রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে বেড়েছে খুন, ছিনতাই ও ডাকাতির মতো অপরাধ। কোনোভাবেই পরিস্থিতি সামলাতে পারছেন না আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। গত বৃহস্পতিবার প্রকাশ্য দিবালোকে রাজধানী ঢাকার অদূরে ব্যাংক কর্মকর্তাদের জিম্মি করে ডাকাত দলের সদস্যরা। পরে অবশ্য তিন ডাকাতকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ছিনতাইকারীদের হাতে নিহত হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। সন্ধ্যা হলেই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে মানুষের মধ্যে। চুরি-ডাকাতির ঘটনা নৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। খুনের ঘটনাও বেড়েছে। লেক, নদী বা খোলা মাঠ থেকে উদ্ধার হচ্ছে লাশ। যৌথ বাহিনীর বিশেষ অভিযান, র্যাব-পুলিশের তৎপরতা - কোনো কিছুই কাজে আসছে না।
পুলিশ সদর দপ্তরের মুখপাত্র এআইজি (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর বলেন, প্রতিটি ঘটনাতেই পুলিশ কুইক রেসপন্স করছে। আসামিদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। বিচারের জন্য আদালতে সোপর্দ করা হচ্ছে। একই সঙ্গে প্রো-অ্যাক্টিভ পুলিশিংয়ের জন্য পেট্রোলিং ও ভিজিলেন্স বাড়ানো হয়েছে। গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। সারা দেশেই পুলিশ অ্যাক্টিভ রয়েছে।
গত বুধবার সন্ধ্যায় মোহাম্মদপুর শেখেরটেকের ৬ নম্বর সড়ক দিয়ে কোচিং সেন্টার থেকে বাসায় ফিরছিলেন হাসিব। ব্যস্ত সড়কেই ধারালো অস্ত্র ঠেকিয়ে চারজন ছিনতাইকারী তার কাছ থেকে মোবাইল ফোন ও মানিব্যাগ ছিনিয়ে নেয়। আশপাশে লোকজন থাকলেও এগিয়ে আসেনি কেউ। যাওয়ার সময় ছিনতাইকারীরা তাকে মারধরও করে। হাসিব জানান, ছিনতাইকারীরা হঠাৎ তার পেটে চাপাতি ঠেকিয়ে মোবাইল ও মানিব্যাগ নিয়ে গেছে। ১৬ ডিসেম্বর রাত ১১টা। আসাদ গেট এলাকায় যানজটে আটকে আছে অসংখ্য গাড়ি। এর মধ্যে তিন যুবক চাপাতি হাতে ঘুরে বেড়াচ্ছে শিকারের খোঁজে। একপর্যায়ে একটি প্রাইভেটকারের জানালা থেকে ছোঁ মেরে মোবাইল নিয়ে চলে যায় তারা। মাজহারুল ইসলাম মহসিন নামে এক ব্যক্তি সেই দৃশ্য ভিডিও করে ছেড়েছেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। ১১ ডিসেম্বর মধ্যরাতে দারুসসালাম থানার মাজার রোডে শিমুলতলা আবাসিক এলাকার বাসায় ফিরছিলেন সংবাদকর্মী আসাদুজ্জামান। অফিসের গাড়ি থেকে নেমে গলির মধ্যে ঢুকতেই তিন যুবক ধারালো অস্ত্র দিয়ে আক্রমণ করে তাকে। তিনি ধস্তাধস্তি করে কোনোভাবে অস্ত্রধারীদের কাছ থেকে মুক্তি পান।
আসাদুজ্জামান জানান, সাধারণত ছিনতাইকারীরা আটকালে বা অস্ত্রের মুখে জিম্মি করলে টাকা ও মোবাইল চেয়ে থাকে। কিন্তু তার ওপর অতর্কিত আক্রমণ হয়েছে। আক্রমণকারীরা ছিনতাইকারী নাকি অন্য কোনো উদ্দেশে তার ওপর আক্রমণ করেছিল, তিনি বুঝে উঠতে পারেননি। পুরনো ঢাকার বলধা গার্ডেনের সামনে ১৩ ডিসেম্বর প্রকাশ্য দিবালোকে ছিনতাইয়ের শিকার হন ‘এখন টিভি’র সংবাদকর্মী জাহিদ হাসান। তিনি জানান, সকাল ১০টার দিকে তিনি নারিন্দার বাসা থেকে রিকশাযোগে অফিসের দিকে যাচ্ছিলেন। চাপাতি নিয়ে এক মোটরবাইকের তিন আরোহী ছোঁ মেরে তার মোবাইল ফোন নিয়ে যায়।
