রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র কারওয়ান বাজারে গড়ে উঠেছে বহুমাত্রিক ব্যবসায়িক কার্যক্রম। ঢাকার সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার হিসেবে পরিচিত এটি। সরকারি-বেসরকারি নানা প্রতিষ্ঠানের বহুতল ভবনও রয়েছে এখানে। এসব কারণে দিন-রাত কারওয়ান বাজার এলাকায় ভিড় লেগেই থাকে। আশপাশের সড়কগুলোতেও গাড়ির অবৈধ পার্কিং এবং ফুটপাতে সারি সারি দোকানের কারণে স্বাভাবিক চলাচলে বিঘ্ন ঘটে। এখানের চাপ কমাতে অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে অন্য এলাকায় দুটি বহুতল কাঁচাবাজার নির্মাণ করা হয়। তবে নানা কারণ দেখিয়ে ব্যবসায়ীরা সেখানে যেতে অনাগ্রহ দেখাচ্ছেন। এদিকে গত কয়েক বছরে উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) কাওরান বাজার থেকে কাঁচাবাজার সরাতে দফায় দফায় উদ্যোগ নিয়েও ব্যর্থ হয়। তাই কারওয়ান বাজার নিয়ে নতুন কোনও উদ্যোগ আর নিচ্ছে না ডিএনসিসি। ব্যবসায়ীরা বলছেন, এখানে কাঁচাবাজার থাকায় পুরো রাজধানীবাসী এর উপকার পাচ্ছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কাঁচাবাজার সমস্যা না, সমস্যা সঠিক ব্যবস্থাপনার। এদিকে, বাজার সরাতে আগে বানানো মার্কেট বিশেষ কোনো কাজে আসছে না। ফলে দীর্ঘদিনের যে সমস্যা, সেটি একই জায়গায় রয়ে গেছে। খবর বাংলা ট্রিবিউন’র।
কারওয়ান বাজারের অন্যতম বড় সমস্যা সড়ক ও ফুটপাত দখল। এই এলাকায় যতটা না মার্কেট ভবনের পরিসর তার চাইতে বেশি অংশ দখল করে আছে অবৈধ দোকানপাট। এছাড়া একাধিক ব্যক্তি জমিতেও বিভিন্ন আড়ৎ রয়েছে। খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, সিটি করপোরেশন ১ ও ২ নম্বর মার্কেট, কিচেন মার্কেট, সিটি করপোরেশন আড়ত ভবন, ডিআইটি মার্কেট, কাব্যকস সুপার মার্কেট, উত্তর কারওয়ান বাজার (ফলের আড়ত), পূর্ব তেজতুরী বাজার, হাসিনা মার্কেটসহ প্রায় ১০ থেকে ১২টি মার্কেট ও আড়ত রয়েছে কারওয়ান বাজারজুড়ে। এসব মার্কেট ও আড়তের প্রত্যেকটির চারপাশের ফুটপাত ও সড়কের ওপর রয়েছে দোকানপাট। ফুটপাত ছাড়াও কোথাও কোথাও পুরো সড়কজুড়ে অস্থায়ী অবৈধ মার্কেট রয়েছে, যা দেখে বোঝার উপায় নেই এখানে একটি সড়ক রয়েছে।
ফুটপাতের দোকানিদের সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, বাইরে দোকানের ভাড়া দিতে হয় না। আর তুলনামূলক কিছুটা কম মানের পণ্য বিক্রি করায় ভেতরের চাইতে কিছুটা কম মূল্যে পণ্য বিক্রি করা যায়। এতে ক্রেতাদের আগ্রহ থাকে বাইরে থেকে পণ্য কেনার। এছাড়া ভেতরে পর্যাপ্ত আলো না থাকায় অনেক ক্রেতা বাইরে থেকেও পণ্য কিনতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। এসব কারণে রাতে আড়তে মাল নামানোর কাজ শেষ হলেও সারা দিন বাইরে ভিড় থাকে।
যত্রতত্র গাড়ির অবৈধ পার্কিং: শুধু অবৈধ দোকানপাট নয়, কাওরান বাজারজুড়ে যত্রতত্র অবৈধভাবে গাড়ি পার্কিং করে রাখা হয়। পণ্য আনা-নেওয়ার জন্য সারি সারি ভ্যান ও পিকাপ দাঁড় করিয়ে রাখা হয় এই এলাকার বিভিন্ন পয়েন্টে। এছাড়া বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি অফিসে আসা গাড়িগুলোও সড়কের ওপর রাখা থাকে। ফলে সড়ক সরু হতে হতে এমন পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে যে গাড়ি যেমন থেমে থাকে, হাঁটারও উপায় থাকে না।
