-->

বিএনপির ভারতবিরোধী বার্তার নেপথ্যে কী

এম. সাইফুল ইসলাম
বিএনপির ভারতবিরোধী বার্তার নেপথ্যে কী

বাংলাদেশে কথিত সংখ্যালঘু নির্যাতন ও ইসকন নেতা চিন্ময় দাসকে গ্রেফতার ইস্যুকে কেন্দ্র করে হঠাৎ করে ভারতের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি। ভারতের সাম্প্রতিক ভূমিকায় প্রথমদিকে কিছুটা নমনীয় থাকলেও এখন বিএনপি নেতারা বেশ জোরেসারেই ভারতবিরোধী বক্তব্য দিচ্ছেন। এরই ধারাবাহিকতায় বিএনপির সিনিয়র যুগ্মমহাসচিব রুহুল কবির রিজভী গত রোববার ভারতের বিরুদ্ধে এক কঠোর বিবৃতি দিয়েছেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষা ও বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ইস্যুতে ভারতের অযাচিত হস্তক্ষেপের অপচেষ্টার বিরুদ্ধে বিএনপির এই অবস্থানকে ইতিবাচকভাবেই দেখছেন সংশ্লিষ্টরা।

বিএনপির ভারতের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানের কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে করা, পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দেওয়া ও গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশের তরুণ সমাজের ভারতবিরোধী মনোভাবকে প্রাধান্য দিতেই বিএনপির এই অবস্থান।

বিএনপির নেতারা বলছেন, সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব নীতি নিয়ে চললেও বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব ও মানুষের স্বার্থ রক্ষায় বিএনপি সবসময় সোচ্চার। সেই জায়গা থেকে তারা সম্প্রতি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ইস্যুতে ভারতের হস্তক্ষেপের চেষ্টার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। বৃহৎ রাজনৈতিক দল হিসেবে দেশের মানুষের চাওয়াকে প্রধান্য দিচ্ছে বিএনপি।

গণঅভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পালিয়ে ভারতে যান। তিনি এখনও সেখানেই অবস্থান করছেন। শেখ হাসিনাকে ভারত শুধুমাত্র আশ্রয় দিয়েই ক্ষ্যন্ত হয়নি। আওয়ামী লীগের পতনের পর কথিত সংখ্যালঘু নির্যাতনের অভিযোগ তুলে প্রথম থেকেই বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে শুরু করে ভারত। বিষয়টি নিয়ে ভারতের একাধিক গণমাধ্যম ভিত্তিহীন সংবাদ প্রচার করে যাচ্ছে। এরপর সম্প্রতি বহিষ্কৃত ইসকন নেতা চিন্ময় দাসকে গ্রেপ্তার ইস্যুতে বেশ সরব হয় ভারত সরকার। সরকারের পক্ষে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর ও পররাষ্ট্র মুখপত্র বিষয়টি নিয়ে কথা বলেন। পাশাপাশি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র এ বিষয়ে বিবৃতি দেয়। ভারত সরকার ও দেশটির মিডিয়ার অপপ্রচারের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে কড়া প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। দিল্লির অবস্থানকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের সামিল বলেও অভিহিত করা হয়।

ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পাশাপাশি দেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি বিষয়টি কড়া প্রতিবাদ জানায়। দলটির নেতারা সম্প্রতির সভা-সেমিনারের ভারতের অবস্থানের বিরুদ্ধে জোরেসারে বক্তব্য দেয়। খোদ বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমীর থেকে শুরু কওে জেষ্ঠ্য নেতারা ভারতবিরোধী স্পষ্ট বক্তব্য দেন। মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ দলটির নেতারা বলেছেন, বাংলাদেশর অভ্যন্তরীণ ইস্যুতে ভারতের বিবৃতি আসলে কূটনৈতিক শিষ্টাচার বর্হিভূত। গণতান্ত্রিক দল হিসেবে অন্য কোনো দেশ আমাদের দেশে হস্তক্ষেপ করবে বিএনপি সেটি মেনে নেবে না। এছাড়া রক্তক্ষয়ী গণঅভ্যুত্থানের পর শেখ হাসিনাকে জায়গা দিয়ে ভারত আবারো এদেশের মানুষের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। শেখ হাসিনা ভারতে থেকে বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করে তোলার চেষ্টা করছেন।

