চট্টগ্রামে সরকারি আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফকে হত্যার ঘটনায় সারাদেশ উত্তাল। দেশের সকল আদালত প্রাঙ্গণসহ বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ করেছেন আইনজীবী, ছাত্র-জনতা। সারাদেশে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন সংগঠনের বিক্ষোভ কর্মসূচি থেকে ইসকন নিষিদ্ধের দাবি জানানো হয়েছে। সার্বিক পরিস্থিতিতে গতকাল রাতে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে দলটির ৫ সদস্যের প্রতিনিধি দল। গতকাল বিকেলে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সমাবেশ করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। এছাড়া সুপ্রিম কোর্টসহ দেশের সকল আদালত প্রাঙ্গণে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছেন আইনজীবীরা।
এদিকে চট্টগ্রামের আইনজীবী হত্যার ঘটনায় সরকারের পদক্ষেপ জানতে চেয়েছেন হাইকোর্ট। সিসিটিভির ফুটেজ দেখে আইনজীবী আলিফ হত্যায় জড়িত ৩০ জনকে আটক করেছে পুলিশ। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত পতিত আওয়ামী লীগের ইন্ধনেই ফের দেশকে অস্থিতিশীল করতে অপতৎপরতা চালানো হচ্ছে। গত কয়েকদিনের ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করে দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা এমন অভিমত ব্যক্ত করেছেন। তারা বলছেন, ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতাচ্যূত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে বসে এসব ষড়যন্ত্রের ছক কষছেন। এর অংশ হিসেবে সর্বশেষ মঙ্গলবার ইসকন সদস্যের নির্মমতায় জীবন দিয়েছেন চট্টগ্রামের তরুণ আইনজীবী আলিফ। গতকাল লাখো মানুষের উপস্থিতিতে তার জানাজা সম্পন্ন হয়েছে। সেখানে অংশ নিয়ে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ দেশের কঠিন বিগত আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী সবার মধ্যে ঐক্য সমুন্নত রাখার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করছেন।
জানা গেছে, মঙ্গলবার বিকেলে চট্টগ্রামে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও আইনজীবীদের সঙ্গে সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীর অনুসারীদের সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষের সময় আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফকে কুপিয়ে হত্যা করে ইসকনের পক্ষে বিক্ষোভকারীরা। এরপর সারাদেশে ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু করে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। তারা আইনজীবী আলিফ হত্যার বিচার দাবি ও ইসকন নিষিদ্ধের দাবি জানান সাধারণ মানুষ।
ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি ফর কৃষ্ণ কনশাসনেস (ইসকন) গৌড়ীয় বৈষ্ণব মতবাদের অনুসারী একটি হিন্দু ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান। ১৯৬৬ সালের ১৩ জুলাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক শহরে অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ এই সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করেন। এর সদর দপ্তর ভারতের মায়াপুর।