একাধিক পিকাপ চালকের সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, রাত থেকে সকাল পর্যন্ত কাওরান বাজার থেকে পণ্য ঢাকার বিভিন্ন স্থানসহ ঢাকার বাইরে নিয়ে যাওয়ার কাজ থাকে। দিনেও কিছু কিছু ভাড়া আসে। যেহেতু কাওরান বাজারের পণ্য আনা-নেওয়াই মূল কাজ, তাই এখানেই গাড়ি পার্কিং করে রাখা হয়।
পণ্য খালাসে নেই কোনো শৃঙ্খলা: কারওয়ান বাজারে গাড়িতে মালামাল উঠানো-নামানোয় কোনো শৃঙ্খলা নেই বলে অভিযোগ ব্যবসায়ীদের। তারা বলেন, কারওয়ান বাজারে যে যেভাবে পারছেন, পণ্য খালাস করার জন্য গাড়ি ঢোকাচ্ছেন। এসব গাড়ি শৃঙ্খলায় আনতে পুলিশ কিংবা সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে কোনও নির্দেশনা নেই। এতে করে বেশিরভাগ গাড়ি বাজারে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে চাঁদাবাজদের খপ্পরে পরে। চাঁদা না দিলে গাড়ির মাল লুট হয়। এছাড়া এই বিশৃঙ্খলার সুযোগে ফরিয়া ব্যবসায়ীরা পণ্যের হাত বদলের মাধ্যমে মুনাফা করে নেয়। এতে পণ্যের দামও বেড়ে যায়। ব্যবসায়ীদের দাবি, পণ্যের গাড়ির জন্য বিশেষ নির্দেশনা ও ব্যবস্থাপনা থাকলে বাজার কার্যক্রম সহজ হবে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ব্যবসায়ী বলেন, কাওরান বাজারের মূল কাজ সকালের মধ্যেই শেষ হয়ে যায়। এরপর খুচরা ব্যবসায়ীরা রাস্তা দখল করে রাখে। তাদের কারণেই এই এলাকায় যত ঝামেলা। সব কিছু যদি নিয়মে আনা যায় তাহলে কাওরান বাজার কোনও সমস্যাই না।
সিটি করপোরেশনের পরিকল্পনা মার্কেট সরিয়ে নেওয়া: কারওয়ান বাজারকে চাপ মুক্ত করতে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের পরিকল্পনা এখান থেকে সরকারি মার্কেটগুলো সরিয়ে নেওয়া। ইতোমধ্যে মহাখালী ও গাবতলীতে দুটি মার্কেট নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে। যাত্রাবাড়ীর মার্কেটের কাজও প্রায় শেষ। তবে নানা অসুবিধার কথা তুলে ধরে ব্যবসায়ীরা কাওরান বাজার ছাড়তে নারাজ। এর ফলে প্রস্তুত থাকলেও মহাখালী বা গাবতলী পাইকারি কাঁচাবাজার ফাঁকা পড়ে থেকে নষ্ট হচ্ছে।
এদিকে মহাখালীর মার্কেটটি কাজে লাগাতে প্রথমে এটিকে করোনাকালীন সময়ে কোভিড স্পেশাল হাসপাতাল করা হয়, পরে ডেঙ্গু রোগীদের জন্য চিকিৎসা সেবা চালু করা হয়। কিন্তু ভবনের একাংশে এই সেবা কার্যক্রম চললেও পুরো ভবনই মূলত ফাঁকা পড়ে রয়েছে। এটিকে পুরোপুরি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে দিতে আগ্রহী ডিএনসিসি। এদিকে গাবতলীতে কাঁচাবাজার সরিয়ে নিতে বদ্ধপরিকর ডিএনসিসি। ইতোমধ্যে কাঁচাবাজারের ওপরে থাকা আঞ্চলিক অফিস-৫ এর কার্যালয় সরিয়ে নিয়েছে ডিএনসিসি। এই ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে ব্যবসায়ীদেরও গাবতলীতে স্থানান্তরের জন্য চাপ দিচ্ছে, গত ঈদের পর জুলাইতে এই ভবন থেকে প্রথমে দোকান সরিয়ে নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন সাবেক মেয়র আতিকুল ইসলাম। তবে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হলে স্থানান্তরের সব কার্যক্রম থেমে থাকে। এখন নতুন করে সেই উদ্যোগ নিতে চাচ্ছে ডিএনসিসি।
ডিএনসিসি থেকে জানানো হয়, একই স্থানে পাইকারি ও খুচরা ব্যবসার কারণে কাওরান বাজারে চাপ বেড়েছে। পাইকার ব্যবসায়ীদের গাবতলী ও যাত্রাবাড়ী নিয়ে যেতে পারলে এই ভিড় কমে যাবে। আর কারওয়ান বাজারের আশপাশেই স্থানীয়ভাবে অনেক খুচরা বাজার রয়েছে, যেখান থেকে স্থানীয়রা বাজার করতে পারবেন।