এমন পরিস্থিতিতে বিএনপি কিছুটা নমনীয় আচরণ করলেও দীর্ঘদিন পর হঠাৎ কঠোর ভারতবিরোধী নীতির নেপথ্যে আসলে কী। অনেকেই বলতে, চাইছেন সামনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এ নির্বাচনে ভোটার টানার প্রশ্নে দলটি তরুণদের ভারতবিরোধী মনোভাবকে নিজেদের পক্ষে নেওয়ার চেষ্টা করছে। এছাড়া গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশে ভারতের দীর্ঘদিনের অবস্থানের বিরুদ্ধে রয়েছে দেশের বেশিরভাগ মানুষ। সেটিও বিএনপি মাথায় নিয়েছে। আর দীর্ঘদিন চেষ্টা করেও বিএনপি যে ভারতের কোনো সহযোগিতা পায়নি দলটির সে ক্ষোভও রয়েছে।

গত ১ ডিসেম্বর বোরবার বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহসিচিব রুহুল কবির রিজভী গণমাধ্যমে একটি বিবৃতি দেন। সেই বিবৃতিতে রিজভী ভারতের অবস্থানের কড়া প্রতিবাদ জানান। ওই বিবৃতির পর বিএনপিকে ধন্যবাদ জানান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ। রোববার সামাজিকমাধ্যম ফেসবুকে নিজের ভেরিফায়েড পেজে বিএনপির একটি বিবৃতি শেয়ার করে এ ধন্যবাদ জানান তিনি।

এদিকে, গতকাল সোমবার ভারতে বাংলাদেশ মিশনে হামলা ও বাংলাদেশে শান্তি সেনা পাঠাতে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী যে বক্তব্য দিয়েছেন তার প্রতিবাদ জানিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব।

এ বিষয়ে বিএনপি ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু দৈনিক ভোরের আকাশকে বলেন, বাংলাদেশের জনগণ কখনো ফ্যাসিবাদ মেনে নেয় না। ইতোমধ্যে ফ্যাসিবাদ শেখ হাসিনাকে বিতাড়িত করেছে। এই কথাটি যদি পার্শ্ববর্তী দেশ মাথায় রাখে তাহলে মীমাংসা তাড়াতাড়ি হবে। তা না হলে যত খোঁচাখুঁচি করবে তত শত্রুতা বাড়বে। এটা উভয় দেশের জন্য ভালো না। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ গণহত্যাকারীকে আশ্রয় দিয়েছে। হত্যাকারীকে বাংলাদেশের রাজনীতি করার সুযোগ সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে। ভারত বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, গণতন্ত্রকে কোনো দিনও মানতে চায় না। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিএনপি কারো বাহবা পেতে ভাত বিরোধিতা করছে না। দেশ ও মানুষের স্বার্থেই কাজ করছে দল।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য বেগম সেলিমা রহমান দৈনিক ভোরের আকাশকে বলেন, দেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি মানুষের কথা ভেবে কাজ করে। আমরা কারো সঙ্গে বৈরিতা নয় নীতিতে চলি। তারপরও নিজের দেশের স্বাথ আগে। ভারত আমাদের দেশকে ফের নানা বিশেষণে বিশেষায়িত করার চেষ্টা করছে। বিএনপি তার নৈতিক জায়ড়া ও ভাবনা থেকেই ভারত বিরোধীতা করছে। আগামী নির্বাচন ও গণঅভ্যুত্থান পরিস্থিতিতে মানুষের মনোভাব বিবেচনায় এনে ভারত বিরোধিতা করছে কিনা প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দল রাজনৈতিক দল হিসেবে মানুষের চাওয়াকে অবশ্যই প্রাধান্য দিতে হবে। এটি লুকানোর কিছু নেই। কারণ, বিএনপি মানুষের ম্যান্ডেট নিয়ে ক্ষমতায় ছিল ও আগামীতে আসতে চায়।

