বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর তার নেতাকর্মীরা বিদ্বেষ-প্রতিহিংসা, গ্রেপ্তার, হামলা-মামলা এড়াতে যে যার মতো করে নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে নিয়েছেন। ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডাসহ যার যে দেশে সুযোগ ছিল, চলে গেছেন। কিন্তু যাদের সেই সুযোগ ছিল না তাদের অনেকেই আশ্রয় নিয়েছেন প্রতিবেশী ভারতে। তারা দেশটিতে প্রবেশ করেছেন বিনা-ভিসায় অবৈধভাবে। তাদেরকে বলা হচ্ছে অনুপ্রবেশকারী। এরই মধ্যে অনুপ্রবেশের অভিযোগে চারজনকে কলকতায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এরপর থেকে অন্যদের মধ্যে গ্রেপ্তার আতঙ্ক বিরাজ করছে বলে জানা গেছে।
নিরাপদ আশ্রয় মনে করে ভারতে প্রবেশ করা এসব আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের অনেকেই নানাভাবে নানা হেনস্তার শিকার হচ্ছেন। কেউ কেউ অভিযুক্ত হচ্ছেন অপরাধ কর্মে। সম্প্রতি ভারতের জি নিউজ জানিয়েছে, সিলেট থেকে শিলংয়ে আশ্রয় নেওয়া ছয়জন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী একটি ধর্ষণ কাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছেন। শিলং পুলিশ ছয় অভিযুক্তের মধ্যে চারজনকে কলকাতা থেকে গ্রেপ্তার করেছে। কিন্তু গ্রেপ্তার হওয়া অভিযুক্তরা ধর্ষণের ঘটনা অস্বীকার করেছেন। তারা বলেছেন, সিলেট থেকে গিয়ে উঠেছিলেন শিলং শহরের কাছাকাছি একটি ফ্ল্যাটে। কিন্তু শিলংয়ে অতিরিক্ত শীত পড়ার কারণে তারা সেই ফ্ল্যাট ছেড়ে কলকাতা চলে যান। শিলং ত্যাগের সময় তারা নিয়ম অনুসারে ফ্ল্যাট ত্যাগের বিষয়টি থানাকে অবহিত করেননি। সেই কারণেই তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
বিবিসি জানিয়েছে, ধর্ষণের ঘটনাটি আসলে একটি গুজব। তাদেরকে মেঘালয়ের একটি ফৌজদারি মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মেঘালয় পুলিশের মহাপরিচালক ইদাশিশা নংরাং বলেছেন, গ্রেপ্তারকৃতদের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ আছে বলে যে খবর রটেছে, তা সঠিক নয়। মেঘালয়ের স্থানীয় সূত্রগুলো জানিয়েছে, ডাউকি সীমান্তে ট্রাক চালকদের সঙ্গে অক্টোবর মাসে হাতাহাতির ঘটনায় তাদের চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
এছাড়া গত নভেম্বর মাসে ত্রিপুরা রাজ্যে গ্রেপ্তার হয়েছেন ১৬ জন বাংলাদেশি। আসামের স্থানীয় সংবাদমাধ্যম দ্য সেন্টিনাল আসামের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতের সরকারি রেলওয়ে পুলিশ (জিআরপি), সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ এবং উত্তর-পূর্ব সীমান্ত রেলওয়ে সুরক্ষা বাহিনী আরপিএফ যৌথ অভিযান চালিয়ে ওই বাংলাদেশিদের গ্রেপ্তার করেছে। এতে বলা হয়, ওই বাংলাদেশিরা অবৈধভাবে ভারতে প্রবেশ করেন। পরে ত্রিপুরার রেলস্টেশন থেকে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। গত বৃহস্পতিবার ধর্মনগর রেলওয়ে স্টেশনে ত্রিপুরা সুন্দরী এক্সপ্রেস ট্রেনে নিয়মিত তল্লাশির সময় এক নারীসহ চার বাংলাদেশিকে আটক করে বিএসএফ ও আরপিএফের একটি দল।
পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদে চারজনের এই দলটি আন্তঃসীমান্ত দালাল চক্রের সহায়তায় ত্রিপুরার সিপাহিজালা জেলার সোনামুড়া সীমান্ত দিয়ে ভারতে প্রবেশের কথা স্বীকার করে। এছাড়া পৃথক অভিযানে ত্রিপুরার খোয়াই জেলার তেলিয়ামুরা রেলওয়ে স্টেশন থেকে এক কিশোরীসহ ১২ বাংলাদেশিকে গ্রেপ্তার করেছে রেলওয়ে পুলিশ। এ সময় তাদের কাছ থেকে মোবাইল ফোনসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র উদ্ধার করা হয়। পরবর্তীতে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য গ্রেপ্তারকৃত সব বাংলাদেশি নাগরিককে বিএসএফের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
এই ঘটনার আগে আরো একটি গ্রেপ্তারের ঘটনা ভারতীয় গণমাধ্যমে স্থান পেয়েছে। বার্তা সংস্থা টিএনএনের বরাত দিয়ে টাইমস অব ইন্ডিয়া জানিয়েছে, গত সেপ্টেম্বর মাসে সুন্দরবনের কোস্টাল পুলিশ ১১ জন বাংলাদেশি নাগরিককে গ্রেপ্তার করেছে। তারা সবাই লুকিয়ে ছিল ঝিলা জঙ্গলে। পুলিশ বলেছে, তারা সকলেই আওয়ামী লীগের কর্মী। পরদিনই গ্রেপ্তারকৃতদের আলীপুর আদালতে হাজির করা হয়। তাদের মধ্যে আদালত চারজনকে পুলিশ হেফাজতে দেন এবং চারজন নারী বন্দিকে পাঠানো হয় কারাগারে। এই ১১ জনের মধ্যে তিনটি ছিল শিশু। তাদেরকে পাঠানো হয় চাইল্ড ওয়েলফেয়ার কমিটির হেফাজতে।
এসব কারণে ভারতে আশ্রয় নেওয়া আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা স¦াভাবিকভাবেই গ্রেপ্তার আতঙ্কে রয়েছেন। কারণ বাংলাদেশ থেকে যারা ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন তাৎক্ষণিকভাবে তাদের হয়তো ভিসাসংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি। তারা চিহ্নিত হচ্ছেন অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসেবে। কারণ একাত্তরের মতো তাদের জন্য ভারত সীমান্ত খোলা ছিল না। কেউ গেছেন দালালের মাধ্যমে। কেউ গেছেন লুকিয়ে। ভারত সীমান্তে বিএসএফ সক্রিয় থাকলেও তাদেরকে সবার চোখ ফাঁকি দিয়েই প্রতিবেশী এই দেশটিতে প্রবেশ করতে হয়েছে।
বাংলাদেশ থেকে যাওয়া এসব বিত্তবান নেতাকর্মীরা প্রথম দিকে দ্রুত হোটেলে উঠলেও পরে তারা হয়তো স্থানীয় প্রভাবশালী কারো নজরে রয়েছেন। তাদের কেউ কেউ ঘুরাফিরাও করছেন নির্ভয়ে, নিজ দেশের মতো। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের একটি ছবি মুদ্রিত হয়েছে এদেশের গণমাধ্যমে, তিনি কলকাতার একটি পার্কে আরো কয়েকজন নেতাকর্মীসহ বসে বসে সময় কাটাচ্ছেন। এছাড়া কয়েকজন প্রভাবশালী নেতাকর্মীকে দেখা গেছে লণ্ডনের একটি অনুষ্ঠানে। সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বর্তমানে অবস্থান করছেন বেলজিয়ামে নিজের বাড়িতে। সেখান বসে তিনি ষোল বছরের শাসনামল নিয়ে বিভিন্ন অনুশোচনার ভিডিও বার্তা পাঠাচ্ছেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো একজন মানুষের সচল থাকার জন্য মৌলিক চাহিদা হলো অর্থ। তারা কত অর্থ সঙ্গে নিয়ে গেছেন বা তাদের জীবিকার উৎস কি?
ভোরের আকাশ/রন
মন্তব্য