স্বৈরাচারের দোসর ও দুর্নীতিবাজদের ‘বাংলাদেশ রিকন্ডিশন্ড ভেহিকেলস ইমপোর্টার্স অ্যান্ড ডিলারস অ্যাসোসিয়েশনের (বারভিডা)’ নেতৃত্বে বহাল রাখতে অপতৎপরতা থেমে নেই। আদালতের সঙ্গে প্রতারণা করে এটি করছেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কিছু অসাধু কর্মকর্তা এবং পতিত স্বৈরাচার সরকারের আর্শীবাদপুষ্ট আব্দুল হক গং। এই পাতানো নির্বাচন দ্রুত সময়ের মধ্যে বন্ধ না হলে ভুক্তভোগী ব্যবসায়ীরা আইনি লড়াই চালিয়ে যাবেন। পাশাপাশি আব্দুল হক গংদের বিরুদ্ধে প্রমাণিত অর্থ আত্মসাতের বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান ব্যবসায়ীবৃন্দ। গতকাল শুক্রবার বিকালে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেন ভুক্তভোগী রিটকারী ব্যবসায়ীদের পক্ষে তাদের আইনজীবী আমান উল্লাহ।
বারভিডার নির্বাচনের প্রস্তুতির প্রতিবাদে এই সংবাদ সম্মেলনে অ্যাডভোকেট আমান উল্লাহ বলেন, উচ্চ আদালতকে বিভ্রান্ত করেছে এই চক্র। ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য পর্দার আড়ালে থেকে আজ্ঞাবহ নির্বাচন কমিশন দিয়ে ২১ ডিসেম্বর বারভিডার পাতানো নির্বাচন সম্পন্ন করার অপচেষ্টায় লিপ্ত আছে তারা। এসব বিষয় উল্লেখ করে বারভিডায় প্রশাসক নিয়োগ, স্বাধীন নির্বাচনী বোর্ড ও নির্বাচন আপিল বোর্ড গঠন করে নির্বাচন সম্পন্ন করার দাবি জানান ভুক্তভোগী ব্যবসায়ীরা। সেই সঙ্গে বর্তমান আজ্ঞাবহ নির্বাচন বোর্ড বাতিল এবং নির্বাচনী তফসিল বাতিলের দাবি জানিয়ে গত ১ ডিসেম্বর একটি আবেদন করা হয়। বারভিডার কুচক্রী মহলের প্ররোচনায় আবেদনটি জরুরিভিত্তিতে বিবেচনায় না নিলে বারভিডার একজন সদস্য বাদী হয়ে মহামান্য সুপ্রিম কোর্টে রিট পিটিশন (নং- ১৫৫১৫/২০২৪) দায়ের করেন।
গত ৯ ডিসেম্বর তা বিবেচনায় নিয়ে জরুরিভিত্তিতে নিষ্পত্তি করার জন্য বাণিজ্য সংগঠনের মহা-পরিচালককে এক নির্দেশনামূলক আদেশ প্রদান করেন উচ্চ আদালত। আদেশটি গত ৯ ডিসেম্বর মন্ত্রণালয়ের আইনগত পদ্ধতিতে ই-মেইলের মাধ্যমে অবগত করা হয়। আদালতের এই আদেশকে অকার্যকর করার নিমিত্তে মন্ত্রণালয় আগামী ২৩ ডিসেম্বর বারভিডাকে শুনানির নোটিশ প্রদান করেন। যা তার আগে ২১ ডিসেম্বর বারভিডার পাতানো নির্বাচন সম্পন্নের চক্রান্ত বলে সংবাদ সম্মেলনে দাবি করেন ব্যবসায়ীদের আইনজীবী।
সংবাদ সম্মেলনে অ্যাডভোকেট আমান উল্লাহ বলেন, কুচক্রী মহল ও মন্ত্রণালয় পরস্পর যোগসাজশে যখন দেখতে পায় যে, মহামান্য উচ্চ আদালতের আদেশ অমান্য হচ্ছে তখনই এক নোটিশের মাধ্যমে গত ১৫ ডিসেম্বর কোনো প্রশাসক নিয়োগ না করে নির্বাচন স্থগিত করেন। আইনের ব্যতয় ঘটিয়ে গত ১৭ ডিসেম্বর বিকাল ৫টায় মন্ত্রণালয় এক নোটিশের মাধ্যমে অভিযোগকারীকে জানান ১৮ ডিসেম্বর সকালে শুনানি অনুষ্ঠিত হবে। রিটকারী সদস্যকে কোনো ধরনের প্রস্তুতির সময় না দিয়ে এই নোটিশ প্রদান করে ১৯২৭ সালের পাবলিক ডিমান্ড রিকোভারি অ্যাক্টে বিধৃত বিধানের পরিপন্থি কাজ করেছে মন্ত্রণালয়। উক্ত শুনানিতে চট্টগ্রামের অধিবাসী হিসেবে রিটকারী চট্টগ্রামে থাকায় ওই সময়ে শুনানিতে অংশগ্রহণ করতে পারেননি।
যদিও আদালত নির্দিষ্ট করে অভিযোগটি নিষ্পত্তি করার কথা বলেছেন তারপরও মন্ত্রণালয় তাড়াহুড়ো করে অভিযোগকারীর শুনানি গ্রহণ না করে তা গত ১৯ ডিসেম্বর সন্ধ্যা ৬টায় একতরফাভাবে নিষ্পত্তি করেন।
আমান উল্লাহ বলেন, তার আগে ১৯ ডিসেম্বর বেলা ১টা ৫৫ মিনিটে রিটাকারীর আইনজীবী হিসেবে আমি নিজে মন্ত্রণালয়ে উপস্থিত হয়ে রিটাকারীর পক্ষে লিখিত নোটিশ প্রদান করে জানাই যে, আব্দুল হক গংদের পক্ষের আইনজীবীগণ অন্যান্য রিটকারীদেরও রিট শুনানিতে আদালতকে অবহিত করেন যে, বর্তমানে বারভিডার নির্বাচন স্থগিত রয়েছে। তখন আদালত বিষয়টি আমলে নিয়ে বলেন, যেহেতু নির্বাচন স্থগিত রয়েছে তাই আদালতের শীতকালীন ছুটির আগে বারভিডার নির্বাচন বিষয়ে শুনানির প্রয়োজন নেই। প্রকান্তরে দেখা যায় যে, আদালতের সঙ্গে প্রতারণা করে আব্দুল হক গং মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় অভিযোগ নিষ্পত্তি না করে নির্বাচনের স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করে আইনের ব্যতয় ঘটিয়েছেন এবং আদালতকে বিভ্রান্ত করেছেন। যদি এই পাতানো নির্বাচন দ্রুত সময়ের মধ্যে বন্ধ না হয় তাহলে ভুক্তভোগী ব্যবসায়ীরা আইনি লড়াই চালিয়ে যাবেন। পাশাপাশি আব্দুল হক গংদের বিরুদ্ধে প্রমাণিত অর্থ আত্মসাতের বিষয়ে যদি মন্ত্রণালয় আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ না করে তাহলে মহামান্য উচ্চ আদালতে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন ব্যবসায়ীবৃন্দ।
রিটকারী ব্যবসায়ীদের আইনজীবী আমান উল্লাহ বলেন, বারভিডার নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল ২০২৪ সালের শুরুতে। কিন্তু তৎকালীন স্বৈরাচার সরকার তার দোসরদের সংগঠনের নেতৃত্বে রাখতে নানা অপতৎপরতা চালায়। নিয়ম বহির্ভূতভাবে সময় বৃদ্ধি করে স্বৈরাচার শেখ হাসিনার স্নেহভাজন আব্দুল হকের নেতৃত্বাধীন আজ্ঞাবহ কমিটি বহাল রাখা হয়। বাণিজ্য সংগঠনের আইন অনুসারে দৈব দুর্বিপাক বা সংগঠনের নিয়ন্ত্রণ বহির্ভূত অন্য কোনো কারণে যথা সময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানে ব্যর্থ হলে মহাপরিচালক স্বীয় কারণ উল্লেখ করে সময় বৃদ্ধি করতে পারবেন। অন্যথায় সরকারি প্রশাসক নিয়োগ বাধ্যতামূলক। কিন্তু বাস্তবে এ ধরনের কোনো দৈব দুর্বিপাক না ঘটলেও ওই কমিটিকে বহাল রাখতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কতিপয় দুষ্কৃতিকারী কর্মকর্তা পরস্পর যোগসাজশে স্বৈরাচারের আর্শীবাদপুষ্ট কমিটিকে বহাল রাখার অপচেষ্টা করেন। এই অপকর্মে ভূমিকা রাখেন মেয়াদ উত্তীর্ণ কমিটির সভাপতি হাবিব উল্লাহ ডন এবং ওই পরিষদের উপদেষ্টা আব্দুল হক।
এই আব্দুল হক স্বৈরাচার সরকারের আর্শীবাদপুষ্ট হওয়ায় শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে তার সঙ্গে বিভিন্ন দেশে সফর সঙ্গী হন। অল্প সময়ে চতুর আব্দুল হক শেখ হাসিনার আস্থাভাজনে পরিণত হন। ওই সময়ে আব্দুল হকের অনুরোধে শেখ হাসিনার নির্বাহী আদেশে আমদানি অযোগ্য সহস্রাধিক গাড়ি আমদানি করে ৯০ পার্সেন্ট অবচয়ের সুযোগ নিয়ে হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেন আব্দুল হক।
২০২১ সালে বারভিডার সভাপতি থাকাকালে আব্দুল হকের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাৎসহ নানা অভিযোগ উত্থাপিত হলে মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের নির্দেশে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। ২০২২ সালের ১০ জানুয়ারি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন উপ-সচিব ড. মো. আলম মোস্তফা একটি তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। সেই প্রতিবেদনে আব্দুল হক গংদের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদনের পৃষ্ঠা নম্বর ৮ এর ৬, ৭, ৮-এ অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়। তারপরও স্বৈরাচারের একনিষ্ঠ দোসর হওয়ায় আব্দুল হক গংদের বিরুদ্ধে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় রহস্যজনকভাবে আইনানুগ কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি।
এরকম অহরহ অপকর্মের হোতা আব্দুল হকের নেতৃত্বে সম্প্রতি স্বৈরাচারের দোসরদের নিয়ে একটি প্যানেল গঠন করে বারভিডার নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়েছে। এর সভাপতি প্রার্থী আব্দুল হক নিজেই। এই প্যানেলে তার সঙ্গে রয়েছেন জুলাই-আগস্টের গণহত্যায় অভিযুক্ত রিয়াজ রহমান। যার বিরুদ্ধে ছাত্র হত্যার অভিযোগে মামলা রয়েছে। যে মামলায় প্রধান আসামি স্বৈরাচার শেখ হাসিনা। পুলিশের কাছে তিনি পলাতক থাকলেও বাস্তবে চালাচ্ছেন নির্বাচনি প্রক্রিয়া। এছাড়াও এই প্যানেলের অন্যদের বিরুদ্ধেও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিরুদ্ধে অবস্থান, ছাত্র হত্যাসহ নানা অভিযোগ রয়েছে।
ভোরের আকাশ/রন
মন্তব্য