-->

চারদিকে ঐক্যের ডাক, নেই উদ্যোক্তা

এম. সাইফুল ইসলাম
চারদিকে ঐক্যের ডাক, নেই উদ্যোক্তা

চট্টগ্রামে আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফ হত্যার ঘটনার পর ফের জাতীয় ঐক্যের ডাক উঠেছে চারদিক থেকে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের পাশাপাশি দীর্ঘদিন থেকে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে রাজপথে আন্দোলনকারী রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে সকলকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানানো হয়েছে। জামায়াত ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান ও সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ারও সম্প্রতি সব অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে গড়ে উঠা ছাত্র-জনতার ঐক্য ধরে রাখতে গুরুত্বারোপ করেছেন। শুধুই আইনজীবী আলিফ হত্যার পর নয়, দেশে নানা কায়দায় ফ্যাসিবাদের মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার পাঁয়তারা হলেই ঐক্যের ডাক পড়ছে। ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ ও তার দোসরবিরোধী সবাই জাতীয় ঐক্যের কথা বললেও দৃশ্যত এক টেবিলে বসতে কারো উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। বিএনপি ও জামায়াতের নেতারা বলছেন, তাদের ঐক্যে তেমন কোনো ভাঙন বা বিচ্ছদের সুর নেই। ঐক্য বজায় রাখতে আগের মতোই ভবিষ্যতেও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ অব্যাহত রাখা হবে। তারা বলছেন, পতিত আওয়ামী লীগ ও পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের অপতৎপরতা ঠেকাতে সামনে আরো কঠিন ঐক্য দরকার। কিন্তু সেই ঐক্যবদ্ধ করার উদ্যোক্তা পাওয়া যাচ্ছে না। কার্যত ‘বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধা’র ভূমিকায় কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না।

জাতীয় নাগরিক কমিটি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা বলছেন, দেশের স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সরকার সবাইকে নিয়ে বসে ঐক্য সুদৃঢ় করার উদ্যোগ নিতে পারে। আর এক্ষেত্রে সরকারের পাশাপাশি দেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপিসহ অন্যরা বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে। এছাড়া নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরাও অভিভাবকেরা ভূমিকা রাখতে পারেন। কিন্তু সেই উদ্যোগ কেউ নিচ্ছে না।

ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে নানামুখী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে। বিশেষ করে সরকার গঠনের পর থেকে প্রতিদিন কোনো না কোনো বিষয় নিয়ে দাবি আদায়ে রাজপথে নামে কোনো না কোনো সংগঠন। প্রথমদিকে বিষয়টিকে নিছক দাবি আদায়ে ওইসব সংগঠন মাঠে নেমেছে ভাবলেও এখন সেটিকে দেখা হচ্ছে ভিন্নভাবে। বিশেষ করে দাবি আদায়ের নামে সড়ক অবরোধ, স্থাপনায় হামলা ও ভাঙচুরের মধ্য দিয়ে বিশেষ বার্তা পাচ্ছেন দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের নেতারা। গত কয়েদদিনের ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় প্রতিদিন কোনো বিষয়ে বিশেষ করে রাজধানীতে দাবি আদায়ের নামে বিশৃঙ্খলা করা হচ্ছে। পতিত আওয়ামী লীগের অপতৎপরতায় দেশকে অস্থিতিশীল করতে এসব বিশৃঙ্খলায় ঘটানো হচ্ছে। সবশেষ মঙ্গলবার বিকেলে চট্টগ্রামে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও আইনজীবীদের সঙ্গে সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীর অনুসারীদের হামলায় আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফকে কুপিয়ে হত্যাও ছিল ধারাবাহিক ঘটনার অংশ বিশেষ।

ওই ঘটনার পর আইনজীবী আলিফকে চিন্ময়ের আইনজীবী হিসেবে দাবি করে ভারতীয় গণমাধ্যমে যে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছেও সেটিও ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে দেখছেন দেশের বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীরা। চট্টগ্রামে আইনজীবী হত্যার পর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, ইস্পাত কঠিন ঐক্যের বিকল্প নেই। গত বুধবার রাতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে দলটির ৫ সদস্যের প্রতিনিধি দল। বৈঠক শেষে মির্জা ফখরুল বলেছেন, আমরা দেশের সার্বিক পরিস্থিতিতে উদ্বিগ্ন। বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ক্রমেই নাজুক হয়ে পড়ছে। আমরা বলেছি, এটি শক্তভাবে মোকাবিলা করতে হবে। চলমান অবস্থান জাতীয় ঐক্যর ওপর গুরুত্বারোপ করেন বিএনপি মহাসচিব। তিনি বলেছেন, চলমান এ প্রেক্ষাপটে ঐক্যের কোনো বিকল্প নেই। গতকালও বিএনপি মহাসচিব জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক অনুষ্ঠানে ভারতীয় মিডিয়ার সমালোচনা করে বলেছেন, বুধবার রাতে ভারতবর্ষের মিডিয়ার কয়েকজন ফোন দিয়ে তাকে একটাই প্রশ্ন করেছেন, ইসকনের ব্যাপারে আপনারা কী করছেন? এই প্রশ্নটা একেবারেই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, তারা এখানে একটা অবস্থা সৃষ্টি করতে চায়। প্রথমবার ফেল করেছে, এখন আবার নতুন করে সে অবস্থাটা সৃষ্টি করতে চায়। এই ব্যাপারে আমাদের সজাগ থাকতে হবে। তিনি বলেন, আমাদের সবারই উচিত, অনৈক্য সৃষ্টি না করে ঐক্যের মধ্যে থেকে সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে অত্যন্ত কিছুটা হলেও সামনে এগিয়ে যাই।

জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান গতকাল সন্ধ্যায় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক শেষে বলেছেন, বিএনপিসহ সকলেই জাতীয় ঐক্য বজায় রাখতে একমত হয়েছেন।

গত কয়েকদিন থেকে একাধিক কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা জাতীয় ঐক্য সুদৃড় করতে জোর দিয়েছেন। তারা বলছেন, এই মুহূর্তে ঐক্যের কোনো বিকল্প নেই। বুধবার চট্টগ্রামে আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফের জানাজায় অংশ নিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, বিভিন্ন সংগঠনের নামে আওয়ামী লীগের এজেন্টরা দেশকে অস্থিতিশীল করতে চাইছে। ভারতে বসেই স্বৈরাচার হাসিনা এসব অস্থিতিশীল তৎপরতার ইন্ধন দিচ্ছেন। যেকারণে এখন আওয়ামী লীগবিরোধী সব শক্তিকে আবার ঐক্য মজবুত করতে হবে।

একই অনুষ্ঠানে সমন্বয়ক সারজিস আলম বলেন, স্বৈরাচার হাসিনার দালালরা ইসকনসহ নানা সংগঠনকে উস্কে দিয়ে দেশকে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চাচ্ছে। তবে আমরা বেঁচে থাকতে তা কোনোভাবেই হতে দেব না। ঐক্যবদ্ধভাবে ফ্যাসিবাদের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে সবাইকে। ফ্যাসিবাদদের রুখে দিতে জুলাই আগস্টের মতো আবারও মাঠে থাকবে ছাত্রজনতা।

অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পরপরই কিছুই সরকারের মেয়াদকাল, জাতীয় নির্বাচন ও সংস্কার ইস্যু নিয়ে আন্দোলনকারী সংগঠনগুলোর মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য পাওয়া গেছে। কিন্তু হঠাৎ করেই দেশে এখন চরম অস্থিরতা সৃষ্টির পর চারদিকে ফের জাতীয় ঐক্য ধরে রাখতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পাশাপাশি আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে রাজপথে আন্দোলনকারী রাজনৈতিক দলগুলো জোর দিচ্ছে। তবে, বিষয়টিতে জোর দিলেও দৃশ্যত এককাতারে বসতে কারো উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। তাহলে উদ্যোক্তা হিসেবে এ দায়িত্ব কে নেবে? এমন প্রশ্ন এখন সর্বমহলে।

এ প্রশ্নের উত্তর জানতে জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব ও সাবেক ডাকসু নেতা আখতার হোসেন দৈনিক ভোরের আকাশকে বলেন, দেশের একজন নাগরিক হিসেবে সবারই দায়িত্ব ফ্যাসিবাদমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে আওয়ামী লীগবিরোধী যে ঐক্য গড়ে উঠেছে তা ধরে রাখা। কারণ, নিজেদের মধ্যে অনৈক্যের সৃষ্টি হলে ফের স্বৈরাচার সুযোগ নিতে পারে। তিনি বলেন, বর্তমান সরকারের পাশাপাশি বৃহৎ রাজনৈতিক দল হিসেবে এক্ষেত্রে বিএনপি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখ্য সংগঠক আব্দুল হান্নান মাসুদ দৈনিক ভোরের আকাশকে বলেন, আমরা সব সময় ঐক্য চেয়েছি। সবাই মিলেই ঐক্য বজায় রাখতে হবে দেশ ও মানুষের স্বার্থে। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কোনো আন্দোলনকারী সংগঠনগুলোতে কোনো অনাক্যৈ নেই বলেও দাবি করেন তিনি।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী দৈনিক ভোরের আকাশকে বলেন, বিএনপি সবসময় আওয়ামী লীগ তথা স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে ঐক্য গড়তে কাজ করে এসেছে। জুলাই-আগস্ট আনেন্দালনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরও ওই আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী সবার সঙ্গে আমরা বসেছি। মাঝে-মধ্যেই আমরা বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে বসে বৈঠক করছি। বিএনপি তার দায়িত্ব থেকেই এটি অব্যাহত রাখবে। আওয়ামী লীগ ঠেকানোর প্রশ্নে কারো সঙ্গে বিভেদ নেই বলেও মনে করেন তিনি।

বাংলাদেশ জামায়াত ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আব্দুল হালিম বলেন, জামায়াত সব সময় ঐক্য বজায় রাখতে কাজ করেছে। এখনো সেটি করে যাচ্ছে। জাতীয় ঐক্য বজায় রাখতে আমাদের যা করা দরকার তাই করবো ইনশাল্লাহ।

ভোরের আকাশ/ সু

মন্তব্য

Beta version