এদিকে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী দৈনিক ভোরের আকাশকে বলেন, ভারত পরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টি করতে চায়। সে জন্য বাংলাদেশ অস্থিতিশীল হলে দেশটি লাভবান হবে। একটি স্বাধীন দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে তা যেভাবে নাক গলায় যেন আমাদেরকে তারা অঙ্গরাজ্য মনে করে। সে জায়গায় দেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি ভারতের বিরোধিতা করবে সেটি অত্যন্ত স্বাভাবিক। বৃহৎ দল হিসেবে বিএনপি দেশ ও মানুষের পক্ষে অবস্থান নেবে এটি মানুষেরও চাওয়া।

এদিকে, জানা গেছে- ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় থাকাকালীন নানা কারণে ভারতের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে ইসলামী ভাবধারার জামায়াতের সঙ্গে জোট করে ক্ষমতায় আসার বিষয়টি সেসময় ভারত খুব একটা ভালোভাবে নেয়নি। এছাড়া ২০০৪ সালের ১ এপ্রিল মধ্যরাতে চট্টগ্রাম ইউরিয়া সার কারখানা বা সিইউএফএল জেটিঘাটে ১০ ট্রাক অস্ত্র উদ্ধার ও ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট সারা দেশে একযোগে জেএমবির সিরিজ বোমা হামলার ঘটনা ভারতকে নাড়া দেয়। বাংলাদেশের বড় অংশজুড়ে ভারতের সীমান্ত থাকায় দেশটি তৎকালীন ক্ষমতাসীন বিএনপি জোটকে নিয়ে নতুন করে ভাবতে শুরু করে।

২০০৬ সালে বিএনপি সরকার ক্ষমতা শেষ করার পর দুই বছর ১/১১-এর মাধ্যমে অনির্বাচিত ব্যক্তিরা ক্ষমতাগ্রহণ করে। বিশেষ এ প্রেক্ষাপটের পর ২০০৮ সালের নির্বাচনে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। তখন অনেকটাই স্পষ্ট ছিল, ভারতের সমর্থন ছিল আওয়ামী লীগের ওপর। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর উচ্চ আদালতের রায়ের মাধ্যমে সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে। তখন নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পরস্পরবিরোধী অবস্থানে চলে যায়। দলনিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে বিএনপি। ২০১২ সালের পর থেকে রাজপথের আন্দোলনে নামে বিএনপি জোট। এর মাঝে ২০১৩ সালের মার্চে ঢাকায় সফরে আসনে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি। তার সফরের সময় বিএনপির ডাকে হরতাল চলছিল। হরতাল বহাল রেখে খালেদা জিয়া তখন প্রণব মুখার্জির সঙ্গে দেখা করেননি। সেখান থেকে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক আরো খারাপ হয়ে দাঁড়ায় বিএনপির।

জাতীয় নির্বাচনের আগে ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে ভারতের তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং বাংলাদেশে আসেন। নির্বাচন নিয়ে চলমান সংকটের মধ্যে তিনি বাংলাদেশে সফরে এসে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টিসহ বেশ কয়েকটি দলের সঙ্গে বৈঠক করেন। শেষ পর্যন্ত দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নিতে তিনি জাতীয় পার্টির তৎকালীন চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে অনেকটাই ‘চাপ’ প্রয়োগ করে রাজি করেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে। এরপর ২০১৮ সালের নির্বাচনের আওয়ামী লীগকে অনেকটাই প্রকাশ্যে সমর্থন ছিল ভারতের। তবে ২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কৌশলের কাছে হেরে পরাজয়ের পর ভারতে সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে নতুন করে ভাবতে শুরু করে বিএনপি। দেশটির সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক পর্যায়ে নিয়ে আসতে তাগিদ অনুভব করেন বিএনপি নেতারা।

