ভিন্ন কোনো নাম নয়, সবগুলোর নাম হবে ‘ঢাকা নগর পরিবহন’। শুধুমাত্র রুটের নাম ও নম্বরই হবে বাসগুলোর পরিচিতি। থামতে হবে নির্দিষ্ট স্টপেজে, যেখান-সেখান থেকে যাত্রী ওঠানো-নামানো যাবে না, টিকিট কেটে উঠতে হবে বাসে—এমন পরিকল্পনা নিয়ে নতুন আঙ্গিকে শুরু হতে যাচ্ছে পরিবহনটি। ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ-ডিটিসিএ’র সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তড়িঘড়ি করে নয়, এবার নানাভাবে পর্যবেক্ষণ করে পরিকল্পনাগুলো করা হচ্ছে, যাতে ভবিষ্যতে উদ্যোগটি ব্যর্থ না হয়। যে কারণে প্রথম উদ্যোগ সফলতা পায়নি, তা চিহ্নিত করে নতুন আঙ্গিকে বাস রুট রেশনালাইজেশন চূড়ান্ত করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন তারা। নগরীর গণপরিবহন ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা ফেরাতে এই উদ্যোগকে টেকসই সমাধান হিসেবে দেখছেন পরিবহন বিশেষজ্ঞরা। আর এটি বাস্তবায়ন করতে হলে খাত সংশ্লিষ্টদের সদিচ্ছা জরুরি বলেও মনে করছেন তারা।
রাজধানী ঢাকায় একটি সুশৃঙ্খল গণপরিবহন ব্যবস্থা চালু, ভোগান্তি কমিয়ে যাত্রীদের আরামদায়ক ভ্রমণের কথা চিন্তা, অর্থাৎ পরিবহন খাতকে অসুস্থ প্রতিযোগিতা থেকে বাঁচানোর লক্ষ্যে ২০২১ সালের ২৬ ডিসেম্বর রাজধানীর তিনটি রুটে চালু করা হয়েছিল ‘ঢাকা নগর পরিবহন’ নামে বাস সেবা। সেই সেবায় ছিল কেরানীগঞ্জের ঘাটারচর থেকে কাঁচপুর পর্যন্ত বিআরটিসির ৩০টি ডাবল ডেকার ও ট্রান্স সিলভা পরিবহনের ২০টি বাসসহ মোট ৫০টি বাস। এক কোম্পানি গঠন করে শুরুতে একটি রুটে সবুজ রঙের বাসগুলো চলাচল শুরু করে। নির্দিষ্ট স্থানে স্টপেজ, বাস কাউন্টার, আলাদা যাত্রী ছাউনি—সবই ছিল গোছানো। কিছুদিনের মধ্যেই এ সেবা ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। পরে আরও দুই রুটে অর্থাৎ মোট তিন রুটে চলাচল করে ‘ঢাকা নগর পরিবহন’। কিন্তু কয়েক মাস পরে এই উদ্যোগে ব্যাপক বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। যত্রতত্র যাত্রী তোলা-নামানো শুরু করে নগর পরিবহন, টিকিট ব্যবস্থাও হারিয়ে যায়। এক পর্যায়ে স্টপেজেও থামতো না বাসগুলো। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাস কমে দাঁড়ায় ২০টিতে। এই পদ্ধতিতে গাড়ি চালাতে অনাগ্রহী হয়ে পড়েন বাস মালিকরা। কয়েক মাস আগেও কালে ভদ্রে সড়কগুলোতে সবুজ রঙের বাস দেখা গেলেও তা লোকাল বাসের মতোই চলেছে।
