আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে প্রতি বছর প্রায় ১৪ বিলিয়ন ডলার পাচার করা হয়েছে। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে গঠিত আর্থিক খাতের শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রতিবেদনে এ কথা বলা হয়েছে। যদিও প্রতিবেদনটি আগামীকাল রোববার প্রকাশ করার কথা, এরই মধ্যে প্রতিবেদনের কপি বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের কাছে পৌঁছে গেছে। তবে পাচার করা অর্থের পরিমাণ এবং গবেষণার পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন দেশের প্রখ্যাত দুইজন অর্থনীতিবিদ। তাদের একজন বলছেন, আন্তর্জাতিক গবেষণা অনুসারে বাংলাদেশ থেকে বছরে সর্বোচ্চ ৮ বিলিয়ন ডলার পাচার করা সম্ভব।
দুদিন আগে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছিলেন, রোববার প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের হাতে অর্থনীতি নিয়ে তৈরি করা শ্বেতপত্র তুলে দেওয়া হবে। সেটি সংবাদ সম্মেলন করে সোমবার প্রকাশ করা হবে।
ভোরের আকাশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনৈতিক গবেষণা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক এম এম আকাশ বলেন, মূলত চারভাবে দেশ থেকে অর্থ পাচার করা হয়—আন্ডার ইনভয়েস, ওভার ইনভয়েস, এক্সপোর্ট এবং হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ পাচার হয়। বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার হয়েছে, এ নিয়ে সন্দেহ নেই। তবে পরিসংখ্যানের তারতম্য হতে পারে। জিআইএফের গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে প্রতিবছর অর্থ পাচার করা হয়েছে প্রায় ১০ থেকে ১৫ বিলিয়ন ডলার। এখন দেখতে হবে সিপিডি কোন ম্যাথডোলজি ব্যবহার করেছে। তাদের মূল ফাইন্ডিংসটা কী—তা না দেখে বেশি মন্তব্য করা ঠিক হবে না।
এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সাহাদাত হোসেন সিদ্দিকী ভোরের আকাশকে বলেন, অর্থ পাচার সবদেশেই কম-বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশ থেকেও তথ্য পাচার হয়েছে—এটা যেমন ঠিক, তেমনি এটাও সত্য যে সিপিডি ডায়ালগ তৈরির জন্যই গবেষণা করে। আমার প্রশ্ন হলো, প্রতিবছর ১৪ বিলিয়ন ডলার পাচার করার সক্ষমতা বাংলাদেশের আছে কি না? অথবা সম্ভব কি না? গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইনটিগ্রিটির গবেষণায় একবার বলা হয়েছিল, বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর সর্বোচ্চ ৮ বিলিয়ন ডলার পাচার করা সম্ভব। যেহেতু আমাদের দেশে এ ধরনের তথ্য সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা নেই, সেহেতু আসল হিসেব মেলানো কঠিন। তারপরও সিপিডি তার গবেষণায় কোন পদ্ধতি ব্যবহার করেছে, তার স্পষ্টীকরণ করা জরুরি। এটি না হলে জনমনে বিভ্রান্তি তৈরি হতে পারে। অন্যদিকে, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সম্মানীয় ফেলো ড. মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, সংবাদ সম্মেলনে আমরা আমাদের যাবতীয় তথ্য উপস্থাপন করবো। এসময় উন্মুক্ত অংশে যে কেউ যেকোনো প্রশ্ন করতে পারবে এবং আমরা সেসব প্রশ্নের উত্তর দিব এবং সেই সঙ্গে গবেষণার সীমাবদ্ধতার কথাও জানানো হবে।
গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ২৮ আগস্ট দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক চিত্র জানতে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে ১২ সদস্যের শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি গঠিত হয়। ৯০ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয় কমিটিকে।
জানা যায়, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি, সরকারি নথি ও বৈশ্বিক প্রতিবেদন ব্যবহার করে অর্থ পাচারের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে শ্বেতপত্রে। তবে সময় স্বল্পতার কারণে অর্থ পাচারের প্রকৃত পরিমাণ নির্ধারণ করতে পারেনি কমিটি। কীভাবে অর্থ পাচার হয় এবং কীভাবে তা বন্ধ করা যায়, সে বিষয়ে পর্যবেক্ষণ তুলে ধরা হয়েছে প্রতিবেদনে।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য জানা যায় না। তবে গবেষণা ও ধারণাভিত্তিক কিছু তথ্য দিয়ে আসছে বিভিন্ন সংস্থা। সম্প্রতি রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, বিভিন্ন ঘটনার ভিত্তিতে ধারণা করা যায়, বাংলাদেশ থেকে বছরে গড়ে ১২ থেকে ১৫ বিলিয়ন ডলার সমপরিমাণ অর্থ পাচার হয়েছে।
শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, শ্বেতপত্রে দেশের অর্থনীতির প্রকৃত চিত্রটিই তুলে ধরা হয়েছে। ‘বাংলাদেশের অর্থনীতির অবস্থা নিয়ে শ্বেতপত্র’ শীর্ষক ২৫০ পৃষ্ঠার এই প্রতিবেদনে থাকছে অর্থনীতির নানা দিক নিয়ে ২২টি অধ্যায়।
এতে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতি, ব্যাংক খাত, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের পরিস্থিতি, বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্য, সরকারের ঋণ, পরিসংখ্যানের মান, বাণিজ্য, রাজস্ব আয়, ব্যবসার পরিবেশ, দারিদ্র্য ও বৈষম্যসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। পদ্মা সেতু, রেল সংযোগ, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, মাতারবাড়ি বিদ্যুৎকেন্দ্র, কর্ণফুলী টানেলসহ মেগা প্রকল্পগুলোর ওপরও থাকছে বিশ্লেষণধর্মী পর্যবেক্ষণ।
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে গঠিত শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন—সিপিডির সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান, বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক লিড ইকনোমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন, জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. ম তামিম, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির বিজনেস অ্যান্ড ইকোনমিকস ফ্যাকাল্টির ডিন অধ্যাপক এ কে এনামুল হক, বিজনেস ইনিশিয়েটিভ লিডিং ডেভেলপমেন্টের (বিল্ড) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফেরদৌস আরা বেগম, জনশক্তি রপ্তানি বিশেষজ্ঞ তাসনিম সিদ্দিকী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সেলিম রায়হান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ আবু ইউসুফ, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. কাজী ইকবাল, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক শারমিন্দ নীলোর্মি এবং ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) নির্বাহী পরিচালক ইমরান মতিন।
ভোরের আকাশ/রন
মন্তব্য