সংশ্লিষ্টরা জানান, রাজধানী ঢাকা এখন ছিনতাইকারীদের আখড়া হয়ে গেছে। অলিগলিতে ধারালো অস্ত্র হাতে ছিনতাইকারীরা ওত পেতে থাকে। কাউকে একা পেলেই আক্রমণ করে বসে। শুধু রাতে নয়, প্রকাশ্য দিবালোকেও ঘটছে ছিনতাইয়ের ঘটনা। ছিনতাইকারীরা দলবদ্ধভাবে অটোরিকশা নিয়ে নগরজুড়ে ঘুরে বেড়ায়। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) রেজাউল করিম মল্লিক বলেন, ‘ছিনতাইয়ের বিরুদ্ধে আমরা নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছি। রাজধানীর প্রতিটি এলাকায় আমাদের গোয়েন্দা কার্যক্রম চলমান এবং গ্রেপ্তার অভিযান চলছে।’ ডিএমপির উপ-কমিশনার (মিডিয়া) মোহাম্মদ তালেবুর রহমান বলেন, ‘যেসব ছিনতাইকারীকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে, তাদের জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে সহযোগীদের তথ্যও নেওয়া হচ্ছে। এছাড়া আগে থেকেই পেশাদার ছিনতাইকারী হিসেবে যাদের বিরুদ্ধে মামলা ছিল বা গ্রেপ্তারের পর জেলে ছিল, তাদের বিষয়েও খোঁজ-খবর নেওয়া হচ্ছে।’ ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। আন্দোলন দমানোর জন্য ৫ আগস্ট পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অতিরিক্ত বল প্রয়োগের কারণে নিহতের সংখ্যা বাড়তি ছিল। কিন্তু সেপ্টেম্বর থেকে খুনের ঘটনা কমে এলেও অন্যান্য বছরের তুলনায় তা বেড়েছে। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসে সারা দেশে খুনের শিকার হয়েছেন ৫৮৩ জন, অক্টোবর মাসে ৩৯৯ জন ও নভেম্বরে ৩৩৭ জন। ২০২৩ সালের এই তিন মাসে খুনের ঘটনা আরও কম ছিল। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে খুন হয়েছিলেন ২৩৮ জন, অক্টোবর মাসে ২৫৮ জন এবং নভেম্বর মাসে ২২৭ জন। এই একই সময়ে রাজধানী ঢাকায় চলতি বছরের নভেম্বরে খুনের মামলা হয়েছে ৫৫টি, অক্টোবরে ৫৭টি ও সেপ্টেম্বরে ১৪৮টি। ২০২৩ সালের এই সময়ে খুনের ঘটনায় মামলা ছিল যথাক্রমে নভেম্বরে ১৭টি, অক্টোবরে ১৯টি ও সেপ্টেম্বরে ১২টি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ করতে গিয়ে নাজুক অবস্থা তৈরি হয়েছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। দেশের চার শতাধিক থানায় হামলা হয়েছে তখন। এতে ৪৪ জন পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ডিমোরালাইজড হয়ে গেছে। সেই ধকল কাটিয়ে তাদের নতুন করে সাজানো হচ্ছে। আগে যারা অপারেশনাল দায়িত্বে ছিলেন, তাদের সরিয়ে নতুন মুখ আনা হয়েছে। এর প্রভাব পড়েছে। পুলিশের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা জানান, আগে যারা ঢাকার গোয়েন্দা বিভাগে বা ক্রাইম জোনে দায়িত্বরত ছিল - তারা ঢাকার অপরাধ জোন এবং ক্রাইম ট্রেন্ড সম্পর্কে জানতো। এজন্য অপরাধ নিয়ন্ত্রণে তাদের বেগ পেতে হতো কম। কিন্তু নতুন দায়িত্ব পাওয়া কর্মকর্তা বা সদস্যদের অপরাধের ধরন ও অপরাধীদের শনাক্ত করতে একটু সময় লাগছে। এছাড়া শুরুর দিকে পেট্রোলিং কম ছিল বলে অপরাধ বেড়েছিল। ক্রমান্বয়ে পেট্রোলিং বাড়ানো হচ্ছে। ঢাকার পুলিশ কমিশনার যেকোনও ঘটনায় সাহায্যপ্রার্থী হিসেবে কেউ থানায় গেলে যেন ফিরে না যান, সেই নির্দেশনা দিয়েছেন। একইসঙ্গে কোনো জিডি নথিভুক্ত হওয়ার এক ঘণ্টার মধ্যে রেসপন্স করার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। কিন্তু ছিনতাইয়ের ঘটনায় এখনও মামলা না নিয়ে জিডি নিতে আগ্রহী থানা পুলিশ। পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, থানা-পুলিশ সেই পুরনো অভ্যাসেই রয়েছে। যার থানায় মামলা বেশি তার জবাবদিহি বেশি করতে হয় বলে ছিনতাই বা চুরির ঘটনায় থানা পুলিশ মামলা নিতে চায় না। আগেও এমন ছিল। রাতারাতি তা পরিবর্তন হয়ে যাওয়ার কথা নয়। কিন্তু থানা-পুলিশের উচিত প্রতিটি ধর্তব্য অপরাধের ক্ষেত্রেই মামলা নথিভুক্ত করা।
ভোরের আকাশ/রন
মন্তব্য