চট্টগ্রামে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও আইনজীবীদের সঙ্গে বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীর অনুসারীদের সঙ্গে সংঘর্ষের সময় এক আইনজীবী নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছে বেশ কয়েকজন। গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে এ ঘটনা ঘটে। এরপর বিক্ষোভ থেকে আজ বুধবার আদালত বর্জন করবেন বলে ঘোষণা দেন আইনজীবীরা। এদিকে, সহকর্মী হত্যার প্রতিবাদে এদিন সুপ্রিম কোর্টেও বিক্ষোভ করেছেন আইনজীবীরা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে ১০ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে ঢাকা ও চট্টগ্রামে। চিন্ময়কে গ্রেপ্তারের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ভারত। আইনজীবী খুনের নিন্দা জানিয়ে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। একই সঙ্গে তিনি সবাইকে ধৈর্য ধরার আহ্বান জানিয়েছেন। গতকাল তার প্রেস উইং এ তথ্য জানিয়েছে।
জানা গেছে, নিহত আইনজীবীর নাম সাইফুল ইসলাম ওরফে আলিফ (৩৫)। তিনি সহকারী সরকারি কৌঁসুলি (এপিপি)। তিনি লোহাগাড়ার চুনতি এলাকার জামাল উদ্দিনের ছেলে। বিকেল সাড়ে চারটার দিকে তাকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
সংঘর্ষের ঘটনায় আহত অবস্থায় আরও আটজন চমেক হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তারা হলেন- শ্রীবাস দাশ, শারকু দাশ, ছোটন, সুজিত ঘোষ, উৎপল ও এনামুল হক। গুরুতর আহত হওয়া আরেকজনের নাম এখনো জানা যায়নি। অন্যদিকে জেনারেল হাসপাতালে আরও ১৯ জনকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে।
চট্টগ্রাম আইনজীবী সমিতির সভাপতি নাজিম উদ্দিন চৌধুরী বলেন, বিক্ষোভকারীরা এক আইনজীবীকে চেম্বারের নিচ থেকে ধরে নিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেছেন। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, আমাদের একজন সহকর্মীকে ইসকনের সন্ত্রাসীরা নৃশংসভাবে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করেছে। এ ঘটনার প্রতিবাদে আমরা আইনজীবী সমিতির পক্ষ থেকে সাংগঠনিকভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে আগামীকাল (বুধবার) সারাদিন আদালত বর্জনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছি। সর্বস্তরের আইনজীবীদের এ প্রতিবাদে শামিল হওয়ার জন্য আমরা অনুরোধ করেছি।
জানা গেছে, গতকাল দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে চট্টগ্রাম আদালতে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীর জামিন নামঞ্জুর করা হয়। পরে তাকে কারাগারে পাঠানোর জন্য প্রিজন ভ্যানে তোলা হয়। তখন চিন্ময়ের অনুসারীরা প্রিজন ভ্যান আটকে দেন। তারা এ সময় বিক্ষোভ শুরু করেন। তখন পুলিশ, বিজিবি ও সেনাবাহিনী চেষ্টা করেও প্রিজন ভ্যান আদালত প্রাঙ্গণ থেকে বের করে কারাগারে নিতে পারেনি। পরে বেলা পৌনে তিনটার দিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সাউন্ড গ্রেনেড, কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ এবং লাঠিপেটা শুরু করলে বিক্ষোভকারীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েন। এরপর পাল্টাপাল্টি ধাওয়া চলতে থাকে। পরে চিন্ময় কৃষ্ণকে বহনকারী প্রিজন ভ্যান কারাগারের উদ্দেশে নিয়ে যাওয়ার সময় পুলিশ ও আইনজীবীদের সঙ্গে চিন্ময় অনুসারীদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়া শুরু হয়।
মো. হাসান নামের এক প্রত্যক্ষদর্শী আইনজীবী বলেন, পুলিশ ও আইনজীবীদের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও সংঘর্ষের মধ্যে আইনজীবী আলিফকে বিক্ষোভকারীরা কোপান। পরে তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়।চমেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক নিবেদিতা ঘোষ জানান, আহত অবস্থায় ৭-৮ জনকে নিয়ে আসা হয়েছে। তাদের একজনকে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে।
নগর পুলিশের উপকমিশনার লিয়াকত আলী বলেন, একজন মারা গেছেন। তবে কীভাবে মারা গেছেন, এখনো জানা যায়নি।
চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীকে গত সোমবার ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)। তিনি ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যাচ্ছিলেন। বাংলাদেশ সনাতন জাগরণ মঞ্চ গত ২৫ অক্টোবর চট্টগ্রামে সমাবেশ করে। চিন্ময় এই মঞ্চেরও মুখপাত্র। ওই সমাবেশের পর তার বিরুদ্ধে জাতীয় পতাকা অবমাননার অভিযোগ এনে চট্টগ্রামে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা করেন বিএনপির নেতা ফিরোজ খান (পরে বহিষ্কৃত)।
সম্প্রতি বাংলাদেশ সনাতন জাগরণ মঞ্চ ও বাংলাদেশ সম্মিলিত সংখ্যালঘু জোট নামে দুটি সংগঠন ‘বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের’ ব্যানারে কর্মসূচি পালন শুরু করে। নতুন এই জোটের মুখপাত্র করা হয় চিন্ময়কে। গত জুলাই মাসে চিন্ময়কে বহিষ্কার করে ইসকন (আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘ) বাংলাদেশ।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির এএসআই মো. আলাউদ্দিন বলেন, কোর্ট বিল্ডিং এলাকায় মারামারিতে আহত আলিফ নামে এক আইনজীবীকে হাসপাতালে আনা হয়। কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। কোর্ট বিল্ডিং এলাকা থেকে আহত আরো ৬ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (প্রসিকিউশন) মফিজুর রহমান বলেন, সকালে আসামি চিন্ময়কে আদালতে তোলা হলে শুনানি শেষে জামিনের আবেদন নামঞ্জুর করা হয়। তাকে আদালত থেকে কারাগারে নেওয়ার জন্য প্রিজন ভ্যানে তোলা হলে তার অনুসারীরা প্রিজন ভ্যান অবরোধ আশপাশে অবস্থান নেন। বারবার অনুরোধ করা হলেও অবস্থানকারীরা সরে যাননি। পরে বিকেলে পুলিশ, বিজিবি ও সোয়াত তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেওয়ার পর আসামিকে কারাগারে পাঠানো হয়।
চিন্ময় কৃষ্ণের আইনজীবী স্বরূপ কান্তি নাথ বলেন, ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে জামিন নামঞ্জুরের পর মিচ মামলা করে আমরা মহানগর দায়রা জজ আদালতে জামিনের জন্য আবেদন করি। আদালত আবেদনটি আগামীকাল (বুধবার) শুনানির জন্য রেখেছেন। চিন্ময়ের অনুসারীরা সকাল থেকে শান্তিপূর্ণভাবেই আদালত ভবনের নিচতলায় অবস্থান করছিলেন। বিকেলে পুলিশ, বিজিবি বিনা উস্কানিতে সাধারণ সনাতনীদের উপর লাঠিচার্জ ও হামলা করে অনেককে আহত করেন। আদালত ভবনের নিচে এমন হামলা নজিরবিহীন। স্বাধীনতার পর এই প্রথম আদালতে এমন কলঙ্কজনক ঘটনা ঘটলো।
সরেজমিনে দেখা যায়, গত মঙ্গলবার বেলা ১২টা থেকেই শত শত নারী-পুরুষ চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীকে বহন করা প্রিজনভ্যান আটকে স্লোগান দিয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চিন্ময় অনুসারীদের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। এসময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিপুল পরিমাণ সদস্য নির্বিকার দাঁড়িয়ে ছিল। দুপুর দুইটার দিকে পুলিশ অবরোধকারীদের সরানোর চেস্টা করলে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। তখন আদালতপাড়ার নিচতলায় মালখানার পুরনো একট মিনি ট্রাক ও একটি নোহা প্রিজন ভ্যানের সামনে সড়কের উপর এনে অবরোধ সৃষ্টি করেন। অনেক অবরোধকারীকে তখন মাটিতে শুয়ে পড়তে দেখা যায়।
আদালতপাড়ায় উত্তেজনা বেড়ে গেলে চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ মো. সাইফুল ইসলামের চেম্বার মহানগর পিপি অ্যাডভোকেট মফিজুল হক ভুইয়া, চট্টগ্রাম আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আশরাফ হোসেন চৌধুরী রাজ্জাজকে ঢুকতে দেখা যায়। তখন মহানগর দায়রা জজ আদালতের বাইরে শতাধিক চিন্ময়ের আইনজীবী মিচ মামলা শুনানি করার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। তখনই আদালত ভবনের নিচতলায় অবস্থান নেওয়া কয়েকশ পুলিশ, সোয়াত ও বিজিবি সদস্যরা একযোগে বাঁশি বাজিয়ে প্রথমে সাউন্ড গ্রেনেডের বিস্ফোরণ ঘটান। তারপর অবরোধকারীদের ওপর লাঠিচার্জ করে ছত্রভঙ্গ করে দেন।
তিন বাহিনীর ১৫-২০ মিনিটের অ্যাকশনে আদালত ভবনের নিচতলায় থেকে ছত্রভঙ্গ হয়ে যে যেদিকে পেরেছে নিরাপদ স্থানে চলে যায়। আদালত ভবনের পাহাড় থেকে নিচে মূল সড়কে যাওয়ার সময় সড়কের পাশে পার্কিং এ থাকা গাড়ি ভাঙচুর করেন।