গতকাল বুধবার সকাল থেকেই আইনজীবী আলিফ নিহতের ঘটনায় দোষীদের গ্রেপ্তার ও বিচারের দাবিতে বিক্ষোভ শুরু হয় চট্টগ্রামে। এতে যোগ দেন হাজার হাজার মানুষ। সকালে চট্টগ্রাম আদালত চত্বরে প্রথম এবং জমিয়তুল ফালাহ মসজিদ মাঠে আইনজীবী সাইফুলের দ্বিতীয় জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এসময় জনসমুদ্রে পরিণত হয় পুরো চট্টগ্রাম নগরী। এ সময় দূর-দূরান্ত থেকে লাখো মানুষকে আইনজীবী সাইফুল ইসলামের জানাজায় যোগ দিতে দেখা যায়। সেখানে হৃদয় বিদারক দৃশ্যের সৃষ্টি হয়।
আদালত চত্বরের প্রথম জানাজায় যোগ দেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ ও জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক সারজিস আলম। সকাল সাড়ে ১১টায় নগরের জামিয়াতুল ফালাহ জামে মসজিদে সাইফুল ইসলামের দ্বিতীয় নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজায় হাসনাত, সারজিস ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফ। জানাজায় উপস্থিত ছিলেন কেন্দ্রীয় জামায়াত নেতা মাওলানা শাহজাহান, বিএনপি নেতা গিয়াস কাদের চৌধুরী, এরশাদ উল্লাহ, সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন প্রমুখ। জানাজার পরে হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, আওয়ামী লীগের এজেন্ট হিসেবে দেশকে অস্থিতিশীল করতে চাচ্ছে ইসকন। উগ্র হিন্দুত্ববাদী এই জঙ্গি সংগঠন সাইফুল ইসলাম আলিফকে কুপিয়ে হত্যা করেছে। ভারতে বসেই স্বৈরাচার হাসিনা যত ষড়যন্ত্র করুক না কেন, আমরা রুখে দেব। বাংলাদেশে সব ধর্মের সহাবস্থান থাকবে। ধর্মের নামে উগ্রবাদীদের এখানে ঠাঁই নেই। ইসকনের বর্বরতা কোনোভাবেই মেনে নেবে না ছাত্রজনতা। তাই অবিলম্বে তাদের নিষিদ্ধ করতে হবে। তিনি বলেন, একের পর এক ঘটনা ঘটিয়ে দেশকে অস্থিতিশীল করতে চাইছে আওয়ামী লীগ।
সারজিস আলম বলেন, দেশের সাধারণ সনাতনীরা শান্তিপ্রিয় মানুষ। কিন্তু স্বৈরাচার হাসিনার দালালরা ইসকনকে উস্কে দিয়ে দেশকে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চাচ্ছে। তবে আমরা বেঁচে থাকতে তা কোনোভাবেই হতে দেব না। ঐক্যবদ্ধভাবে ফ্যাসিবাদের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে সবাইকে। ফ্যাসিবাদদের রুখে দিতে জুলাই আগস্টের মতো আবারও মাঠে থাকবে ছাত্রজনতা। বিএনপি ও জামায়াতসহ বিভিন্ন সংগঠনের নেতাদের মুখেও ছিল দেশকে অস্থিতিশীল করার ষড়যন্ত্র।
এদিকে, চট্টগ্রামে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সরকারের পদক্ষেপ জানতে চেয়েছেন হাইকোর্ট। গণমাধ্যমের প্রতিবেদন উপস্থাপন করে স্বপ্রণোদিত হয়ে ইসকন নিষিদ্ধ ও তিন জেলায় ১৪৪ ধারা জারি করতে আদেশ চান এক আইনজীবী। এই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর হাইকোর্ট বেঞ্চ এ অগ্রগতি জানতে চান। আজ বৃহস্পতিবারের মধ্যে এ বিষয়ে অগ্রগতি জানতে চেয়েছেন আদালত। রাষ্ট্রপক্ষ এ বিষয়ে অগ্রগতি জানাবে।
এ বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান সাংবাদিকদের জানান, একজন আইনজীবী পত্রিকা নিয়ে আদালতের দৃষ্টিতে আনেন সুয়োমোটো রুল ইস্যু করার জন্য। তার আবেদনের মূল প্রতিপাদ্য ছিল-ইসকনকে যেন নিষিদ্ধ করা হয় এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপরে যাতে নির্দেশ দেওয়া হয় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে এই ঘটনাটি তদন্ত করে দোষীদের আইনের আওতায় আনা এবং ইমার্জেন্সি ঘোষণা করা, আগামী অন্তত দুই সপ্তাহ। এই পরিস্থিতিতে আদালত তাকে ডেকে পাঠান। তিনি আদালতকে বলেন, ইসকনের ইস্যুটা দুর্ভাগ্যজনক। যে আইনজীবী এটা এনেছেন তার হৃদয়ে যে রক্তক্ষরণ হচ্ছে, এই রক্তক্ষরণ বাংলাদেশের ১৮ কোটি মানুষের হৃদয়ের। এটা অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা। এই ঘটনা ফৌজদারি অপরাধ। সরকার গুরুত্ব সহকারে এই ঘটনাটিকে দেখছেন, এটার যথাযথ আইনি পদক্ষেপ নেবেন। তিনি আরও বলেন, এই সংগঠন রেজিস্টার্ড কি না, এই সংগঠন নিষিদ্ধ হবে কি না, কী কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে- এই সবগুলো সরকারের পলিসি ডিসিশন। সরকার খোঁজখবর নিয়ে যথাযথ আইনিভাবে এটা দেখবেন। সব কিছু আদালতের সামনে এসে সুয়োমোটো নিষিদ্ধ করতে হবে- এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে আপনাদের (আদালতের) জুডিসিয়াল রিভিউর অ্যাকশনে যাওয়া উচিত হবে না। এটা সাংবিধানিক আইনের সঙ্গে কতটুকু যাবে, এটা বিবেচনা করতে হবে। এটা প্রিম্যাচিউর। তিনি আরও বলেন, দেখেন সরকার কি করছে। সরকার কীভাবে হ্যান্ডেল করছে। সব পর্যালোচনা করে তারপর যদি হয়, তখন প্রোপার ওয়েতে আসলে দেখা যেতে পারে।
এদিকে, চট্টগ্রামে আদালত চত্বরে চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীর অনুসারীদের হাতে খুন হওয়া সহকারী সরকারি কৌঁসুলি সাইফুল ইসলাম আলিফ হত্যার ঘটনায় আইনি অগ্রগতি জানিয়েছে প্রধান উপদেষ্টা কার্যালয়। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে এক বার্তায় বলা হয়েছে, সিসিটিভির ভিডিও দেখে সন্দেহভাজন অন্তত ছয় জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। জানা গেছে, এ ঘটনায় মঙ্গলবার রাত থেকে যৌথবাহিনী অভিযানে নেমে এ পর্যন্ত মোট ৩০ জনকে গ্রেপ্তার করেছে।
ইসকন নেতা চিন্ময় কৃষ্ণ দাস সোমবার ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে যাওয়ার উদ্দেশে বিমানবন্দর আসলে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। বাংলাদেশ পুলিশের বিশেষায়িত গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) তাকে গ্রেপ্তার করে। গত ৫ আগস্টের পর দেশে সনাতন ধর্মাবলম্বীর নামে কয়েক দফা সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সেসব সমাবেশ থেকে চিন্ময় কৃষ্ণ দাস বর্তমান সরকারের উদ্দেশে নানা ধরনের হুমকি-ধমকি দিয়ে বক্তব্য দেন। এর আগে থেকে তিনি আলোচনায় থাকলেও গত ২৫ অক্টোবর বিকালে চট্টগ্রাম নগরের লালদীঘি মাঠে ৮ দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে সমাবেশের বেশি আলোচনায় আসেন।
তার বিরুদ্ধেই দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করার অভিযোগ রয়েছে। বিভিন্ন সময় তিনি উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়ে থাকেন। গত ৩০ অক্টোবর চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীসহ ১৯ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হয়। জাতীয় পতাকা অবমাননার অভিযোগে রাষ্ট্রদ্রোহ আইনে এ মামলা দায়ের হয়। ফিরোজ খান নামে এক ব্যক্তি বাদী হয়ে নগরীর কোতোয়ালি থানায় মামলাটি দায়ের করেছিলেন।
ইসকন নিষিদ্ধে ১০ আইনজীবীর লিগ্যাল নোটিশইসকনকে নিষিদ্ধ ও রাষ্ট্রীয় আইন কর্মকর্তা অ্যাডভোকেট সাইফুল ইসলামকে হত্যাকারীদের বিচারের আওতায় আনতে লিগ্যাল নোটিশ দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আল মামুন রাসেল। গতকাল ১০ আইনজীবীর পক্ষে তিনি এ নোটিশ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, আইন ও বিচার মন্ত্রণালয় ও পুলিশের মহাপরিদর্শক বরাবর ডাকযোগে পাঠান। নোটিশ পাঠানো আইনজীবীরা হলেন- মফিজুর রহমান মোস্তাফিজ, নিজাম উদ্দিন, আব্দুল হান্নান ভূঞাঁ হৃদয়, তৌহিদুল ইসলাম শান্ত, আতিকুল