শিরোনাম

ফুঁসছে বাংলাদেশ

এম. সাইফুল ইসলাম
ফুঁসছে বাংলাদেশ

১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের মহান বিজয় দিবস। রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের এই দিনে বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রটি স্বাধীনতা অর্জন করে। সেই থেকে প্রতিবছর ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস হিসেবে পালন করে আসছে বাংলাদেশ। অথচ বাংলাদেশের বিজয় দিবসকে অস্বীকার করে ভারতের রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু ও দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিতর্কিত পোস্ট দিয়েছেন। তাদের এই পোস্ট নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া ও ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে বাংলাদেশে। পার্শ্ববর্তী দেশের রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের বিতর্কিত পোস্টের পর ব্যাপক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন বাংলাদেশের সব শ্রেণি-পোশার মানুষ। বিষয়টির কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পর্যায় থেকে শুরু করে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি, জামায়াত ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা। এছাড়া সাধারণ মানুষও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিবাদের ঝড় তুলেছেন।

তারা বলছেন, ভারতের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর পোস্টে প্রমাণিত হচ্ছে দেশটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা অস্বীকার করছে। এটি কোনো শিষ্টাচারের মধ্যেই পড়ে না। বিশ্লেষকরা বলছেন, সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের প্রতি ভারতের ধারাবাহিক অবজ্ঞাসূচক বক্তব্যে সম্পর্কের আরো অবনতি হতে পারে।

ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বেশ কয়েকটি ইস্যুতে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের টান টান উত্তেজনা চলছে। বিশেষ করে পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দেওয়া ও কথিত সংখ্যালঘু নির্যাতনের ইস্যুতে টানাপড়েন অব্যাহত রয়েছে। যার ফলশ্রুতিতে, ভারতে বাংলাদেশের হাইকমিশনে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটেছে। এর মধ্যেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের মহান বিজয় দিবসে বিতর্কিত স্ট্যাটাস দেওয়ায় উত্তেজনা আরো বেড়েছে। বিজয় দিবসে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এক্স হ্যান্ডেলে পোস্ট করেছেন ভারতের রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু। তিনি লেখেন, ‘১৯৭১ সালের যুদ্ধে যারা অদম্য সাহসিকতার সঙ্গে ভারতের জয় নিশ্চিত করেন, তাদের প্রতি আমি শ্রদ্ধা জানাই’।

শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এক্স হ্যান্ডেলে পোস্ট করেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তিনি লেখেন, ‘১৯৭১ সালে ‘ভারতের ঐতিহাসিক বিজয়ে’ বীর সৈনিকদের সাহস ও আত্মত্যাগকে সম্মান জানাই’। দেশটির শীর্ষ দায়িত্বশীল পর্যায় থেকে বাংলাদেশের বিজয় দিবসকে অস্বীকার করে দেওয়া বক্তব্যে ব্যাপক অসস্তোষ সৃষ্টি হয়েছে বাংলাদেশের নানা শ্রেণি পেশার মানুষের মাঝে। অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা থেকে শুরু করে দেশের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দল ও বিশিষ্টজনেরা বিষয়টি ভালোভাবে নেননি।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও বিজয় দিবস নিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল। ১৬ ডিসেম্বর আইন উপদেষ্টা তার ভেরিফাইড ফেসবুক স্ট্যাটাসে লেখেন, তীব্র প্রতিবাদ করছি। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ ছিল বাংলাদেশের বিজয়ের দিন। ভারত ছিল এ বিজয়ের মিত্র, এর বেশি কিছু নয়। তিনি আরও বলেন, পোস্টে সুকৌশলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ভারতের যুদ্ধ বলে দাবি করেছেন নরেন্দ্র মোদি। পাশাপাশি, বিজয় দিবসটা যে দেশের, সেই বাংলাদেশের নামই এড়িয়ে গেছেন তিনি।

