দালালচক্রের খপ্পরে পড়ে সাগর পথে অবৈধভাবে ইতালি ও গ্রিসসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে নিয়মিতই যাচ্ছেন অনেক বাংলাদেশি। এ জন্য লিবিয়াকে ল্যান্ডিং স্টেশন হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে। দেশটিতে অনেক বাংলাদেশিকে জিম্মি করে আদায় করা হচ্ছে মুক্তিপণ। অনেকে সর্বস্ব খুঁইয়েছেন দালালদের কাছে। সাগর পাড়ি দেওয়ার সময় নৌকা ডুবে অনেকের প্রাণহানি ঘটছে। এছাড়া অনেক মানুষ নিখোঁজ রয়েছেন। অনেকের মৃত্যুর সংবাদও পাচ্ছেন স্বজনরা।
সম্প্রতি দালালের মাধ্যমে স্বজনদের লিবিয়ায় যাওয়ার পর ‘মাফিয়াদের’ হাতে আটক থাকা ও মুক্তিপণ চাওয়ার বিষয়টি তুলে ধরেছে চুয়াড়াঙ্গা, শরীয়তপুর ও মাদারীপুরের বেশ কয়েকটি পরিবার। অভিবাসন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট বিচ্ছিন্নভাবে দু-একজনকে গ্রেপ্তার করলেও পরে আর তদন্ত এগোয়নি। লিবিয়া হয়ে ইউরোপে যাওয়া থামাতে না পারার এটাও একটা কারণ। আরেকটি কারণ হল - একবার ইউরোপে ঢুকতে পারলে চাকরি পাওয়া ‘নিশ্চিত’ বলে ধরে নেওয়া। তারা মনে করেন, দালালদের বিচারের আওতায় আনতে পারলে এ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ অভিবাসন নিরুৎসাহিত করা সম্ভব হত। লিবিয়ায় জিম্মি করার পর মুক্তিপণের টাকা নেওয়া হয় বাংলাদেশে ভুক্তভোগীর পরিবারের কাছ থেকে- এ বিষয় ধরে চক্রটির এদেশীয় সব সদস্যকে চিহ্নিত করা সম্ভব বলে মনে করেন ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রাম অ্যান্ড ইয়ুথ প্ল্যাটফর্মের সহযোগী পরিচালক শরীফুল হাসান। তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন মোবাইল ব্যাংকিং নম্বর, ব্যাংক অ্যাকাউন্টে টাকা লেনদেন হয় বা চক্রের সহযোগী কোনো ব্যক্তি সরাসরি গিয়ে ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর কাছ থেকে মুক্তিপণের টাকা নেন। এই টাকা আদায়ের সূত্র ধরে এদেশীয় পুরো চক্রটাকে শনাক্ত করা যায়, অন্তত তাতেও এই প্রবণতা কিছুটা কমতে পারে। কারণ অর্গানাইজড এই ক্রাইমগুলোর ক্ষেত্রে ফিন্যান্সিয়াল লেনদেনটা বড় বিষয়।’ পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ, সিআইডি ও পুলিশের অন্যান্য ইউনিট যে যার মত কাজ করছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘দালালদের নির্মূল করতে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে, এই চক্রগুলোর বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ ডেটাবেইজ গড়ে তুলতে হবে।’ এ বিষয়ে সিআইডির অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (অতিরিক্ত আইজি) মতিউর রহমান শেখ বলেন, ‘অপরাধ কখনোই পুরোপুরি নির্মূল করা সম্ভব নয়। নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। এটা একটা অর্গানাইজড ক্রাইম (সংঘবদ্ধ অপরাধ)। তিনি বলেন, ‘মানবপাচারের এই বিষয়গুলো আমাদের টপ প্রায়োরিটির তালিকায় আছে। পুলিশের অন্যান্য ইউনিটের চেয়ে এ বিষয়ে সিআইডির সামর্থ্য ও প্রশিক্ষণ বেশি। আমরা এগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’ লিবিয়া ফেরত ৫৫৭ জন বাংলাদেশির কাছ থেকে তথ্য নিয়ে গত ফেব্রুয়ারিতে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে ব্র্যাক। এ প্রতিবেদনে লিবিয়ায় অভিবাসনপ্রত্যাশীদের নির্যাতন ও মুক্তিপণ আদায়ের নির্মম গল্পগুলো উঠে আসে।