উন্নত দেশগুলোতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খাতের একটি বীমা। কিন্তু বাংলাদেশের চিত্র পুরো উল্টো। অনিয়ম, দুর্নীতি আর অযাচিত হস্তক্ষেপে এ খাত এখন ধ্বংসের পথে। টাকা ফেরত পাচ্ছেন না অন্তত ১০ লাখ গ্রাহক। সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা দাবিতে মামলা চলছে। অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের দেশে প্রয়োজনের তুলনায় বীমা প্রতিষ্ঠান বেশি। বর্তমানে ৮২টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এগুলোর মধ্যে ২৯টি তীব্র তারল্য সংকটে ভুগছে। পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে আইন সংশোধনের তাগিদ দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
বীমা একটি সর্বজনীন বিষয়। বীমা মানব জীবনের পরম বন্ধু। শুধু তাই নয়, বীমা মানুষের জীবন ও সম্পদের নিরপত্তার জন্য সমান তালে কাজ করে থাকে। মানুষের সাধারণ জীবনের ঝুঁকির পাশাপাশি দুর্ঘটনাজনিত ক্ষতি, গ্রুপ বীমা, স্বাস্থ্যের বীমা ছাড়াও বিশেষ বিশেষ কতগুলো রোগ-বালাই এর জন্য ডাক্তার দেখানো থেকে শুরু করে হাসপাতালে ভর্তি ও চিকিৎসাসহ সকল কিছুই লাইফ বীমা কোম্পানি গ্রহণ করে থাকে। তা ছাড়া সন্তানদের লেখা পড়া, বিয়ে সাদী এবং বৃদ্ধ বয়সে পেনশনের ব্যবস্থাও জীবন বীমা বা লাইফ পলিসি থেকে পাওয়া যায়। তাই বাবা প্রায়শঃ বলেন টিভি, বিজ্ঞাপনে অনেক আগে প্রচার হতো ‘সুখে-দুঃখে আপনজন জীবন বীমা করপোরেশন’ শুনতে বড়ই মধুর লাগতো। কিন্তু বাস্তবতা এখন ভিন্ন।
আবার মানুষের পরিশ্রমের বিনিময়ে প্রতিষ্ঠিত ব্যবসা বাণিজ্য, কল-কারখানা, ব্যক্তি ও মালামাল পরিবহনে ব্যবহৃত গাড়ি, মালামাল ও যাত্রী পরিবহনে ব্যবহৃত জাহাজ, বিমান, হেলিকপ্টার ইত্যাদির নিরাপত্তা বিধানের জন্য সাধারণ বীমা বা নন-লাইফ বীমা পলিসি রয়েছে।
দিনের পর দিন বছরের পর বছর অবহেলিত হয়ে আসছে বীমার মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক খাত। অথচ বীমার প্রকৃত উদ্দেশ্য হচ্ছে- গ্রাহকের স্বার্থ তথা আর্থিক নিরাপত্তা রক্ষা করা। বীমা খাতের বর্তমান নৈরাজ্যজনক অবস্থায় সেই উদ্দেশ্য ক্রমাগতভাবে পরাজিত বা ব্যাহত হচ্ছে। দুঃখজনকভাবে এর প্রতিকার তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নিতে কর্তৃপক্ষ ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েই যাচ্ছে।
বাংলাদেশের বীমা খাত উন্নয়ন প্রকল্পের উপ-প্রকল্প পরিচালক এস এম আনিসুজ্জামান ভোরের আকাশকে বলেন, আমরা মূলত বীমা খাতের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য কাজ করে থাকি। এজন্য আমরা প্রায়োরিটি হিসেবে অটোমেশন, পলিসি রিঅ্যারেঞ্জসহ বিভিন্ন প্রশিক্ষণের আয়োজন করি। গ্রাহকদের আস্থা ফিরতে সময় লাগবে, এটা সত্য। এজন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা জরুরি। একই সাথে পূর্ণ বীমাগুলো অত্যন্ত দ্রুততার সাথে গ্রাহককে বুঝিয়ে দেওয়াটাও বড় দায়িত্ব বলে আমি মনে করি। পাশাপাশি, প্রকৃত যারা অপরাধী বা যারা বীমা ব্যবসার ইমেজ নষ্ট করছে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষকে তাদের শাস্তির উদ্যোগ নিতে হবে এবং বীমা সেক্টরের অরাজতা বন্ধে কর্মীদের মানসিক স্বস্তির জন্য ব্যবস্থা না করে কর্মী ছাঁটাই বীমা শিল্পের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে। এছাড়া অতিরিক্ত কমিশনের কারণে নন-লাইফ বীমা কোম্পানিগুলোর ঠিক মতো দাবি পরিশোধ এবং পুনঃবীমাকারীর কাছ থেকে যথার্থ সহযোগিতা না পাওয়ার কারণে দাবি নিষ্পত্তি করা দুরূহ হয়ে পড়েছে বলেও মনে করেন তিনি।
রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও দুর্বল নিয়ন্ত্রণব্যবস্থার কারণে এই খাতের প্রতি জনগণের আস্থা বাড়েনি; বরং কমেছে বলে মনে করছেন এই খাত সংশ্লিষ্ট অনেকেই। এই খাতে পেশাদারত্বের অভাবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ গত ডিসেম্বরে ব্যাংকগুলোকে বিমা পণ্য চালুর অনুমতি দেয়। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিশ্বাস, ব্যাংকগুলো বীমার ওপর জনসাধারণের আস্থা ফেরাতে সহায়তা করতে পারে। সমস্যাগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইনস্যুরেন্স, পদ্মা ইসলামী লাইফ ইনস্যুরেন্স, প্রাইম ইসলামী লাইফ ইনস্যুরেন্স, গোল্ডেন লাইফ ইনস্যুরেন্স, হোমল্যান্ড লাইফ ইনস্যুরেন্স ও প্রগ্রেসিভ লাইফ ইনস্যুরেন্সের নাম রয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ন্যাশনাল লাইফ ইন্স্যুরেন্সের এক কর্মকর্তা ভোরের আকাশকে জানান, পরিচালনা পর্ষদের অযাচিত প্রেসার। পরিচালকদের আর্থিক লোভ-লালসার কারণে বীমায় কর্মরতদের তাদের খুশি রাখার জন্য অন্যায় কাজে সম্পৃক্ত হতে হয়। ফলশ্রুতিতে কাউকে কাউকে শাস্তিও ভোগ করতে হয়। একই সাথে প্রতিনিয়ত লাইফ বীমা কোম্পানিগুলো থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাটের তথ্য বিভিন্ন সময় মিডিয়ায় প্রচার হওয়ার বীমার প্রতি মানুষের আস্থা ও বিশ্বাসের সংকট আজ দৃশ্যমান। পাশাপাশি উপযুক্ত মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা পাওয়া যায় না বলে অযোগ্য এবং মালিকদের আজ্ঞাবহ মুখ্য নির্বাহীদের বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ নিয়োগ দিয়ে ক্ষেত্র বিশেষে এক্সটেনশন দিচ্ছেন এটা ভেবে দেখার সময় এসেছে বলেও মনে করেন তিনি। অন্যদিকে পপুলার লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির মো. জহিরুল ইসলাম চৌধুরী ভোরের আকাশকে জানান, জাতীয় বীমা নীতির কর্ম পরিকল্পনায় বীমায় সচেতনা বৃদ্ধির কার্যকর পদক্ষেপের কথা বলা থাকলেও তেমন দৃশ্যমান অগ্রগতি এখনো লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। সার্ভে কোম্পানিগুলোতে বীমা বিষয়ে উচ্চ শিক্ষিত ও সকল ক্ষেত্রে প্রশিক্ষিত দক্ষ লোকের অভাব রয়েছে। তিনি বলেন, পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে যোগ্য মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগের ব্যবস্থা নিতে হবে। বীমা কোম্পানিগুলোর সঠিক সময়ে বীমা গ্রহীতাদের প্রাপ্য দাবির অর্থ পরিশোধ করার ব্যাপারে কোম্পানিগুলোও পুনঃবীমাকারীকে বাধ্য করার জন্য বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষকে কার্যকর ভূমিকা নিতে হবে। বীমা কোম্পানির অর্থ হরিলুটের বাতাসার মতো ভাগ করে খাওয়া বন্ধের উদ্যোগ নিতে হবে। আজ বীমায় যে ইমেজ সংকট তৈরি হয়েছে তা থেকে পরিত্রাণের একমাত্র উপায় হিসাবে বীমা কোম্পানিগুলোর ভিতর এবং বাইরে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা, এজন্য সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে বলেও মনে করেন তিনি।
একইসাথে গ্রাহক হয়রানি না করে গ্রাহকবান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে কোম্পানিগুলোকে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষকেই সরকারের হয়ে উদ্যোগ নেয়া, বীমার প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস ফিরিয়ে আনার জন্য বীমা সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি, সাধারণ জনগণ, কল-কারখানায় কর্মরত কর্মীদের জন্য সংবাদপত্র, টিভি চ্যানেল, রেডিও, ফেসবুক, সোস্যাল মিডিয়ায় বীমার সুবিধাদি প্রচারের পদক্ষেপ নিতে হবে বলেও মনে করেন তিনি।