৫ আগস্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর কোনো ঘোষণা ছাড়াই একেবারে বন্ধ হয়ে যায় ‘ঢাকা নগর পরিবহন’। বিআরটিসিসহ অন্য বেসরকারি কোম্পানিগুলোও তাদের সব বাস তুলে নিয়েছে এরই মধ্যে। তবে এখনো ঘাটারচরের বাস ডিপোতে পড়ে আছে বিআরটিসির কিছু বাস। রাজধানীতে সাক্ষী হয়ে আছে নগর পরিবহনের বাস স্টপেজ ও যাত্রী ছাউনি। গণপরিবহন সংশ্লিষ্ট এবং সাধারণ যাত্রীদের অভিযোগ, তদারকির অভাবে সফলতার মুখ দেখেনি বাস রুট রেশনালাইজেশন কর্মসূচির আওতায় পাইলটিং এ কার্যক্রম। অভিযোগের সত্যতাও দেখা যেত দুই সিটি করপোরেশনের মেয়রের সঙ্গে বিভিন্ন সভায় বাস মালিক-শ্রমিকদের সম্পর্কের অবনতি চিত্র। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর ফের নতুন করে ভাবনা শুরু হয় ঢাকার গণপরিবহন নিয়ে। ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ-ডিটিসিএ নতুন করে এ নিয়ে পরিকল্পনা শুরু করেছে।
ঢাকা নগর পরিবহনের আওতায় কীভাবে সব বাস চলবে এ নিয়ে কাজ করছে ডিটিসিএ। প্রতিষ্ঠানটির দেওয়া তথ্যানুযায়ী, বর্তমান রুটগুলোকে ক্লাস্টারিং ও পুনর্বিন্যাসের মাধ্যমে বাস রুট রেশনালাইজেশনের রূপরেখা তৈরি ও রুট নির্ধারণ করা হচ্ছে। এ পরিকল্পনায় প্রাথমিকভাবে নয়টি ক্লাস্টারে ৪২ রুটে ২২ কোম্পানির বাসগুলো ঠিক করা হয়েছে। রুটগুলোকে আরবান ও সাব-আরবান রূপে দুই ভাগে বিভক্ত করে ঢাকার বাইরের রুটগুলোকে শহরের ভেতরে আসা সীমিত করে দেওয়া হয়েছে। যেমন- আবদুল্লাহপুর, কাচপুর, ঝিলমিল স্থানগুলোতে তৈরি করা হবে নতুন রুট। নতুন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ঢাকায় চলাচলকারী সকল বাস ও মিনিবাসের তথ্য (সচল, অচল রুট, রুট পারমিটধারী, রুট ভায়োলেশনকারী ও রুট পারমিটবিহীন বাসের সংখ্যা) সংগ্রহ করে গণপরিবহনের ওপর সার্ভে (অরিজিন-ডেস্টিনেশন, বোর্ডিং-এলাইটিং ইত্যাদি) করা হচ্ছে। প্রতিটি রুটের ইনভেন্টরি সার্ভে করা হবে। আগের ও নতুন ট্রাফিক সার্ভে থেকে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্তগুলো রিভিউ ও হালনাগাদ করে এর ভিত্তিতে ভবিষ্যৎ ট্রাফিক চাহিদা নিরূপণ করা হবে। এছাড়া, প্রয়োজনীয় বাস-বে, বাস-স্টপ, যাত্রী ছাউনি ইত্যাদির নির্মাণের জন্য নকশা করা হবে। র্যাপিড পাসের মাধ্যমে ডিটিসিএতে স্থাপিত ক্লিয়ারিং হাউস ব্যবহার করে ভাড়া আদায়ের ব্যবস্থা থাকবে। বাসের স্পেসিফিকেশন, পুরাতন বাস স্ক্র্যাপিং ও পুনর্বাসন প্রক্রিয়া নির্ধারণ এবং বাস পরিচালনা নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ, কোম্পানিগুলো ও সরকারি প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা অর্জন করা এ পরিকল্পনার অন্যতম উদ্যোগ।
