পাসপোর্ট নবায়ন

মালয়েশিয়ায় অনিশ্চয়তায় ২৬ হাজার বাংলাদেশি

ভোরের আকাশ প্রতিবেদক
মালয়েশিয়ায় অনিশ্চয়তায় ২৬ হাজার বাংলাদেশি

মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি অভিবাসী শ্রমিক খোরশেদ আলম গত জুন মাসে তার মেশিন-রিডেবল পাসপোর্ট (এমআরপি) নবায়ন করতে চান। খুব দ্রুত তার এটা করার দরকার ছিল কারণ ডিসেম্বরেই তার কাজের ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে। পাসপোর্ট নবায়নের জন্য একজন দালালকে তিনি প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্র দেন এবং বলেছিলেন পাসপোর্টটি যেন ই-পাসপোর্টে আপগ্রেড করে দেয়। কিন্তু দালাল তাকে জানায় বাংলাদেশিদের ই-পাসপোর্ট হয় না। অন্যদিকে পাসপোর্ট নবায়ন ফি ১৪৫ রিঙ্গিত হলেও দালাল তার কাছ থেকে ২৫০ রিঙ্গিত নেয় বলে জানান খোরশেদ। এমআরপি পেতে ২১ কর্মদিবস লাগলেও খোরশেদ এখনো তার নবায়নকৃত পাসপোর্ট পাননি। খোরশেদ আলম বলেন, পাসপোর্ট ছাড়া আমি আমার ভিসা নবায়ন করতে পারব না। সবকিছু শেষ হয়ে যাবে, আমাকে আবার নতুন করে সব শুরু করতে হবে।

পাসপোর্ট নবায়নে বিলম্বের কারণে মালয়েশিয়ায় যে ২৬ হাজারের বেশি বাংলাদেশি অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছেন খোরশেদ তাদের একজন। সরকারি হিসেবে মালয়েশিয়ায় প্রায় ১৫ লাখ বাংলাদেশি অভিবাসী শ্রমিক কাজ করেন। অভিবাসী শ্রমিকদের পাসপোর্ট নিয়ে যে জটিলতা তৈরি হয়েছে, তার পেছনে কুয়ালালামপুরে বাংলাদেশ হাইকমিশনের একাংশের কর্মকর্তাদের সঙ্গে দালালদের যোগসাজশ রয়েছে বলে অভিযোগ আছে।

হাইকমিশন সূত্রে জানা গেছে, যেহেতু ই-পাসপোর্ট প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি ও অনিয়ম করা কঠিন, তাই এই চক্রটি এমন পরিস্থিতি তৈরি করেছে যে কর্তৃপক্ষ আরও এমআরপি ইস্যু করতে বাধ্য হয়। ভোগান্তি কমাতে ও প্রক্রিয়া সহজ করতে চলতি বছরের ১৮ এপ্রিল মালয়েশিয়ায় ই-পাসপোর্টসেবা চালু করে বাংলাদেশ সরকার। কিন্তু অক্টোবর পর্যন্ত হাইকমিশন ই-পাসপোর্ট আবেদন প্রক্রিয়া করেছে মাত্র ২০ হাজার ৮২৯টি, একই সময়ে ৫৬ হাজার ৮০টি এমআরপি আবেদন জমা পড়েছে। ডিজিটাল প্রসেসের কারণে ই-পাসপোর্ট বিতরণ নির্বিঘ্ন হলেও এমআরপি বুকলেটের ঘাটতির কারণে প্রায় ২৬ হাজার ৯৬টি এমআরপি আবেদন আটকে আছে, যার ফলে খোরশেদের মতো আবেদনকারীরা অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে পড়েছেন।

সংকট বাড়তে থাকার মধ্যে, এমআরপি বুকলেটের ঘাটতির কথা উল্লেখ করে ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট ডিপার্টমেন্ট (ডিআইপি) গত ২৮ অক্টোবর কুয়ালালামপুরে বাংলাদেশ হাইকমিশনকে অতিরিক্ত ফি নিয়ে এমআরপি গ্রাহকদের ই-পাসপোর্ট দিতে অনুরোধ করেছিল।

