের পর এখান থেকে মাত্র একটি ডেমু ট্রেন চলাচল করতো। সে ট্রেনও করোনাকালে বন্ধ হয়ে যায়। এছাড়াও বিভিন্ন সময় এ স্টেশনে ট্রেন থামানোর দাবিতে বিক্ষোভ ও মানববন্ধন করেন এলাকাবাসী। তাদের দাবিতে এ স্টেশনে থামানো হতো টাঙ্গাইল কমিউটার ও সিরাজগঞ্জ এক্সপ্রেস। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পর নানা কারণে এখন সে দুটি ট্রেনও বন্ধ। অথচ এই স্টেশন হয়ে ঢাকা থেকে টাঙ্গাইল ও উত্তরবঙ্গের পথে ৪০টি ট্রেন চলাচল করে। মূলত যাত্রী না পাওয়ায় এসব ট্রেন এই স্টেশনে থামানো হয় না। ফলে প্রায় ছয় বছর আগে মহাসমারহে উদ্বোধন করা বঙ্গবন্ধু হাইটেক সিটি রেলওয়ে স্টেশনটি এখন অনেকটা অকেজোই পড়ে আছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, কয়েকজন শিক্ষার্থী ঘুরছেন প্ল্যাটফর্মে, রেল লাইন ধরে। কয়েকজন বানাচ্ছেন টিকটক ভিডিও। ট্রেন না থাকায় ষাটোর্ধ্ব একজন হকার তার পণ্য সামগ্রী পাশে রেখে মাছ ধরার জাল বুনছেন। ওই হকার বলেন, ট্রেন না থামায় স্টেশনটি এখন আর কোনো কাজেই আসছে না। মালপত্র নিয়ে বসে আছি। যাত্রী নাই, বেঁচা বিক্রিও নাই।
স্থানীয় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বর্তমানে বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি পোশাক শিল্পের পেশাজীবীদের বৃহৎ অংশই আসেন উত্তরবঙ্গ থেকে। রাজধানীর হেমায়েতপুর, সাভার, নবীনগর, ধামরাই, কালামপুর, পল্লী বিদ্যুৎ, বাইপাইল (পশ্চিম আশুলিয়া), রফতানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা, জিরানী, কবিরপুর, গাজীপুরের টঙ্গী থেকে শুরু করে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের দুই পাশের ভোগড়া, কোনাবাড়ী, কাশিমপুর, সফিপুর, চন্দ্রা এলাকায় বাস করছেন লাখ লাখ শ্রমিক। উত্তরবঙ্গের ২৩ জেলার ৬ কোটি মানুষের প্রায় প্রতিটি পরিবারের অন্তত একজন করে কর্মসূত্রে এসব এলাকায় বাস করেন। এসব এলাকার বাসিন্দাদের যাতায়াতের একমাত্র পথ ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক। সকলেই জানান, কালিয়াকৈরের চন্দ্রা হলো একমাত্র প্রবেশ পথ। এ পথ ধরেই উত্তরবঙ্গের ২৩ জেলার মানুষ রাজধানীতে নানান প্রয়োজনে আসা-যাওয়া করেন। অন্য এলাকার মানুষ এ পথ দিয়েই উত্তরবঙ্গে যাতায়াত করেন। স্থানীয়দের মতে, চন্দ্রা থেকে বঙ্গবন্ধু হাইটেক সিটি রেলস্টেশনের দূরত্ব মাত্র আধা কিলোমিটার। ফলে সড়ক পথের যানজট, যাত্রী ভোগান্তী ও যাত্রার সময় কমানোতে এই স্টেশন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। কারণ, তুলনামূলক আরামদায়ক ও সাশ্রয়ী হওয়ায় এক্ষেত্রে বাংলাদেশ রেলওয়ে উত্তরবঙ্গের ২৩ জেলার মানুষের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছে। উভয়মুখী গন্তব্যে সকলের প্রথম পছন্দ রেল। বিপুল সম্ভাবনাময় স্টেশনটি দেশের উত্তরবঙ্গের সঙ্গে যোগাযোগের একটি কমিউনিকেশন হাবে রূপান্তরিত হতে পারত। কিন্তু শুধু ট্রেন না থামার কারণে স্টেশনটি এখন অযত্ন-অবহেলায় এক অকেজো স্থাপনায় পরিণত হয়েছে।