ডিটিসিএর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, চলতি বছরের ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত বাস কোম্পানিগুলোকে নির্ধারিত রুটে বাস চালাতে কোম্পানিগুলোকে আবেদন করতে বলা হয়েছে। এরই মধ্যে সংস্থাটির কাছে ৮০টির বেশি কোম্পানির ২ হাজারের বেশি বাসের আবেদন জমা পড়েছে বলে জানা গেছে। আগামী ১১ ডিসেম্বর বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হবে। এর আগেই কোন রুটে কোন কোম্পানির বাস চলবে তার বিস্তারিত ঠিক করে প্রতিবেদন তৈরি করবে ডিটিসিএ।
বাস রুট রেশনালাইজেশন প্রকল্প পরিচালক ধ্রুব আলম জানান, ঢাকা মহানগরীর রুটগুলো এখন ট্রাফিক সার্ভে করে আপডেট করা হচ্ছে। সার্ভে শেষ হলে গণপরিবহনের সম্ভাব্য চাহিদার একটি মডেল তৈরি করা হবে। তিনি বলেন, আগের পরিস্থিতি যাতে না হয়, সে বিষয়টি মাথায় রেখে সবকিছু পর্যালোচনা করা হচ্ছে। আগের উদ্যোগেও বলা ছিল বাস কাউন্টার থাকবে, টিকিটিং ব্যবস্থা থাকবে। এসব শর্ত থাকলেও বাস মালিকরা কিন্তু সেগুলো মেনে চলেনি। এবার সেগুলো কঠোরভাবে মেনে চলতে হবে। তিনি আরও বলেন, এখন যে আবেদনগুলো আসছে, সেগুলো কিন্তু জেনেশুনেই আসছে। তারা ভালো মতো ব্যবসা করতে পারবেন। তাদের সে পরিবেশ তৈরি করে দিতে হবে। বাসগুলোর গায়ে এখন যে কোম্পানি নাম লেখা দেখা যায়, সেগুলো আর থাকবে না। সব কোম্পানির বাসগুলোর নাম হবে ‘ঢাকা নগর পরিবহন’। বাসের গায়ে রুটের নাম ও নম্বর থাকবে। সবগুলো বাসকে নির্দিষ্ট স্টপেজে থামতে হবে, টিকিটিং ব্যবস্থা চালু করতে হবে, যত্রতত্র যাত্রী ওঠানামা করাতে পারবে না। পর্যায়ক্রমে ব্যবহার করা যাবে র্যাপিড পাসও। বাসে অন-বোর্ড ক্যামেরা, ড্যাশক্যাম ও জিপিএস ট্র্যাকার স্থাপন করা থাকবে।
ডিটিসিএর নির্বাহী পরিচালক নীলিমা আখতার বলেন, বাস মালিকদের অসহযোগিতা, সঠিক তদারকি না হওয়া ও যাত্রীদের অসচেতনতার কারণে আগের উদ্যোগে সফল হওয়া যায়নি। এখন নতুন করে পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। কাজটি দ্রুত এগিয়ে চলছে। এটি বাস্তবায়নে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। আমরা এবার নিবিড় পর্যালোচনা করে বিষয়টি নিয়ে এগোচ্ছি। তবে কবে থেকে ঢাকা নগর পরিবহন নতুনভাবে যাত্রা শুরু করবে তা এখনো ঠিক হয়নি বলেও জানান তিনি।
উল্লেখ্য, রাজধানীর গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফেরাতে ২০১৬ সালে নেওয়া হয় এই উদ্যোগ। শুরুতে ছয়টি কোম্পানির অধীনে ছয় রঙের বাস নামানোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের তৎকালীন মেয়র আনিসুল হক। ২০১৭ সালে তার মৃত্যুর পর সে উদ্যোগ থেমে যায়। এরপর ২০২১ সালের ২৬ ডিসেম্বর সে উদ্যোগ বাস্তবে রূপ পেলেও তা স্থায়ী হয়নি।
ভোরের আকাশ/রন
মন্তব্য