দেশের বাজারগুলোয় ভোজ্য তেলের প্রাপ্তিতে নতুন ধরনের সংকট তৈরি হয়েছে। এই সংকট হচ্ছে আমদানিকারকরা তেল কম আমদানি করছেন। এর ফলে বাজারে তেল পাওয়া যাচ্ছে না বলে অভিযোগ করছেন ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, ১০ কার্টন তেলের অর্ডার দিলে মিলছে ২ কার্টন। আবার বাজারে আধা লিটার ও এক লিটারের বোতলজাত সয়াবিন তেল পাওয়া যাচ্ছে না। এই সংকট গত এক মাস থেকে ধীরে ধীরে বড় আকার ধারণ করেছে। তবে বাজারে তেল সরবরাহ অব্যাহত রেখেছে বলে জানিয়েছে কয়েকটি কোম্পানি।
রাজধানীর মধ্যবাড্ডার বাসিন্দা অনির্বান বিশ্বাস বলেন, তিনটি দোকান খুঁজে এক লিটার সয়াবিন তেল কিনেছি। গায়ে দাম ১৬৭ টাকা থাকলেও নিয়েছে ১৭০। আবার তেলের সঙ্গে চাল বা অন্য কোনো পণ্য কিনতে জোরাজুরি করেন দোকানি। কারওয়ান বাজারে তেলের ডিলার ইয়াসিন ট্রেডার্সের বিক্রেতা বিপ্লব চন্দ্র পাল বলেন, এক লিটার তেলের দাম ১৬৭, দুই লিটার ৩৩০ ও ৫ লিটারের দাম ৮১৫ টাকা। তবে আধা লিটার, এক লিটারের বোতলজাত তেল পাওয়া যাচ্ছে না। দুই বা পাঁচ লিটার তেলও কম পাওয়া যাচ্ছে। কোম্পানিগুলোর কাছে ১০০ কার্টনের অর্ডার দিলে দিচ্ছে ২০ কার্টন। তারা বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় আমদানি করা যাচ্ছে না। সরকার যদি নতুন করে দাম না বাড়ায়, তাহলে তেল আমদানি করা দুরূহ হয়ে পড়বে।
শুধু রাজধানী ঢাকা নয়, বরং চট্টগ্রাম নগরীর বিভিন্ন মুদি দোকানদারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দুই সপ্তাহ ধরে চাহিদা অনুযায়ী বোতলজাত সয়াবিন তেলের সরবরাহ পাচ্ছেন না তারা। আগে যেখানে সপ্তাহে ৮ থেকে ১০ কার্টন সয়াবিন তেল সরবরাহ করত, সেখানে এখন ভোজ্যতেল বিপণনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো এক থেকে দুই কার্টন তেল সরবরাহ করছে। নগরীর কাজীর দেউড়ি বাজারের মেসার্স হোসাইন স্টোরের কর্ণধার বিজয় বলেন, ১৫-২০ দিন ধরে আমরা চাহিদামতো সয়াবিন তেলের সরবরাহ পাচ্ছি না। সিটি গ্রুপ, মেঘনা গ্রুপ, টিকে গ্রুপ কেউ চাহিদামতো সয়াবিন তেল সরবরাহ করছে না। উল্টো প্রতিষ্ঠানগুলো সয়াবিন তেল সরবরাহ করার সময় তাদের কোম্পানির অন্য আইটেমের জিনিস কেনার শর্ত জুড়ে দিচ্ছে। গতকাল রোববার দুই লিটারের দুই কার্টন সয়াবিন তেল নেওয়ার জন্য ১২ কেজি চিনিগুঁড়া চাল কিনতে হয়েছে। একই বাজারের খান ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের কর্ণধার কায়সার বলেন, দেখেন আমাদের দোকানে এখন কোনো সয়াবিন তেল নেই। এক সপ্তাহ ধরে তেল সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে কোম্পানিগুলো। একই কোম্পানির অন্য পণ্য না নিলে তেল দিচ্ছে না তারা।
তবে খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাজারে সয়াবিন এবং পাম অয়েলের সরবরাহ কিছুটা কমেছে। তবে তেলের সংকট নেই। ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, সয়াবিন তেলের দাম গত সপ্তাহের মতো স্বাভাবিক রয়েছে। তবে আমদানি কম হওয়ায় সরবরাহ স্বাভাবিকের তুলনায় কিছুটা কম।
খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীরা জানান, বাজারে এখন প্রতি কেজি সয়াবিন তেল ১৬৫ থেকে ১৬৬ টাকায়, পাম অয়েল প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ১৫৫ টাকায় এবং সুপার পামঅয়েল প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ১৫৮-১৬০ টাকায়। এদিকে খাতুনগঞ্জে পাইকারিতে সয়াবিন ও পামঅয়েলের দাম স্বাভাবিক থাকলেও মুদিদোকানে বোতলজাত সয়াবিন তেল সরবরাহ সংকট তৈরি হওয়ায় মুদিদোকানে তেলের দাম বাড়তি। কিছু কিছু দোকানে ৫ লিটার ওজনের প্রতি বোতল সয়াবিনে ১০ থেকে ২০ টাকা বেশি আদায় করছেন দোকানদাররা। বোতলজাত ৫ লিটার সয়াবিন তেলের দাম গায়ে ৮২০ টাকা লেখা থাকলেও অনেকে ৮৩০ থেকে সর্বোচ্চ ৮৫০ টাকাও নিচ্ছেন। অন্যদিকে এক লিটার বোতলে বাড়তি নিচ্ছেন ৫ টাকা, দুই লিটার বোতলে বাড়তি নিচ্ছেন ১০ টাকা।
সয়াবিন তেল এবং পাম অয়েল আমদানির তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) এক লাখ ৪৮ হাজার ৮৪৯ টন তেল কম আমদানি হয়েছে। চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে যেখানে ৯ লাখ ১৯ হাজার ৭৯ টন সয়াবিন এবং পামঅয়েল আমদানি হয়। সেখানে চলতি অর্থবছরের গত চার মাসে আমদানি হয়েছে ৭ লাখ ৭০ হাজার ২৩০ টন। এই হিসাবে ৪ মাসে ১ লাখ ৪৮ হাজার ৮৪৯ টন তেল কম আমদানি হয়েছে। ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, সাধারণত প্রতি মাসে দেশে ভোজ্য তেলের চাহিদা পৌনে দুই লাখ টন। সেই হিসাবে চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে চাহিদার সমপরিমাণ তেল আমদানি হয়েছে। তাই আমদানি স্বাভাবিক থাকায় বাজারে এখন সয়াবিন তেলের সরবরাহ সংকট তৈরি হওয়ার কথা নয়।
দেশে অপরিশোধিত সয়াবিন তেল, পরিশোধিত পামঅয়েল ও সয়াবিনবীজসহ তিন ধরনের ভোজ্যতেল আমদানি হয়। এসব আমদানিতে ১৫ শতাংশ ভ্যাট ছিল। বাজার স্থিতিশীল রাখতে অন্তর্বর্তী সরকার গত ১৭ অক্টোবর ভ্যাটের এ হার কমিয়ে ১০ শতাংশে নামিয়ে আনে। এর পর গত ১৯ নভেম্বর শুল্ককর ৫ শতাংশ কমিয়ে ৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়। ফলে প্রতি কেজি অপরিশোধিত সয়াবিন ও পামঅয়েলে শুল্ককর কমেছে ১০-১১ টাকা। শুল্ককর কমলেও বাজারে এর ইতিবাচক কোনো প্রভাব পড়েনি। বরং শুল্ককর কমানোর পর ভোজ্য তেলের আমদানি কমেছে।
সূত্র মতে, দেশে বছরে ২৪ লাখ টন ভোজ্য তেলের প্রয়োজন হয়। এর ৯০ শতাংশই আমদানিনির্ভর। এতে বছরে ৪৬ থেকে ৫০ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়। বাজারে তেলের সরবরাহ কম কেন- জানতে চাইলে দেশে ভোজ্য তেলের অন্যতম বড় আমদানি ও সরবরাহকারী কোম্পানি টিকে গ্রুপের পরিচালক (ব্র্যান্ড) শফিউল আতাহার তসলিম বলেন, আমরা ঠিকমতোই সরবরাহ করছি। তা ছাড়া গত ৪ মাসে প্রায় দেড় লাখ টন তেল কম আমদানি হয়েছে। আশা করি, চলতি ডিসেম্বরে তেল আমদানির পরিমাণ বাড়বে। তখন সমস্যা কেটে যাবে। তেলের সঙ্গে ক্রেতাদের অন্য পণ্য কিনতে হচ্ছে কেন- প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, এটি ডিলাররা করছেন। তারা আমাদের জানিয়েছেন দোকানিরা শুধু তেল চান। আগে যারা ২০ কার্টন নিত, এখন তারা ৩০ কার্টন চান। আমরা শুধু তেল বিক্রি করে চলতে পারব না। এজন্য তাদের অন্য পণ্যও কিনতে বলছি।