নরেন্দ্র মোদির বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে নৌপরিবহন উপদেষ্টা বিগ্রেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তার মতো করে বলেছেন। তার এমন মন্তব্যে মুক্তিযোদ্ধারা যারা এখনও বেঁচে আছেন তারা আহত হয়েছেন। তিনি বলেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী যে কথা বলেছেন, সেটি তার কথা। ১৬ ডিসেম্বর এবং ৯ মাসের যুদ্ধ এটি বাংলাদেশের। ৯ মাস আমাদের দেশ বড় রক্তপাতের মাধ্যমে কাটিয়েছে। আমাদের মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। আমাদের মা-বোনদের সম্ভ্রমহানি হয়েছে এবং ৯ মাস আমাদের দেশ একটা বড় ধরনের রক্তপাতের মধ্যে ছিল। মুক্তিযুদ্ধের ৫৩ বছর পরে এসে এমন মন্তব্যে যারা যুদ্ধ করেছেন, তারাও আহত হয়েছেন। তিনি বলেন, ভারত মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে অন্যভাবে দেখে সেটা তাদের ব্যাপার। কিন্তু বিশ্ববাসী জানে এটা শুধু বাংলাদেশের বিজয়।

বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, বাংলাদেশকে নিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বক্তব্য মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের অবমাননার শামিল। সোমবার কেরানীগঞ্জের বিজয় র‌্যালি শেষে এসব কথা বলেন তিনি। তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে বিএনপির এই মুখপাত্র বলেন, ৭১ সালে পাকিস্তানিদের সঙ্গে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধ। ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে ও ২ লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে আমরা একটি স্বাধীন দেশ পেয়েছি। এই স্বাধীনতার যুদ্ধকে ভারত নিজেদের অর্জন হিসেবে দাবি করা মানে বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতাকে অস্বীকার করা। ৩০ লাখ শহীদ ও ২ লাখ মা বোনদের ইজ্জতকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা। রিজভী বলেন বলেন, আমরা রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছি। দিল্লির কাছে আমরা মাথানত করতে নয়।

বাংলাদেশে জামায়াত ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আব্দুল হালিম দৈনিক ভোরের আকাশকে বলেছেন, ভারত যে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশকে স্বাধীন ও সার্বেভৌম একটি দেশ হিসেবে সঠিকভাবে গ্রহণ করতে পারেনি সেটি নরেন্দ্র মোদির পোস্টে প্রমাণ করে। ভারতের এ আচরণ মেনে নেওয়া যায় না। দেশটির পক্ষ থেকে ধারাবাহিকভাবে এ ধরনের অবজ্ঞাসূচক বক্তব্য দিতে থাকলে দুদেশের সম্পর্কের আরো অবনিত হবে।

এদিকে, বিজয় দিবস নিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বক্তব্যের প্রতিবাদ জানাতে অন্তর্বর্তী সরকারকে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব আখতার হোসেন। ১৬ ডিসেম্বর বিকেলে রাজধানীতে জাতীয় নাগরিক কমিটির আয়োজিত ‘বিজয় র‌্যালি’র পরবর্তী সমাবেশে তিনি এ দাবি জানান। সমাবেশে আখতার হোসেন বলেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ১৬ ডিসেম্বরকে বাংলাদেশের বিজয়ের বদলে ভারতের বিজয় বলে উল্লেখ করেছেন। এটি একটি হীন এবং অগ্রহণযোগ্য বক্তব্য। আমরা এর তীব্র প্রতিবাদ জানাই। অন্তর্বর্তী সরকারকে অবিলম্বে এ বক্তব্যের বিরুদ্ধে নিন্দা জানাতে হবে। জাতীয় নাগরিক কমিটি সদস্য সচিব, দেশের স্বাধীনতা, ন্যায়বিচার এবং সার্বভৌমত্ব রক্ষায় জনগণকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান।

বিষয়টি নিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের সাবেক অদ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. দিলারা চৌধুরী দৈনিক ভোরের আকাশকে বলেছেন, কোনো দেশের সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে আরেক দেশের জন্মকে অস্বীকার করার বিষয়টি কোনো ভদ্র আচরণ ও শিষ্টাচারে মধ্যে পড়ে না। মহান মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের বিজয় দিবসকে অস্বীকার করে ভারত সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে যে বক্তব্য দেওয়া হয়েছে তাতে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আরো অবনতি হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। তিনি বলেন, এখানে ভারতের বিরোধিতা করে বক্তব্য দেন তাদেরকে সত্য প্রমাণিত করা হয়েছে।

 

ভোরের আকাশ/রন

মন্তব্য