গত বছরের ২২ সেপ্টেম্বর হাইকমিশন স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের ভিত্তিতে ই-পাসপোর্ট প্রক্রিয়াকরণ ও ভিসা সেবার জন্য আউটসোর্সিং কোম্পানি এক্সপার্ট সার্ভিস কুয়ালালামপুরের (ইএসকেএল) সঙ্গে চুক্তি করে। হাইকমিশনের কাউন্সিলর (পাসপোর্ট ও ভিসা) মিয়া মোহাম্মদ কেয়ামুদ্দিন প্রতিটি আবেদনের জন্য ৩২ রিঙ্গিত সার্ভিস চার্জসহ ইএসকেএলের সঙ্গে চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। ইএসকেএলের এমআরপি ও ই-পাসপোর্ট সেবা প্রদানের সরকারি অনুমতি থাকলেও হাইকমিশনের পাসপোর্ট উইং যাতে এমআরপি প্রসেসিং পরিচালনা করতে পারে সেজন্য ই-পাসপোর্ট ও ভিসা প্রসেসিংয়ের জন্য চুক্তি হয়।

অনিয়মে জড়িত থাকার অভিযোগে গত ২৬ সেপ্টেম্বর হাইকমিশনের কাউন্সিলর (রাজনৈতিক) প্রণব কুমন ভট্টাচার্য পাসপোর্ট উইংয়ের অফিস সহায়ক মনজিল হোসেনকে কারণ দর্শানোর নোটিশ পাঠান। নোটিশে মনজিলকে একটি অডিও কথোপকথনের ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়, যেখানে তাকে বলতে শোনা যায়, ‘মালয়েশিয়ায় দূতাবাস ও পাসপোর্টের কাজের সঙ্গে অনেক লোক জড়িত। তাদের উপার্জন সম্পূর্ণরূপে এই কাজের ওপর নির্ভর করে, কারণ তাদের আয়ের অন্য কোনো উপায় নেই।’

নোটিশে বলা হয়, ‘কথোপকথনের এক পর্যায়ে মঞ্জিলকে বলতে শোনা যায়, হাইকমিশনার কোনো আদেশ দিলে হাইকমিশনারকে পাল্টা অভিযোগের সুযোগ আমার আছে। দুই-তিনজন মন্ত্রীর সঙ্গে আমার যোগাযোগের বিষয়ে তিনি সব জানেন। বাহাউদ্দিন নাছিম, আসাদুজ্জামান কামাল। তারা পরিবারের মতো, আত্মীয়ের মতো।’

গত ২৩ অক্টোবর পাসপোর্ট উইংয়ের কাউন্সিলর কেয়ামুদ্দিনকে ফের কারণ দর্শানোর নোটিশ পাঠান প্রণব। একটি অভ্যন্তরীণ টাস্কফোর্স এমআরপি আবেদনগুলিতে অনিয়ম খুঁজে পায় এই প্রতিবেদক, যার মধ্যে স্বাক্ষরবিহীন অ্যাপ্লিকেশন এবং একাধিক আবেদনে একই স্বাক্ষর রয়েছে। বিধি লঙ্ঘন করে কেন কেয়ামুদ্দিন এ ধরনের আবেদন মঞ্জুর করলেন তা জানতে চাওয়া হয়েছে নোটিশে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে হাইকমিশনের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, আমরা নোটিশের জবাব পেয়েছি। এখন তাদের দাবিগুলো বিশ্লেষণ করছি। অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কেয়ামুদ্দিন বক্তব্যের জন্য ফোন কল এবং টেক্সট মেসেজ করা হলেও তিনি উত্তর দেননি। মালয়েশিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার শামীম আহসান পেন্ডিং এমআরপি আবেদন, সমস্যা সমাধানের পদক্ষেপ এবং কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অব্যবস্থাপনা ও অনিয়মের অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে কোনো প্রশ্নের জবাব দেননি।

মালয়েশিয়ায় পাসপোর্ট পেতে দেরি বা আর্থিক সীমাবদ্ধতার কারণে ভিসা নবায়ন করতে না পারলে প্রবাসীরা প্রত্যেকে ২০০ রিঙ্গিত দিয়ে আটটি বিশেষ মাসিক পাস পেতে পারেন। এই সময়ের মধ্যে ভিসা পুনর্নবীকরণ করা না হলে তাদের অবশ্যই দেশে ফিরতে হবে বা বৈধ নথি ছাড়া থাকার ঝুঁকির মুখে পড়তে হবে। মালয়েশিয়া প্রবাসী বাংলাদেশি উজ্জল হোসেন তার পাসপোর্ট নবায়নের আবেদন জমা দেন ১৫ মে। প্রতিশ্রুত ডেলিভারির তারিখ ছিল ২৫ অক্টোবর। কিন্তু নভেম্বরেও তিনি তা পাননি। ‘আমি ইতোমধ্যে আমার ভিসার বিপরীতে ছয়টি বিশেষ পাস নিয়েছি। দুই মাসের মধ্যে ভিসা নবায়ন করতে না পারলে আমি আটকে যাব,’ ফোনে বলছিলেন উজ্জ্বল।