জানা গেছে, ২০১৮ সালের পর জামায়াতকে জোটে সরাসরি না রাখার যে সিদ্ধান্ত বিএনপি নিয়েছিল সেখানে ভারতকে আস্থায় আনার বিষয়টি ছিল বলেও মনে করা হয়। এছাড়া ২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে বিভিন্ন দেশ পাতানো নির্বাচনের বিপক্ষে কথা বললেও শেষ পর্যন্ত ভারত ওই নির্বাচনের পক্ষে সমর্থন দেয়। জানা গেছে, বিভিন্ন সময়ে বিএনপি ভারতের সহযোগিতা পাওয়ার চেষ্টা করেও বিএনপি।

ভারতের বাংলাদেশ নিয়ে মাথাব্যথা কেন-প্রশ্ন রিজভীর : রোববার (১ ডিসেম্বর) গণমাধ্যমে পাঠানো বিবৃতিতে রিজভী বলেন, দুনিয়া কাঁপানো ছাত্র-জনতার রক্তাক্ত অভ্যুত্থানের মুখে কুখ্যাত গণতন্ত্রের ঘাতক শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর দেশের স্বস্তি-শান্তির অভাবনীয় স্বর্ণদ্বার উন্মোচিত হয়েছে। দেশের চতুর্দিকে গণতন্ত্রে উত্তরণের সম্ভাবনায় জন-উচ্ছ্বাস দেখা দিয়েছে। দেড় দশকের জগদ্দল পাথর অপসারণ হয়েছে মানুষের স্কন্ধ হতে। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই যখন একটু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলছেন, তখন বাংলাদেশের দেড় দশকের সন্ত্রাসী মাফিয়া লীগের রক্তাক্ত তাণ্ডবে সুষুপ্তিতে থাকা ভারত সরকার সর্বস্ব হারানোর বেদনাবিদ্ধ অস্থিরতা আর অস্বস্তি বিস্ময়কর রকমের প্রকট হয়ে উঠেছে।

শেখ হাসিনার পতন ভারত হজম করতে পারছে না মন্তব্য করে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব বলেন, শেখ হাসিনার পতনে তাদের (ভারতের) অন্তরে ভয়ঙ্কর অনল দহন। এর কারণ অতিমাত্রায় দাদাগিরি করার ফলে ভারতের সঙ্গে তার প্রত্যেক প্রতিবেশীর সম্পর্ক তলানিতে। শুধু হাসিনার ঘাড়ে সওয়ার হয়ে একচ্ছত্র কর্তৃত্ব স্থাপন করেছিল বাংলাদেশের ওপর। ভারত বাংলাদেশকে আশ্রিত রাজ্যের মতো বিবেচনা করত। সেই আশ্রিত রাজ্য হাত ফসকে গেছে। তিনি বলেন, বিগত ১৫ বছর হাসিনাকে সামনে রেখে ভারত বাংলাদেশকে কার্যত দখল করে নেওয়ার চেষ্টা করেছিল। এখন বাংলাদেশকে আবার কীভাবে তাদের করতলে নেওয়া যায়, সেই লক্ষ্যেই তারা নীলনকশা করছে।

বিএনপির এ নেতা বলেন, ভারতের সরকার মনে করে, বাংলাদেশকে অষ্টম সিস্টার হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা গেলে তাদের সেভেন সিস্টার্স নিরাপদ থাকবে। চাণক্য ভারতের বশংবদ ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতন ও পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়ার পর থেকেই মোদি ও তার গদি মিডিয়া বহুমাত্রিক ষড়যন্ত্র এবং অপপ্রচার চালিয়ে আসছে। তারা চরম হতাশা-আহাজারিতে নিমজ্জিত। তাদের আচরণ ক্রমশ স্পষ্টত অসুপ্রতিবেশীসুলভ, অস্বাভাবিক এবং একদেশদর্শী। একজন স্বৈরাচারের পতন নিয়ে কোনো দেশের এমন আহাজারি বিশ্বে বিরল।