বিশ্ববাজারে তেলের মূল্যবৃদ্ধি পাওয়ায় আমদানি কম হচ্ছে উল্লেখ করে সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা বলেন, বিশ্ববাজারে তেলের দাম অনেক বেড়েছে। এই অবস্থায় দাম না বাড়ালে তেল আমদানি করা আমাদের জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। প্রতি মাসে পাঁচটি পণ্যের একটি হিসাব দিয়ে থাকে জাতিসংঘের ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচার অর্গানাইজেশন (এফএও) এফএফপিআই নামে। সেই এফএফপিআই অনুযায়ী, গত অক্টোবর মাসের তুলনায় নভেম্বরে প্রতি টনে বিশ্ববাজারে ভেজিটেবল অয়েলের সূচক গড়ে ১১ দশমিক ৪ পয়েন্ট বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৬৪ দশমিক ১ পয়েন্টে। অক্টোবরে ছিল প্রতি টনে ১৫২ দশমিক ১। এই দাম বৃদ্ধি শতাংশ হিসেবে ৭ দশমিক ৫। আর এই বৃদ্ধি ২০২২ সালের জুলাইয়ের পর থেকে সর্বোচ্চ। এফএও বলছে, পাম-সয়াবিন-সূর্যমুখীসহ সব ধরনের তেলের দামই বেড়েছে। কারণ হিসেবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের কারণে প্রত্যাশার চেয়ে বৈশ্বিক উৎপাদন কম হয়েছে। পামঅয়েলের দাম টানা ষষ্ঠ মাসের মতো বৃদ্ধি পাওয়ায় সংস্থাটি উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তা ছাড়া বিশ্বব্যাপী আমদানি চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় বিশ্ববাজারে সয়াবিন ও সূর্যমুখী তেলের দাম বেড়েছে বলেও উল্লেখ করা হয়।
ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) প্রতি মাসে এক কোটি কার্ডধারী পরিবারের বাইরেও প্রতিদিন সারা দেশে ২৮ হাজার মানুষের মধ্যে মসুর ডাল, পেঁয়াজ, আলু ও ১০০ টাকা দরে দুই লিটার সয়াবিন তেল বিক্রি করে থাকে। টিসিবির এই তেলের প্রতি মানুষের বর্তমানে চাহিদা সবচেয়ে বেশি। গত বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টার দিকে রাজধানীর খামারবাড়ী এলাকায় দেখা যায় ২০০-২৫০ মানুষের জটলা। গাড়ি আসার অপেক্ষা করছিলেন তারা। সেখানে উপস্থিত চান মিয়া বলেন, বাজারে সয়াবিন তেল বেশি পাওয়া যাচ্ছে না। টিসিবিতে এই তেল কম দামে পাওয়া যাচ্ছে। আমরা এটি পেয়ে খুবই উপকৃত হচ্ছি।
এ ব্যাপারে টিসিবির আঞ্চলিক কার্যালয়ের যুগ্ম পরিচালক ও মুখপাত্র মো. হুমায়ুন কবির বলেন, টিসিবি প্রতি মাসে এক কোটি পরিবারের মধ্যে তেল, ডাল, আলু বিক্রি করছে। তার বাইরে গত ২৪ অক্টোবর থেকে ঢাকা ও চট্টগ্রামে ৭০টি ট্রাকের মাধ্যমে প্রতিদিন ২৮ হাজার মানুষকে তেল, মসুর ডাল, আলু ও পেঁয়াজ সরবরাহ করছে। এ কার্যক্রম ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত চলার কথা থাকলেও মানুষের বর্তমান অবস্থা বিবেচনা করে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত জারি রাখা হয়েছে। আগামীতেও এটি জারি থাকলে সাধারণ মানুষ উপকৃত হবে।
ভোরের আকাশ/রন
মন্তব্য