ঢাকা ও চট্টগ্রামে ১০ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন: রাজধানী ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরীতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে মোট ১০ প্লাটুন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) মোতায়েন করা হয়েছে। গতকাল বিকেলে বিজিবির পক্ষ থেকে পাঠানো খুদেবার্তায় এ তথ্য জানানো হয়। এতে বলা হয়, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে রাজধানীর শাহবাগ, মৎস্য ভবন ও হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল এলাকায় ৪ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। একই কারণে চট্টগ্রাম মহানগরীতে মোতায়েন করা হয়েছে ৬ প্লাটুন বিজিবি।
এ বিষয়ে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সদর দপ্তরের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. শরীফুল ইসলাম জানান, রাজধানীর শাহবাগ, মৎস্য ভবন ও হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল এলাকায় চার প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। একইসঙ্গে চট্টগ্রাম মহানগরীতেও ছয় প্লাটুন বিজিবি সদস্য আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে দায়িত্ব পালন করবেন।
সুপ্রিম কোর্টে বিক্ষোভ: চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীর মুক্তির দাবিতে চট্টগ্রামে আন্দোলন চলাকালে সংঘর্ষে আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফ নিহতের প্রতিবাদে বিক্ষোভ করেছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীরা। গতকাল সন্ধ্যায় জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের নেতাকর্মীরা সুপ্রিম কোর্ট বার ভবনের সামনে থেকে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করেন। বিক্ষোভ মিছিলটি সুপ্রিম কোর্টের মাজারগেট, কদম ফোয়ারা প্রদক্ষিণ করে বার কাউন্সিলের গেট দিয়ে আবার আদালত অঙ্গনে এসে শেষ হয়। এর আগে ঢাকা জর্জকোটেও একই ইস্যুতে বিক্ষোভ মিছিল করেছেন আইনজীবীরা। দেশের আরও কয়েকটি জায়গায় বিক্ষোভের খবর পাওয়া গেছে।
ভারতের প্রতিক্রিয়া: বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র ও পুণ্ডরীক ধামের অধ্যক্ষ চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীকে গ্রেপ্তারের বিষয়ে বিবৃতি প্রদান করেছে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। গতকাল মঙ্গলবার ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে এই বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র শ্রী চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে গ্রেপ্তার ও তাকে জামিন না দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে আমরা গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছি। বাংলাদেশে হিন্দু ও অন্যান্য সংখ্যালঘুর ওপর উগ্রবাদীদের একাধিক হামলার পর তাকে গ্রেপ্তারের ঘটনা ঘটল।
বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের বাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ; একই সঙ্গে মন্দিরে চুরি ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। এটি খুবই দুঃখজনক যে, এসব ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত তারা ঘুরে বেড়াচ্ছেন। একজন ধর্মীয় নেতা, যিনি শান্তিপূর্ণ সমাবেশের মাধ্যমে বৈধ দাবি দাওয়া পেশ করছেন তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া উচিত নয়।
বিবৃতিতে বলা হয়, এছাড়া চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের গ্রেপ্তারের বিরুদ্ধে যেসব সংখ্যালঘু প্রতিবাদ জানিয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধে হামলা হয়েছে বলেও আমরা জানতে পেরেছি। আমরা বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষকে হিন্দু ও সকল সংখ্যালঘুদের শান্তিপূর্ণ সমাবেশ ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারসহ নিরাপত্তা নিশ্চিত করার আহ্বান জানাই।
ভোরের আকাশ/রন
মন্তব্য