ইসলাম, মাসুম বিল্লাহ, রাসেল মাহমুদ, আব্দুল্লাহ আল মামুন, মাহফুজুর রহমান ও আল মোমেন। নোটিশে বলা হয়, ‘ইসকন একটি উগ্রপন্থি সংগঠন হিসেবে বাংলাদেশে দীর্ঘদিন যাবৎ তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। এই সংগঠনের প্রধান কাজ হচ্ছে বাংলাদেশে উসকানিমূলক ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করা, যার উদ্দেশ্য হচ্ছে- সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টি। (বই- বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থার সাবেক প্রধানদের কথা- বাংলাদেশে ‘র’ পৃষ্ঠা : ১৭১)। এ সংগঠনটি হিন্দুদের অধিকাংশ বেসিক কনসেপ্ট স্বীকার করে না। তারা হিন্দুদের ওপর সম্পূর্ণ নিজস্ব কনসেপ্ট চাপিয়ে দেয়। এরা নিম্নবর্ণের হিন্দুদের দলে ভিড়িয়ে দল ভারি করে। সনাতন মন্দিরগুলো দখল করা এবং সনাতনদের মেরে পিটিয়ে তাড়িয়ে দেওয়া। বাংলাদেশের মসজিদগুলোতে সাম্প্রদায়িক হামলা করা। কিছুদিন আগে ঢাকার স্বামীবাগে মসজিদের তারাবির নামাজ বন্ধ করে দিয়েছিল ইসকন। নামাজের সময় ইসকনের গান-বাজনা বন্ধ রাখতে বলায়- তারা পুলিশ ডেকে এনে তারাবির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। পরে বিষয়টি নিয়ে সংঘর্ষ হয়। বাংলাদেশে বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক সংগঠন তৈরি করে, উগ্র হিন্দুত্ববাদের বিস্তৃতি ঘটানো।’
ভারতের বিবৃতির কড়া জবাব বাংলাদেশেরচিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীকে গ্রেপ্তার নিয়ে ভারতের প্রতিক্রিয়ার কড়া জবাব দিয়েছে বাংলাদেশ। গত মঙ্গলবার ঢাকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এ বিবৃতিতে দেওয়া হয়। এতে বলা হয়, ‘চিন্ময় ইস্যুতে ভারতের বিবৃতি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের শামিল’। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, অত্যন্ত হতাশার সঙ্গে বাংলাদেশ সরকার উল্লেখ করেছে যে শ্রী চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে নির্দিষ্ট অভিযোগে গ্রেপ্তার করার পর থেকে তার গ্রেপ্তারকে কিছু মহল ভুলভাবে ব্যাখ্যা করছে। বাংলাদেশ সরকার বলতে চায়, এই ধরনের ভিত্তিহীন বিবৃতি শুধু সত্যকে বিকৃত করে না বরং দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে বন্ধুত্ব ও বোঝাপড়ার চেতনার পরিপন্থি। বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে গত মঙ্গলবার গণমাধ্যমে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জারি করা একটি বিবৃতি বাংলাদেশ সরকারের নজরে এসেছে। বিবৃতিতে বলা হয়, অত্যন্ত হতাশা এবং গভীর দুঃখের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকার উল্লেখ করছে যে শ্রী চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে নির্দিষ্ট অভিযোগে গ্রেপ্তার করার পর থেকে তার গ্রেপ্তারকে কিছু মহল ভুলভাবে ব্যাখ্যা করছে। বাংলাদেশ সরকার বলতে চায়, এই ধরনের ভিত্তিহীন বিবৃতি শুধু সত্যকে বিকৃত করে না বরং দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে বন্ধুত্ব ও বোঝাপড়ার চেতনার পরিপন্থি।