সঠিক ব্যবস্থাপনার প্রয়োজন: কারওয়ান বাজার থেকে আড়ত সরিয়ে নেওয়ার চাইতে সঠিক ব্যবস্থাপনার আওতায় আনা গেলে সব পক্ষই উপকৃত হবে বলে মনে করেন ব্যবসায়ী সমাজ ও নগর পরিকল্পনাবিদরা। তারা বলেন, রাজধানীর কেন্দ্রে হওয়ায় সব দিক থেকেই পণ্য কাওরান বাজার আনা সহজ এবং এখান থেকে ঢাকার সকল প্রান্তে এবং ঢাকার বাইরেও পণ্য নেওয়া সুবিধাজনক। এ বিষয়ে কাওরান বাজার ক্ষুদ্র কাঁচামাল আড়ত ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি ওমর ফারুক বলেন, গাবতলী ঢাকার এক পাশ হওয়ায় সব অঞ্চলের পণ্য এখানে নিয়ে আসাটা সহজ হবে না। তাছাড়া গাবতলী এখনও বাজার বসানোর জন্য উপযুক্ত না। প্রায় চার-পাঁচশ গাড়ি এক সঙ্গে নিয়ে আসলে সেখানে ঢুকতে ঢুকতেই বেলা গড়িয়ে যাবে। পণ্য নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা আছে। গাবতলীর দোকানগুলোও আড়ত ব্যবসার উপযুক্ত না।
সড়ক পরিষ্কার ও সঠিক ব্যবস্থাপনা থাকলে কারওয়ান বাজারে ঝামেলা থাকবে না জানিয়ে তিনি বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ ভবন হলে সেটা ভেঙ্গে নতুন একটি ভবন করা হোক যেখানে শৃঙ্খলা থাকবে। আমাদের কাজ রাতে শুরু হয়ে সকালেই শেষ হয়ে যায়। অফিসের সময় শুরু হয় তার পরে। আমাদের জন্য তো কোনও সমস্যা হওয়ার কারণ দেখি না।
সঠিক ব্যবস্থাপনার কথা উল্লেখ করে ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক ও নগর পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, কারওয়ান বাজার স্থানান্তর কোনও ফলপ্রসূ উদ্যোগ বলে মনে করি না। নগরের সৌন্দর্য নষ্ট হতে পারে- এটা কোনও কারণ না। বাজারটি ঢাকার মধ্যবর্তী স্থানে হওয়ায় সব স্থানের মানুষ যেমন সহজে এখানে আসতে পারে, এখান থেকে পণ্য অন্যান্য এলাকার বাজারে নিয়ে যাওয়াও সহজ হয়। এতে পণ্য পরিবহনের খরচ কমে। একটি পরিকল্পিত ব্যবস্থাপনাই পারে কারওয়ান বাজারে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা মার্কেটগুলোর মাঝে একটা সমন্বয় রেখে এবং সড়ক দখল মুক্ত করে সহজেই এখানেই ব্যবসায়িক কার্যক্রম চালানো সম্ভব। তিনি আরও বলেন, কাওরান বাজার সরানোর জন্য যেসব মার্কেট করা হয়েছে সেগুলো আসলে সুদূরপ্রসারী চিন্তা করে করা হয়নি বলে ধারণা করি। সবার মতামতের ভিত্তিতে এসব মার্কেট নির্মাণ হলে আজকে মার্কেটগুলো পরে থাকতো না। যেহেতু মার্কেট নির্মাণ হয়েছে, আশা করি— এগুলোরও একটি কার্যকর ব্যবহার নিশ্চিত হবে।
কাওরান বাজার ঝুঁকিপূর্ণ: কারওয়ান বাজার সরিয়ে নেওয়ার বিষয় ও সরালেই শৃঙ্খলা আসবে কিনা জানতে চাইলে ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা খায়রুল আলম বলেন, কারওয়ান বাজার সরাতে হবে। শহরের মাঝে এমন একটি পাইকারি মার্কেট থাকতে পারে না। তাছাড়া কাওরান বাজারের ভবনগুলো ঝুঁকিপূর্ণ, না সরালে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
কারওয়ান বাজারকে নতুন একটা ব্যবস্থাপনায় আনা যায় কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, কাঁচাবাজারের জন্য গাবতলীতে একটি আধুনিক মার্কেট নির্মাণ করা আছে। সেখানে ব্যবসায়ীদের জন্য সব সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা আছে। সেখানে গেলে ব্যবসায়ীদের জন্যও যেমন ভালো হবে, নগরের মাঝখান থেকেও চাপ কমবে। তাছাড়া গাবতলীর কাঁচাবাজার মার্কেটটি একটি নির্দিষ্ট সীমানার ভেতর হওয়ায় ফরিয়া কিংবা চাঁদাবাজদের উৎপাত কমবে, ব্যবসায়িক কার্যক্রমে শৃঙ্খলা আসবে।
ভোরের আকাশ/রন
মন্তব্য