ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা সরকারের আমলে ১৫ বছরে অন্তত পাঁচ শতাধিক সামরিক কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে ‘পারসোনা নন গ্রাটা’ (পিএনজি) দেওয়া হয়েছে। এটা শুধু রাজনৈতিক কারণে করা হয়েছে। অফিশিয়ালি ও আন অফিশিয়ালি দুভাবেই সামরিক বাহিনীর সদস্যদের ‘পিএনজি’ দেওয়া হয়। ওই সময় শুধু পিএনজি নয়- এসব সামরিক কর্মকর্তাদের নানাভাবে হয়রানি, অপমান ও অপদস্ত করা হয়েছে। নানা মিথ্যা অভিযোগে অনেকের বিরুদ্ধে মামলাও করা হয়েছে। অনেককে জঙ্গি সাজানো হয়েছে।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিরক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক ও কিছু অতি উৎসাহী দলকানা সামরিক কর্মকর্তা এসব কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন। অবশ্য ৫ আগস্টের পর বর্তমান সেনাপ্রধান অনেকের পিএনজি প্রত্যাহার করেছেন বলে জানা গেছে।
সম্প্রতি অবসরপ্রাপ্ত সামরিক বাহিনীর পক্ষ থেকে সামরিক বাহিনীর বহুল বিতর্কিত পারসোনা নন গ্রাটা (পিএনজি) বাতিলের দাবি জানানো হয়েছে। সংবিধান সংস্কার কমিশনের কাছে তারা এ দাবি জানান। এতে বলা হয়েছে, এটা আইনগতভাবে সম্পূর্ণ অবৈধ। বিগত সরকারের আমলে অফিশিয়ালি ও আন অফিশিয়ালি দুভাবেই সামরিক বাহিনীর সদস্যদের ‘পিএনজি’ দেওয়া হয়েছে। এটা দেওয়া হলে- ওই ব্যক্তি বাংলাদেশের সব ক্যান্টনমেন্টে নিষিদ্ধ হিসেবে চিহ্নিত হন। পাশাপাশি সামরিক বাহিনীর সদস্যদের চিকিৎসা সেবাসহ আনুষঙ্গিক আরো কিছু সুবিধা থেকে বঞ্চিত হন।
সামরিক বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কয়েকজন কর্মকর্তা বলেছেন, এটা আমাদের জন্য যেমন অপমানজনক তেমনি অবমাননাকর। সামাজিকভাবে আমাদের হেয় করার শামিল। সামরিক বাহিনীর জন্য আবাসন প্রকল্প জলসিঁড়িতে অনেকে পিএনজির কারণে আবেদন পর্যন্ত করতে পারেননি। আবার প্লট পেয়ে পিএনজির কারণে তা বাতিলেরও উদাহরণ রয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ৫ আগস্ট দেশের পট পরিবর্তনের পর বেশ কয়েকজন সামরিক কর্মকর্তার পিএনজি তুলে নেয়া হয়েছে। এতে পিএনজি সম্পর্কে বলা হয়েছে, পারসোনা নন গ্রাটা (পিএনজি), কোনো কূটনীতিককে কূটনীতিক হিসেবে তাদের দেশে প্রবেশ করতে বাধা দেওয়ার জন্য এই শব্দটি বিভিন্ন দেশ মাঝে-মধ্যেই ব্যবহার করে। সেখানে, গত সরকারের আমলে এই শব্দটি সশস্ত্র বাহিনী কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে যথেচ্ছ প্রয়োগ করা হয়েছিল- অবসরপ্রাপ্ত/প্রাক্তন সৈন্যদের সামরিক প্রতিষ্ঠানে প্রবেশ, আইনত অর্জিত চিকিৎসা অধিকার এবং অন্যান্য সামাজিক/পেশাদার সুবিধাগ্রহণ করা থেকে নিষিদ্ধ করার জন্য। দুঃখজনকভাবে, এ ধরনের বিধিনিষেধ অনানুষ্ঠানিকভাবে অন্যান্য অনেক কর্মকর্তার সামাজিক/পেশাগত সুযোগসুবিধা সীমিত করার জন্য প্রয়োগ করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে সংবিধান সংস্কার কমিশনের বৈঠকে উপস্থিত আনঅফিশিয়ালি পিএনজি পাওয়া ব্রিগেডিয়ার (অব.) জেনারেল মোহাম্মদ হাসান নাসির বলেন, বিগত সরকারের আমলে পাঁচ শতাধিক সামরিক বাহিনীর সদস্যদের পিএনজি দেওয়া হয়েছে। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর বিষয় যে, আনঅফিশিয়ালিও অনেককে পিএনজি দেওয়া হয়েছে। যেমন আমি ১৬ বছর ধরে আনঅফিশিয়ালি পিএনজির আওতায় আছি। হয়তো কোনো সেনানিবাসের গেটে গেলাম তখন বলা হলো যে, আপনি ঢুকতে পারবেন না। নিষেধাজ্ঞা জারি করা আছে। তিনি বলেন, কাউকে যদি লিখিত পিএনজি দেয় তাহলে বাংলাদেশের সব ক্যান্টনমেন্টে তা বিতরণ করা হবে। চিকিৎসা সেবা, সামরিক বাহিনীর নানা অনুষ্ঠানসহ প্লট, ফ্ল্যাট থেকে শুরু করে সব ধরনের সুযোগসুবিধা থেকে বঞ্চিত হবেন। সামরিক বাহিনীর জন্য এ ধরনের শাস্তি সম্পূর্ণ অবৈধ।
হাসান নাসির আরও বলেন, চেহারা দেখে দেখে পিএনজি দেওয়া হয়েছে। যদি সত্যিকার অপরাধীদের দেওয়া হতো তাহলে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হতো। প্রয়োজনে এটার জন্য আরেকটি টার্ম বের করতে হবে। যেমন- সেনানিবাসে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা। এটা হতে পারে। কিন্তু পিএনজি নয়। তিনি বলেন, আমি বিএনপির রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী- শুধু এই কারণে গত ১২ বছর পিএনজি দেওয়া হয়েছে। এতে আমি সামরিক বাহিনীর সব ধরনের সুযোগসুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছি। যারা এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত ছিল- তাদেরকে যথাযথ শাস্তির মুখোমুখি করার দাবি জানান তিনি।
২০১২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি তাকে দেওয়া পিএনজি চিঠিতে বলা হয়েছে- আপনাকে সেনানিবাস ও সব সেনানিবাসস্থ সামরিক স্থাপনা/প্রতিষ্ঠান/সংস্থায় গমনাগমন এবং সেনাসদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে অবাঞ্চিত ঘোষণা করা হয়েছে। তবে গত ২৪ সেপ্টেম্বর ওই কর্মকর্তার পিএনজি প্রত্যাহার করা হয়েছে। সংবিধান সংস্কারে অবসরপ্রাপ্ত সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তাদের পক্ষে ৪৫ অনুচ্ছেদের পর্যালোচনাসহ সুনির্দিষ্ট ছয়টি বিষয়ের ওপর সংস্কারের প্রস্তাব দেওয়া হয়। এর মধ্যে পিএনজিকে আলাদাভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে বলে জানা যায়। কমিশনের পক্ষ থেকে তাদের এসব দাবি গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করা হবে বলে আশ্বাস দেওয়া হয়েছে।
ভোরের আকাশ/রন
মন্তব্য