ভারতের বিবৃতিটি সকল ধর্মের জনগণের মধ্যে বিদ্যমান সম্প্রীতি এবং এই বিষয়ে সরকার ও জনগণের প্রতিশ্রুতি এবং প্রচেষ্টাকে প্রতিফলিত করে না বলেও মন্তব্য করে বাংলাদেশের বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশে জনগণের ওপর গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিচারহীনতার যে সংস্কৃতি চলে আসছিল তা সমাপ্ত করার বিষয়ে সরকারের যে দৃঢ়প্রতিজ্ঞা রয়েছে এবং সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘুদের একই নজরে দেখার যে দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে, ভারতের বিবৃতি সেটি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেছে। বিবৃতিতে আরও বলা হয়, বাংলাদেশ দৃঢ়ভাবে নিশ্চিত করে যে, প্রত্যেক বাংলাদেশির, তার ধর্মীয় পরিচয় নির্বিশেষে, নিজ নিজ ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান প্রতিষ্ঠা, বজায় রাখা বা পালন করার বা বাধা ছাড়াই মতামত প্রকাশ করার অধিকার রয়েছে। সকল নাগরিকের, বিশেষ করে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা বাংলাদেশ সরকারের একটি দায়িত্ব। গত মাসে বাংলাদেশে শান্তিপূর্ণভাবে দুর্গাপূজা পালনের মাধ্যমে এটি আবারও প্রমাণিত হয়েছে। এতে আরও বলা হয়, বাংলাদেশ সরকার আবারও বলতে চায় যে, দেশের বিচার বিভাগ সম্পূর্ণ স্বাধীন এবং এটি বিচার বিভাগের কাজে হস্তক্ষেপ করে না। প্রশ্নাধীন বিষয়টি বর্তমানে আদালতে বিচারাধীন। বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশ সরকারও দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি সমুন্নত রাখতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। চট্টগ্রামে অ্যাডভোকেট সাইফুল ইসলাম আলিফের নৃশংস হত্যাকাণ্ডে বাংলাদেশ সরকার গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। যেকোনো মূল্যে ধর্মীয় সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য কর্তৃপক্ষ বন্দরনগরীতে নিরাপত্তা জোরদার করেছে।
এর আগে চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের গ্রেপ্তারে উদ্বেগ প্রকাশ করে ভারত সরকার এক বিবৃতি দেয়। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতন জাগরণ জোটের মুখপাত্র শ্রী চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে গ্রেপ্তার ও জামিন নাকচ করার বিষয়টি আমরা গভীর উদ্বেগের সঙ্গে দেখছি। বাংলাদেশের হিন্দু ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের ওপর একাধিক হামলার পরে এ ঘটনা ঘটলো। বিবৃতিতে আরও বলা হয়, এই ঘটনার অপরাধীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকলেও একজন ধর্মীয় নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগ চাপানো হয়েছে; যিনি শান্তিপূর্ণ সমাবেশের মাধ্যমে ন্যায্য দাবিগুলো উপস্থাপন করেছিলেন। হিন্দুসহ সব সংখ্যালঘুর নিরাপত্তা, শান্তিপূর্ণ সমাবেশ ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিতে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানানো হয় বিবৃতিতে।
কংগ্রেসের বিবৃতিচিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীকে গ্রেপ্তারের ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ভারতের বিরোধী রাজনৈতিক দল কংগ্রেস। একই সঙ্গে বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ‘নিরাপত্তাহীনতা’ নিয়েও দলটির পক্ষ থেকে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। গতকাল কংগ্রেসের মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিসিটি বিভাগের চেয়ারম্যান পবণ খেরা এক বিবৃতিতে এই উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, ভারত সরকার বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানাবে বলে প্রত্যাশা করছে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস। পবন খেরা আরও বলেন, ‘বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তাহীনতার পরিবেশ নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছে কংগ্রেস। ইসকন সন্ন্যাসীকে গ্রেপ্তারের ঘটনা এই নিরাপত্তাহীনতার সর্বশেষ উদাহরণ।’