রিজভী বলেন, ভারতের কতিপয় গণমাধ্যমে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের বানোয়াট গল্প প্রচার ও প্রপাগান্ডা চালিয়ে সাম্প্রদায়িক উসকানি দিয়ে চলেছে। ভারতীয় সাম্প্রদায়িক শাসকগোষ্ঠী ও হাসিনার যৌথ ইন্ধনে ভারতীয় কিছু উগ্র হিন্দুত্ববাদী গণমাধ্যম এমন অপকর্মে লিপ্ত হয়েছে। ভারত অন্তর্গত দিক থেকেই বাংলাদেশ বিদ্বেষী। এদের মধ্যে মানবিক নৈতিকতার ছিটেফোঁটাও নেই। এই কারণে বাংলাদেশের মানুষের নিজস্ব ইতিহাস ঐতিহ্য ও স্বাভাবিক বিকাশে বিশ্বাসী দেশের জনগণ ও জাতীয় নেতাদের প্রতি বিরূপ ধারণা পোষণ করে।

বিএনপির এ সিনিয়র নেতা বলেন, দু-তিন দশকে আগে এ দেশের এক মহান জাতীয়তাবাদী নেতা ও স্বাধীনতার ঘোষক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে হত্যা করার জন্য ভারতের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা-‘জ্অড’ একটি ফাইল ইনিশিয়েট করে। এর কিছুদিন পর সরকার পরিবর্তিত হয়ে শ্রী মোরার্জী দেশাইয়ের নেতৃত্বে সরকার গঠিত হলে তিনি ফাইলের কার্যক্রম বন্ধ করে দেন। পরে আবার শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী ক্ষমতাসীন হলে ফাইলটির কার্যক্রম চালু হয় এবং এর কিছুদিন পর ১৯৮১ সালের ৩০ মে জিয়াউর রহমান নিহত হন। ভারতেরই একটি পত্রিকা সানডে-তে এর ওপর একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। সাংবাদিক সুব্রামনিয়ম প্রতিবেদনটি রচনা করেন। সুতরাং আওয়ামী লীগ ছাড়া বাংলাদেশের কোনো রাজনৈতিক দলকেই ভালো চোখে দেখে না ভারত। বাংলাদেশে ঐতিহাসিক কাল ধরে বিভিন্ন সম্প্রদায় প্রীতি ও শুভেচ্ছার বন্ধনে আবদ্ধ। এখানে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ভঙ্গের কোনো কারণের অভ্যুদয় হয়নি। কিন্তু পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে হাইপার প্রপাগান্ডা চালানো হচ্ছে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের। বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নেতিবাচকভাবে চিত্রিত করার জন্য ভারত উঠেপড়ে লেগেছে। বাংলাদেশ থেকে দুঃশাসনের অবসান হওয়া, হাসিনার পালিয়ে যাওয়া ইত্যাদি তাদের মনে ভীষণ পীড়া দিচ্ছে। তাই বাংলাদেশকে লাঞ্ছিত করতে, দুর্দশায় ফেলতে, অবমাননা করতে চলছে অতিকথন আর অপপ্রচারের বিরতিহীন ধারাভাষ্য। তথাপিও যাবতীয় ভয়, হুমকি ও দুর্বিপাকের মধ্যেও বাংলাদেশিরা মৃত্যুঞ্জয়ী সংকল্পে সকল চক্রান্তকে প্রতিহত করবে।

প্রতিদিন বাংলাদেশে কথিত সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে ভারত সরকার এবং উগ্রবাদী বিজেপির নেতারা বক্তব্য-বিবৃতি হুংকার এবং বায়বীয় অভিযোগ করে চলেছে দাবি করে রিজভী বলেন, কলকাতায় আমাদের উপহাইকমিশনে উগ্রবাদী হিন্দুরা আক্রমণ চালিয়েছে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধাতে ভারতীয় গোয়েন্দারা আওয়ামী লীগ ও বিশেষ একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠীকে কীভাবে ব্যবহার করছে সেই পরিকল্পনার ছক প্রকাশ্যে এসেছে।