স্থানীয় এলাকাবাসীর অভিযোগ, এই স্টেশনে কোনো ট্রেন না থামায় সুবিধাবঞ্চিত ঢাকা, গাজীপুর, কালিয়াকৈর, সাভারসহ উত্তবঙ্গের মানুষ। ফলে স্টেশনটি তাদের কোনো কাজে আসছে না। ট্রেনের অভাবে স্টেশন থেকে ফিরে যাচ্ছেন যাত্রীরা। এতে তাদের দুর্ভোগ বাড়ছে। দুর্ভোগ লাঘবে এখানে নিয়মিত ট্রেন থামানোর দাবি জানিয়েছেন তারা।
স্থানীয়দের অভিযোগ, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের সঙ্গে সখ্য ছিল সাবেক তথ্য প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলকের। সেই প্রভাব খাটিয়ে সরকারের আইসিটি বিভাগ একক নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিলেন তিনি। যেকোনো প্রকল্প থেকে মোটা অংকের কমিশন যেতো পলকের পকেটে। বিশেষ করে ডিজিটাল বাংলাদেশ তৈরি, এসপায়ার টু ইনোভেট (এটুআই) প্রকল্প, শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব, হাইটেক পার্ক, আইটি পার্ক, শেখ কামাল আইটি ট্রেনিং এন্ড ইনকিউবেশন সেন্টার স্থাপনসহ একাধিক প্রকল্পের কাজ হাতে নেওয়া হয় শেখ হাসিনা সরকারের আমলে। ৩৫৫ একর আয়তনের হাইটেক পার্কের মধ্যে ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্পে গাজীপুরের বঙ্গবন্ধু হাইটেক সিটিতে গড়ে তোলা হয়েছে ডাটা সেন্টার। প্রথমে কালিয়াকৈর হাইটেক পার্ক নামে প্রকল্প শুরু হওয়ার পর ২০১৬ সালে নাম বদল করে করা হয় বঙ্গবন্ধু হাইটেক সিটি। এই হাইটেক সিটির ১০০ মিটার দুরত্বে নির্মাণ করা হয়েছে হাইটেক সিটি রেলস্টেশন। আওয়ামী সরকার হরিলুটের জন্যেই বিপুল ব্যয়ে এ স্টেশনের মতো অনেকগুলো অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প নিয়েছিল। এখন দেখভালের অভাবে নষ্ট হচ্ছে স্টেশনের বিভিন্ন মূল্যবান স্থাপনা।
এদিকে, বিরাট পরিসরের স্টেশনটিতে নেই নৈশপ্রহরী, জিআরপি পুলিশ। নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার না থাকায় এখানে চুরি, ছিনতাই, মাদকের আখড়াসহ বিভিন্ন অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। চুরি হয়ে যাচ্ছে স্টেশনটির বিভিন্ন মালামাল। এ ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু হাইটেক সিটি রেলস্টেশনের স্টেশন মাস্টার মো. খায়রুল ইসলাম বলেন, এই রুট দিয়ে চলাচল করে ২০ জোড়া (৪০টি) ট্রেন। কিন্তু বিশাল এই স্টেশনে স্টপেজ মাত্র দুটি লোকাল ট্রেনের। এগুলোর একটি টাঙ্গাইল কমিউটার, অন্যটি সিরাজগঞ্জ এক্সপ্রেস যা বর্তমানে বন্ধ রয়েছে। এই স্টেশনে মাত্র দুইজন কর্মরত আছি, নেই রেলওয়ে পুলিশসহ অন্য কোনো লোকবল। তাই সন্ধ্যা হলে নিজেরাই নিরাপত্তাহীনতা বোধ করি।
রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন ভাতা, রক্ষণাবেক্ষণসহ বিভিন্ন খরচের হিসাবে বছরে এই স্টেশনে ব্যয় ৩০ লাখ টাকার বেশি। বছরে গড় আয় সোয়া ৯ লাখ টাকা। আর গত তিন বছরে স্টেশনটি থেকে দিনে গড়ে যাত্রী যাতায়াত করেছে মাত্র ৪৭ জন।
ভোরের আকাশ/রন
মন্তব্য