গত কয়েকদিনের ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় প্রতিদিন কোনো বিষয়ে বিশেষ করে রাজধানীতে দাবি আদায়ের নামে বিশৃঙ্খলা করা হচ্ছে। পতিত আওয়ামী লীগের অপতৎপরতায় দেশকে অস্থিতিশীল করতে এসব বিশৃঙ্খলায় ঘটানো হচ্ছে। জানা গেছে- ১৮ নভেম্বর রাজধানীর সরকারি তিতুমীর কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় করার দাবিতে মহাখালীতে সড়ক ও রেলপথ অবরোধ করেন রেখেছেন শিক্ষার্থীরা। অবরোধ চলাকালে নোয়াখালী থেকে ঢাকাগামী আন্তনগর ট্রেন উপকূল এক্সপ্রেস মহাখালী রেলক্রসিং অতিক্রম করার সময় সেটি থামানোর চেষ্টা করা হয়। কিন্তু ট্রেনটি না থেমে গতি কমিয়ে চলতে থাকলে সেটি লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করা হয়। এতে ট্রেনের কয়েকটি জানালার কাঁচ ভেঙে গেছে, রক্তাক্ত হয়েছেন নারী, শিশুসহ অনেক যাত্রী।
২১ নভেম্বর বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই রাজধানীর আগারগাঁও, কল্যাণপুর, গাবতলী, টেকনিক্যাল, মহাখালী, মোহাম্মদপুর, পল্লবী, ডেমরা এলাকায় সড়ক বন্ধ করে দেয় অটোরিকশা চালকরা। অটোরিকশা বন্ধের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে তারা ওই অবরোধ করেন।
গত ১৬ নভেম্বর মোল্লা কলেজের শিক্ষার্থী অভিজিৎ হাওলাদার ডেঙ্গু জ্বর নিয়ে ঢাকা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে ভর্তি হয়। ১৮ নভেম্বর তার মৃত্যু হয়। ওইদিন রাতে তার পরিবার ও কলেজের কিছু শিক্ষার্থী ভুল চিকিৎসায় তার মৃত্যু হয়েছে অভিযোগ করে হাসপাতালে ভাঙচুর চালায়। ২০ নভেম্বর পুনরায় ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের ৫০০-৬০০ শিক্ষার্থী ওই হাসপাতালে এসে ভাঙচুর চালায়।
২৪ নভেম্বর দুপুর ২টার দিকে ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের শিক্ষার্থীরা ঢাকা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে পুনরায় ভাঙচুর চালায়। একপর্যায়ে তারা শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ ও কবি নজরুল কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায়। এরপর প্রতিষ্ঠানে ব্যাপক ভাঙচুর ও লুটপাট চালায়। ৩৫টি বিভিন্ন কলেজ শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে ইউনাইটেড কলেজ অব বাংলাদেশ (ইউসিবি) নামে একটি ফোরাম গঠিত হয়। এ ঘটনার জের আরো দুদিন চলে।
এছাড়া ২৪ নভেম্বর অন্তর্বর্তী সরকার গরিব মানুষদের এক থেকে পাঁচ লাখ টাকা ঋণ দেবে- এমন প্রলোভনে সারা দেশ থেকে লাখো মানুষকে ঢাকায় জড়ো করা হচ্ছিল! ‘অহিংস গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশ’ এর ব্যানারে বিভিন্ন এলাকা থেকে বাস, ট্রাক, পিকআপে করে মানুষ জড়ো হতে থাকেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় টিএসসি এবং শাহবাগ এলাকায়। তবে পুলিশ এবং শিক্ষার্থীরা তাদের ফেরত পাঠায়।
দাবি আদায়ের নামে প্রতিটি কর্মসূচি বাস্তবায়নে পতিত আওয়ামী লীগ, তার অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাদের ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালাতে দেখা গেছে।
ভোরের আকাশ/রন
মন্তব্য