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, লিবিয়া ফেরত এসব বাংলাদেশির ৬০ শতাংশের পরিবারকে স্থানীয় দালালরা ভালো চাকরির লোভ দেখিয়েছিল। কিন্তু ৮৯ শতাংশই চাকরি বা কোনো কাজ পাননি। উল্টো নানা ধরনের ঝুঁকিতে পড়েছেন। এ বিষয়ে কাজ করা ব্যক্তি ও সংস্থার মতে, ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে যে অভিবাসনের ধারা চলছে তাতে শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশিরা। ইউরোপে ঢোকার নয়টি রুটের মধ্যে বাংলাদেশিরা লিবিয়া থেকে নৌকায় ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি যাওয়াকে বেশি বেছে নিচ্ছে। এ যাত্রাপথে সাগরে ডুবে মৃত্যুঝুঁকি তো আছেই, এর পাশাপাশি লিবিয়ার পথে পথে আরেক বিপদ হচ্ছে ‘মাফিয়ারা’। এখানে একদল বাংলাদেশি স্থানীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের জিম্মি করে টাকা আদায়ের ‘বাণিজ্য’ খুলে বসেছে। শরীফের মত আরও অনেকে এ ‘মাফিয়া’ চক্রে যোগ দিয়েছে। যে কারণে সর্বনাশের শঙ্কা আছে জেনেও লোভে পড়ে নতুন আশায় আবারও অনেকে পা দিচ্ছেন ভয়ঙ্কর এ ফাঁদে। যাওয়া যে থেমে নেই তা আবার সামনে এসেছে ইতালি নেওয়ার কথা বলে লিবিয়ায় নিয়ে আটকে রাখা চুয়াডাঙ্গার ৩৭ জনের পরিবারের সদস্যদের গত ১২ ডিসেম্বর চুয়াডাঙ্গা প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলনের পর। ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর অভিযোগ, তাদের স্বজনরা ১৫ থেকে ২০ লাখ দালালদের দিয়েছিলেন ইতালি যাওয়ার জন্য। এখন দালালরা তাদের লিবিয়া নিয়ে আটকে রেখে নির্যাতন করে আরও ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকা দাবি করছে। এই ৩৭ তরুণের বেশিরভাগই চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গার নাগদাহ ইউনিয়নের বাসিন্দা। এ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান দারুস সালাম বলেন, ‘এর আগে এই গ্রামের আরও অনেক লোক ইতালি গিয়েছে। তারা এখন ইতালিতে অবস্থান করছে, সেখানে কাজবাজ কইরে ভালো চলছে। এইসব দেইখে বাকিরা যাওয়ার জন্য দালালের টাকা দিছে। দালালরা আরো টাকা চায়, এজন্য নির্যাতন করছে বলে ফ্যামিলিগুলো জানিয়েছে। একজন ভিকটিমের পরিবার মামলা করেছে। মামলার এখনো কোনো আসামি গ্রেপ্তার হয়নি।’ এ ইউনিয়নের আব্দুল্লাহ জাহির দীপু লিবিয়ায় মাফিয়াদের হাতে আটকে আছেন। তার বোন সাবিনা খাতুন বলেন, ‘দালালেরা তাদের বলেছিল এক মাসের মধ্যে ইতালি পৌঁছে দেবে। কিন্তু এক বছর পার হতে চলল, ওদের আটকে রেখে মারধর করছে। ভিডিও কলে রেখে তাকে অত্যাচার করছে আর টাকা চাচ্ছে। গলায় পাড়া দিচ্ছে, হাত-পা বেঁধে মারছে।’ তিনি বলেন, ‘দালাল জিমকে এয়ারপোর্টে তিন লাখ টাকা দেওয়া হয়। দীপু দুবাই পৌঁছানোর পর দালালের বাড়ি গিয়ে সাত লাখ টাকা পৌঁছে দিই আমরা। এখন তারা আরও টাকা চায়।’ সদ্য কৈশোর পেরোনো তুহিন মিয়াকে (১৯) বিদেশ পাঠিয়ে সংসারে সচ্ছলতার স্বপ্ন দেখছিল তার পরিবার। কিন্তু এখন এ তরুণও আটকা পড়েছেন লিবিয়ার ‘গেম ঘরে’। তাকে নির্যাতন করে পরিবারের কাছে টাকা দাবি করা হচ্ছে। তুহিন মিয়ার বাবা কৃষক রেজাউল হক বলেন, দালাল সাগর ও জিমের মাধ্যমে তুহিনকে পাঠান তিনি। তাদের চাহিদামত সব টাকা শোধ করা হয়েছে। এখন লিবিয়ায় আটকে রেখে আরও ৭ লাখ টাকা দাবি করছে তারা। তিনি বলেন, ‘আমার যা ছিল সব দিয়েই ছেলেরে পাঠালাম। এখন ওরা আরও টাকা চায়। আমি একেবারে পথে বইসে গেছি। ঘরে খাওয়ার টাকা নিয়ে টানাটানি অবস্থা। এতো টাকা কইত্থেকে দেব।’ চুয়াডাঙ্গার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (এসপি পদে পদোন্নতি পাওয়া) রিয়াজুল ইসলাম বলেন, ‘মামলায় সাতজনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা কয়েকজনকে আসামি করা হয়েছে। আসামিরা এলাকার বাইরে ও বিদেশে আছে। আমরা তাদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা করছি। প্রতিটি পরিবার ১৫ লাখ করে টাকা দিয়েছে আসামিদের। মোট সাড়ে তিন কোটি টাকা পরিশোধ করেছে তারা।’ চুয়াডাঙ্গার তরুণদের বিপদে থাকার খবর প্রকাশের চার দিন আগে ৮ ডিসেম্বর শরীয়তপুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে লিবিয়ায় জিম্মি স্বজনদের মুক্তি চেয়ে মানববন্ধন করেন মাদারীপুর ও শরীয়তপুরের ভুক্তভোগী অন্তত ২৪টি পরিবারের সদস্যরা। ভুক্তভোগী এক যুবকের বাবা চুন্নু ভূঁইয়া বলেন, ‘মাফিয়ারা কয়েক দফায় ২৮ লাখ টাকা নিয়েছে। আমি সহায়-সম্বল বিক্রি করে তাদের হাতে টাকা দিয়েছি। কিন্তু এখনো জানি না আমার ছেলে লিবিয়ায় কী অবস্থায় আছে। আমি দালালদের বিরুদ্ধে মামলা করেছি। ছেলেকে ফেরত চাই আর দালালদের বিচার চাই।’ মানববন্ধনে ছিলেন লিবিয়ায় দালালদের কাছে জিম্মি অবস্থায় থাকা শাজাহান হাওলাদারের মা মেহেরজানও। তিনি গণমাধ্যমকে বলছিলেন, ‘আমার সন্তান বেঁচে আছে, নাকি মরে গেছে কিছুই জানি না। দালাল প্রলোভন দেখিয়ে আমার সন্তানকে লিবিয়ায় নিয়ে আটকে রেখেছে। ভিটাবাড়ি ও জমিজমা বিক্রি করে তাদের টাকা দিয়েছি। কিন্তু তারা আমার সন্তানকে ছাড়েনি। আমি আমার সন্তানকে ফেরত চাই।’ ২০২০ সালের ২৮ মে লিবিয়ার মিজদাহ এলাকার একটি ‘গেম ঘরে’ ২৬ বাংলাদেশিসহ ৩০ অভিবাসন প্রত্যাশীকে গুলি করে হত্যা করে ‘মাফিয়ারা’। ওই ঘটনার পর লিবিয়ার বাংলাদেশি ‘মাফিয়াদের’ নিয়ে আলোচনা শুরু হলে সরকার ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেয়। কয়েকটি মামলায় ১৫ জনের মতো গ্রেপ্তার করা হয়। কিন্তু এরপর আর তদন্ত এগোয়নি। ব্র্যাকের শরীফুল হাসান বলেন, লিবিয়া থেকে ইউরোপে যাওয়ার এ পথ ‘সেন্ট্রাল মেডিটারেনিয়ান রুট’ হিসেবে পরিচিত। এ পথে লিবিয়া থেকে ২০০৯ সাল থেকে গত বছর পর্যন্ত ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে (ইতালি বা গ্রিসে) যাওয়া ৭০ হাজারের বেশি বাংলাদেশি শনাক্ত হয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা ভাবছিলাম হয়তো সংখ্যাটা কমবে। কিন্তু ২০২৩ ও ২০২৪ সালের হিসাব বলছে, বাংলাদেশিদের সংখ্যা আরও বেড়েছে। এখন সাগর পাড়ি দিয়ে ইতালিতে ঢোকা বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের মধ্যে বাংলাদেশিরা শীর্ষে।’ জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনের (ইউএনএইচসিআর) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ১০ মাসে ২৯টি দেশের ৫৫ হাজার ৪১৩ জন ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালিতে ঢুকেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১১ হাজার ২৩১ জন বাংলাদেশি, যা সাগর পাড়ি দিয়ে ইতালিতে ঢোকা মোট সংখ্যার ২০ দশমিক ৩ শতাংশ। ইউএনএইচসিআরের ওয়েবসাইট থেকে পাওয়া হালনাগাদ হিসাব বলছে, ২০২৩ সালে সাগর পাড়ি দিয়ে ১ লাখ ৫০ হাজার ২৭৩ জন ইতালিতে ঢুকেছেন। লিবিয়া থেকে ইতালিতে ঢোকা অভিবাসীদের মধ্যে বাংলাদেশিরা শীর্ষে। এই বছর ১২ হাজার ৩০৩ জন বাংলাদেশি লিবিয়া হয়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালিতে ঢুকেছেন। ইউএনএইচসিআরের পরিসংখ্যান বলছে, ২০২১ ও ২০২২ সালে নাগরিকত্বের ভিত্তিতে সাগর পাড়ি দিয়ে ইতালিতে ঢোকার পরিসংখ্যানে বাংলাদেশ ছিল তৃতীয়। এই ২৪ মাসে ২২ হাজার ১০৫ জন বাংলাদেশি সাগর পাড়ি দিয়ে ইতালিতে গেছেন।
ভোরের আকাশ/রন
মন্তব্য