ই-পাসপোর্টের জন্য আবেদনকারী প্রবাসীদের ডকুমেন্টেশন সমস্যা তুলে ধরে হাইকমিশনার শামীম ১৮ নভেম্বর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবের কাছে একটি চিঠি পাঠান। ব্যাপকহারে চাকরি হারানো ঠেকাতে জাতীয় পরিচয়পত্র বা অন্যান্য নথিতে নামের বানান সংক্রান্ত সমস্যা এবং তথ্যের অমিল রয়েছে এমন ব্যক্তিদের এমআরপি দিতে বিকল্প কোনো পদ্ধতির অনুমতি দেওয়ার সুপারিশ করেন চিঠিতে। চিঠিতে আরও উল্লেখ করা, নির্দেশনা অনুযায়ী যাদের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র আছে তাদের এমআরপি নবায়ন ও ই-পাসপোর্টে উন্নীত করতে হাইকমিশন ও ইএসকেএল অতিরিক্ত ফি আদায় করছে। চিঠিতে আরও বলা হয়, সমস্যাটি প্রবাসীদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি করছে বলে দ্রুত সমস্যার সমাধান করা দরকার। অন্যথায়, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে এবং হাই কমিশন এবং ইএসকেএল কর্মকর্তাদের জন্য 'নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি করবে।

হাইকমিশন সূত্র জানায়, ইএসকেএল প্রতিদিন ৪৫ ডেস্কে প্রায় ৮০০ জনকে সেবা দিয়ে আসছে, কিন্তু হাইকমিশনের কাছে এ ধরনের সুবিধা বা জনবল নেই। ইএসকেএলের সঙ্গে চুক্তি বাতিল হওয়ায় এখন বিকল্প খুঁজছে হাইকমিশন। হাইকমিশনার শামীমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি টার্মিনেশন ডকুমেন্ট শেয়ার করে বলেন, এটা ছাড়া আমার আর কিছু বলার নেই। ৩ ডিসেম্বর জারি করা ওই নথিতে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালের ২২ সেপ্টেম্বর স্বাক্ষরিত চুক্তিটি তিন মাসের নোটিশের পর বাতিল করা হবে। এটি ২০২৫ সালের ২ মার্চ থেকে কার্যকর হবে।

ইএসকেএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক গিয়াস আহমেদ বলেন, ছয় বছরের চুক্তিতে প্রথম বছরের জন্য একটি প্রবেশনারি ক্লজ অন্তর্ভুক্ত ছিল এবং পারফরম্যান্সের ভিত্তিতে আরও পাঁচ বছর বাড়ানো যেতে পারে। তাদের পক্ষে কোনো অব্যবস্থাপনা নেই বলে দাবি করেন তিনি। বলেন, কোনো কারণ ছাড়াই আমাদের চুক্তি বাতিল করা হয়েছে। ‘পাসপোর্ট নবায়নের জন্য প্রবাসীদের কাছ থেকে ৩০০-৫০০ রিঙ্গিত আত্মসাৎ করত দালালরা। তারা শুরু থেকেই আমাদের অপারেশনের বিরোধিতা করে আসছে। তবে হাইকমিশনের কেউই বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলতে রাজি হননি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে হাইকমিশনের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বলেন, তারা এ বিষয়ে কাজ করছেন, এবং শিগগির একটি সমাধান খুঁজে বের করার ব্যাপারে আশাবাদী। এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কনস্যুলার অ্যান্ড ওয়েলফেয়ার উইংয়ের মহাপরিচালক শাহ মোহাম্মদ তানভীর মনসুর। তিনি বলেন, কুয়ালালামপুরের হাই কমিশন এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে।

এমআরপি সংকট ও ডেলিভারিতে দেরির বিষয়ে জানতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিরাপত্তাসেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (নিরাপত্তা ও অভিবাসন শাখা) মো. ফিরোজ সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তিনি সম্প্রতি খুলনা বিভাগীয় কমিশনার হিসেবে বদলি হয়েছেন। তিনি বলেন, এমআরপির জন্য ফয়েল পেপার আমদানি করতে আমাদের এলসি (লেটার অফ ক্রেডিট) নিয়ে আমাদের কিছু সমস্যা রয়েছে। আমরা ইতোমধ্যে সমস্যাগুলি সমাধান করেছি এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সংকটের সমাধান করা হবে।

 

ভোরের আকাশ/রন

মন্তব্য