তিনি বলেন, তাদের বক্তব্যের যে কোনো ভিত্তি নেই, তার প্রমাণ মিলেছে সম্প্রতি ভয়েস অব আমেরিকার (ভিওএ) করা একটি জরিপে। জরিপে অংশগ্রহণকারী ৬৪.১ শতাংশ মনে করেন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের চেয়ে অন্তর্বর্তী সরকার ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে বেশি নিরাপত্তা দিচ্ছে। এই জরিপ বাংলাদেশের কোনো প্রতিষ্ঠান করেনি। বিদেশি প্রতিষ্ঠান করেছে। ফলে এ নিয়ে প্রশ্ন থাকার কোনো অবকাশ নেই। বরং ভারতে কীভাবে সংখ্যালঘু নির্যাতন হচ্ছে, তা নিয়ে স্পষ্টভাবে প্রশ্ন তোলা যায়। ভারতে প্রতিনিয়ত মুসলমানরা নিপীড়ন-নির্যাতন, এমনকি খুনের শিকার হচ্ছে। বাড়ি-ঘর-স্থাপনা বুলডোজার দিয়ে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। শুধু মুসলমানই নয়, দেশটির খ্রিস্টান সম্প্রদায়ও আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে।

ভারতে কীভাবে সংখ্যালঘুদের নিপীড়ন করা হয়, তার তথ্য তুলে ধরে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব বলেন, আসামে খ্রিষ্টিয়ান ফোরাম বলেছে, আসামে কয়েক বছর ধরে সংখ্যালঘু খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান ধারাবাহিকভাবে আক্রমণের শিকার হচ্ছে। ভারত সরকার তার প্রতিবাদ বা প্রতিকার করে না। মণিপুরে হিন্দু ও খ্রিস্টানদের উপাসনালয় ধ্বংস করা হয়েছে। ২৫০টিরও বেশি গির্জা পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, ২০০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে এবং ৬০ হাজারের বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। ভারতের অহিন্দু জনগোষ্ঠী মুসলিম, খ্রিস্টান ও শিখ সম্প্রদায় যৌথভাবে সাম্প্রদায়িকতার হুমকির সম্মুখীন। ভারতের শাসক গোষ্ঠী বিজেপির সাম্প্রদায়িকতার নীতি হলো সহিংসতা, বৈষম্য, সংখ্যালঘুদের ওপর ধর্মীয় নিপীড়নের মাধ্যমে ভীতি ও আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করা। বিজেপি ও আরএসএসের পৃষ্ঠপোষকতায় এই নীতিগুলোর চর্চা করা হচ্ছে। একেবারে খোলাখুলিভাবে ধর্মীয় স্বাধীনতা ও ভিন্নমতকে জায়গা দেয়ার মতো বিষয়কে খারিজ করে দেওয়া হচ্ছে।

রিজভী বলেন, হিসাব করলে দেখা যাবে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি সংখ্যালঘু নির্যাতনের শিকার হচ্ছে ভারতে। তারাই আবার বড় গলায় বলছে বাংলাদেশে নাকি সংখ্যালঘুরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। প্রবাদে আছে: ‘আপনি আচরি ধর্ম শিখাও অপরে।’ ভারত যেখানে তার নিজের দেশের সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ সেখানে বাংলাদেশ নিয়ে ভারতের এত মাথা ব্যথা কেন? বাংলাদেশের সংখ্যালঘু নিয়ে অনবরত অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে ভারতের কট্টর হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো।