মূলত একটি কোম্পানি নিবন্ধনের জন্য মাত্র ১৮ কোটি টাকা প্রয়োজন। নিবন্ধন প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি এই খাতের সমস্যা আরও বাড়িয়ে তুলেছে। বাংলাদেশের জিডিপিতে বীমা খাতের অবদান মাত্র শূন্য দশমিক ৪৬ শতাংশ, যেখানে ভারতে ৪ দশমিক ২ শতাংশ এবং পাকিস্তানে শূন্য দশমিক ৯১ শতাংশ। আইডিআরের তথ্যানুসারে, বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় এক কোটি ৭১ লাখ ১০ হাজার মানুষ বীমা করেছেন। বিপুলসংখ্যক বীমা প্রতিষ্ঠান থাকা সত্ত্বেও দেশের গড় বীমা দাবি নিষ্পত্তির অনুপাত বৈশ্বিক মান ৯৭-৯৮ শতাংশ থেকে অনেক পিছিয়ে।
২০২২-২৩ অর্থবছরে ভারতে গড় বীমা দাবি নিষ্পত্তি অনুপাত ছিল প্রায় ৯৮ দশমিক ৪৫ শতাংশ। এর বিপরীতে ২০২৩ সালে দেশে বিমা নিষ্পত্তির হার ছিল ৬৫ দশমিক ১৯ শতাংশ। গত ১৫ বছরে বীমাকারীদের আর্থিক অবস্থার অবনতি, সচেতনতার অভাব ও এজেন্টরা বীমা পণ্যের সুবিধা-অসুবিধাগুলো সঠিকভাবে ব্যাখ্যা না করায় ২৬ লাখের বেশি পলিসি বাতিল হয়েছে। গত ডিসেম্বরে ব্যাপক অনিয়ম ও অর্থ আত্মসাতের কারণে আর্থিক সক্ষমতা হারানো বেশ কয়েকটি বীমা প্রতিষ্ঠান একীভূতকরণের সুপারিশ করে আইডিআরএ। প্রতিবেদনে বলা হয়, দাবি নিষ্পত্তিতে ব্যর্থতা বীমা খাতের প্রতি জনগণের আস্থা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
জীবন বীমা করপোরেশনের ম্যানেজার ও বোর্ড সেক্রেটারি শ্যামল কান্তি ভৌমিক ভোরের আকাশকে বলেন, প্রতিবেশী ভারতে ৫৭টি, পাকিস্তানে ৪০টি ও শ্রীলঙ্কায় ২৮টির বিপরীতে বাংলাদেশে মোট বীমা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৮২। বাংলাদেশে বর্তমানে কার্যক্রম পরিচালনাকারী বীমা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে একটিমাত্র আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান আছে। এ ছাড়া আরেকটি প্রতিষ্ঠান কয়েক বছর ধরে জয়েন্ট ভেঞ্চার কোম্পানি হিসেবে এই দেশে ব্যবসা করছে। দেশে প্রয়োজনের তুলনায় বেশিসংখ্যক ইনস্যুরেন্স কোম্পানি থাকার কারণে এই খাতে অসুস্থ প্রতিযোগিতা তৈরি হয়েছে। এর ফলে এই খাতে এক ধরনের অস্থিরতা লেগেই আছে বলে মনে করেন তিনি। তিনি বলেন, নির্দিষ্ট কোনো নিয়ম-নীতির মাধ্যমে কোম্পানিগুলো পরিচালিত হচ্ছে না। বিভিন্ন কোম্পানি তাদের মনগড়া নিয়মে চলছে। অনেক বীমা কোম্পানিতে নৈতিকতার কোনো স্থান নেই। যে যত অনৈতিক কাজ করতে পারে সেই তত বেশি পুরস্কৃত হয়। তাই বীমা শিল্পে কর্মরত কর্মীদের মধ্যে হতাশা বিরাজ করছে।
জানা গেছে, এই উপমহাদেশে ১৮১৮ সনে ওরিয়েন্টাল লাইফ ইন্স্যুরেন্স দিয়ে বীমা যাত্রা শুরু হয়। বীমা শিল্পে কাজের অভিজ্ঞতায় দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সনে ৮ আগস্ট ন্যাশনালাইজেশন এক্টের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু সকল বীমা কোম্পানি জাতীয়করণ করেন। ১৯৭৩ সালের ১৪ মে সাধারণ বীমা করপোরেশন ও জীবন বীমা করপোরেশন গঠনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন। পরবর্তীতে প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ১৯৮৪ সালে জাতীয়করণ রহিত করে বেসরকারি খাতে বীমা শিল্পের অনুমোদন দেন এবং ১৯৮৫ সালে বেসরকারি খাতে ২৪টি সাধারণ বীমা ও ৫টি জীবন বীমা কোম্পানি কার্যক্রম শুরু করে। বর্তমানে বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় সাধারণ বীমা ও জীবন বীমা এবং ২টি বিদেশি জীবন বীমাসহ ৮১টি বীমা কোম্পানি কাজ করছে। বীমাকে বেগবান করতে ২০১০ সনের ২৬ জানুয়ারি বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ গঠন করেন। ২০২০ সাল থেকে প্রতি বছর ১ মার্চ ‘বীমা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। অন্য কোনো সেক্টর; কিন্তু এই সুবিধা পায়নি। তারপরও পিছিয়ে পড়েছে গুরুত্বপূর্ণ এ আর্থিক খাত।
ভোরের আকাশ/রন
মন্তব্য