অপপ্রচারে ক্ষমতাসীন বিজেপি ও তার সহযোগীরাও মেতেছে দাবি করে এ নেতা বলেন, ভারতের আচরণ বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ এবং স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে হুমকি। বিতর্কিত ধর্মীয় চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের অনুসারী হিন্দু জঙ্গিরা তরুণ আইনজীবী সাইফুল ইসলামকে কুপিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করেছেন। চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের অনুসারী হিন্দু জঙ্গিরা আইন অমান্য করেছে, আদালত অবমাননা করেছে এবং আইন নিজের হাতে তুলে নিয়েছে। ভারত সরকার এই বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করেনি। ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা বিএনপির যে লাখ লাখ নেতাকর্মীসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের ওপর স্টিম রোলার চালিয়ে, গুম, খুন, অপহরণ, জেল-জুলুম করেছে, অরাজনৈতিক বিরোধী মতকে দমন করেছে, তা নিয়েও টুঁ শব্দ করেনি। পিলখানায় হত্যাযজ্ঞ, শাপলা চত্বরে হেফাজতের সমাবেশে গণহত্যা, হত্যাকাণ্ড, তিনটি ভোটারবিহীন সংসদ নির্বাচনসহ কোনো অপকর্মের প্রতিবাদ ভারত করেনি। বরং এসবের বৈধতা ও সমর্থন দিয়েছে ভারত। বাংলাদেশ একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ হলেও এ দেশে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক হিন্দু বসবাস করে। মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান এবং চাকমা, মারমা, গারো, মুরংসহ বিভিন্ন জনগোষ্ঠী আবহমানকাল ধরে একটা দৃঢ় ও নিবিড় যোগসূত্র বয়ে এনেছে। তারা একসঙ্গে মিলেমিশে পারস্পরিক সহাবস্থান ও সহমর্মী হয়েই শান্তিতে বসবাস করছে। এখানে এক দেশ, এক জাতি, আমরা সবাই বাংলাদেশি। অথচ, ভারত সকল বাংলাদেশির স্বার্থে কথা না বলে, সব সময় শুধু একটি সম্প্রদায়ের স্বার্থে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে কথা বলে। ভারতের এই আচরণ ভারতকে সর্বজনীন না করে একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের পক্ষাবলম্বী করেছে। ভারতের এসব আচরণ এ দেশের সাধারণ মানুষ মেনে নেয়নি। এ দেশের মানুষ কঠিন সময়ে ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে জানে। প্রতিরোধের দুর্ভেদ্য দেয়ালও প্রতিষ্ঠা গড়ে তুলতে পারে। এ দেশের হিন্দুদেরও বৃহদাংশ ভারতের এই নীতি সমর্থন করে না। আজ এই বাস্তবতা ভারতকে বুঝতে হবে। অসূয়া শক্তির কখনো জয় হতে পারে না।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কেউ কেউ তাদের বক্তব্য-বিবৃতিতে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করতে বিএনপি প্রতিবন্ধক বলে প্রচার করছেন যা সঠিক নয়। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করা না করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার সরকারের। বিএনপির ওপর দায় চাপানো দুঃখজনক। পতিত আওয়ামী লীগ সরকার যখন জামায়াত নিষিদ্ধ করেছিল তখন আমরা প্রতিবাদ করেছি। আমরা আশা করবো অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে প্রধান উপদেষ্টাসহ অন্যান্য উপদেষ্টাদের এমন কোনো বক্তব্য দেওয়া উচিত হবে না যাতে গণতান্ত্রিক শক্তি দুর্বল হয় বা আমাদের ঐক্যে ফাটল ধরে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জনাব তারেক রহমান ইতোমধ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি আহবান জানিয়ে বলেছেন, জনগণের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে জরুরী ভিত্তিতে পদক্ষেপ নিন। জনগণকে আস্থায় রাখুন। জনগণের আস্থায় থাকুন। হাজারো ছাত্র-জনতার রক্তের ওপর স্বৈরাচার বিরোধী জাতীয় ঐক্য গড়ে উঠেছে। সরকারের কোনো কাজ কিংবা কথা যেন ছাত্র-জনতার ঐক্যে ফাটল ধরার কারণ না হয়, সেই বিষয়ে সরকারকে বিচক্ষণতার পরিচয় দিতে হবে।

 

ভোরের আকাশ/রন

মন্তব্য

Beta version