‘গুপ্তহত্যা’ আতঙ্ক

এম. সাইফুল ইসলাম
‘গুপ্তহত্যা’ আতঙ্ক

বিশেষ উদ্দেশ্যে পতিত আ.লীগ ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হতে পারে: সমন্বয়ক আব্দুল কাদের

দেশকে অস্থিতিশীল করতে এ ধরনের হত্যাকাণ্ড: ড. আসাদুজ্জামান রিপন

রাজনৈতিক দলগুলোতে বোঝাপড়া ও সরকারের কঠোরতা জরুরি: ড. দিলারা চৌধুরী

হঠাৎ নিখোঁজ। এরপর মিলছে লাশ। আবার অনেকে বাসা থেকে বের হয়ে গন্তব্যে পৌঁছানোর আগেই খুন হচ্ছেন। ওইসব খুনের সঙ্গে কে বা কারা জড়িত, তাও শনাক্ত হচ্ছে না। হত্যাকাণ্ডের শিকার পরিবারগুলো বলছে, এগুলো ‘গুপ্তহত্যা’। দেশে এমন ‘গুপ্তহত্যা’র ঘটনা এখন হরহামেশাই ঘটছে। গত কয়েক দিন ঢাকা, সিলেট, গাজীপুর, সেন্টমার্টিন, নেত্রকোনা, পাবনাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সংঘটিত এমন কয়েকটি ঘটনায় ফের জনমনে বেড়েছে আতঙ্ক। জুলাই-আগস্ট ছাত্র-জনতার গণবিপ্লবে অংশগ্রহণকারীরা এসব হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়ায় জনমনে প্রশ্ন উঠেছে।

বিষয়টি নিয়ে রাজনীতিবিদ ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা বলছেন, একটি পক্ষ দেশকে অস্থিতিশীল করতেই এ ধরনের হত্যাকাণ্ড ঘটাচ্ছে। তাদের দাবি, এসব হত্যাকাণ্ডের পেছনে পতিত আওয়ামী লীগ জড়িত থাকতে পারে। ফ্যাসিস্ট ও তাদের দোসররা নানাভাবে পাল্টা আঘাত হানার অপচেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে দেশকে অস্থিতিশীল করতেই এ ধরনের হত্যাকাণ্ড ঘটাতে পারে বলে শঙ্কা রয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, অপরাধপ্রবণতা রোধে রাজনৈতিক দলগুলোর বোঝাপড়া এবং সরকারের কঠোর মনোভাব বাস্তবায়ন জরুরি। এ ধরনের অপরাধে যারা জড়িত, তাদের চিহ্নিত করা সরকারের দায়িত্ব।

তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, সম্প্রতি দেশে হঠাৎ করেই গুপ্তহত্যার সংখ্যা বেড়ে গেছে। গত দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে প্রতিদিন পত্রিকার পাতায় কোনো না কোনো স্থানে গুপ্তহত্যার খবর পাওয়া যাচ্ছে। হত্যাকাণ্ডের শিকার পরিবারগুলোর দাবি—কারা তাদের স্বজনদের হত্যা করেছে বা কেন হত্যা করা হয়েছে, সে ব্যাপারে তারা অন্ধকারে।

সম্প্রতি ঢাকায় দুই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। যারা সরাসরি পতিত ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে জুলাই-আগস্ট বিপ্লবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তাদের একজন ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তাজবির হোসেন শিহান। গত ১২ ডিসেম্বর ভোরে গাজীপুরের কালিয়াকৈরে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের হানিফ স্পিনিং মিলের সামনে তাকে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। হত্যাকাণ্ডের শিকার অপরজন আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ (এআইইউবি)-এর কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসই) বিভাগের ছাত্র মো. ওয়াজেদ সীমান্ত। একই দিন নারায়ণগঞ্জে ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আহত হন। এর দুই দিন পর, ১৪ ডিসেম্বর, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সীমান্তের মৃত্যু হয়।

এই দুই শিক্ষার্থী ‘গুপ্তহত্যা’র শিকার হয়েছেন বলে দাবি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন নেতৃবৃন্দের। ওই হত্যাকাণ্ডের পর বিচারের দাবিতে আন্দোলনে নামেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত শিক্ষার্থীদের একাংশ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনে থেকে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীবৃন্দ’ ব্যানারে একটি মিছিল করেন শিক্ষার্থীরা। তাদের ব্যানারে লেখা ছিল ‘জুলাই অভ্যুত্থান ও ভারতীয় আগ্রাসনবিরোধী আন্দোলনের তিন সহযোদ্ধার গুপ্তহত্যার প্রতিবাদ’।

গত ১৯ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার দুপুরে কক্সবাজারের টেকনাফের সেন্টমার্টিন দ্বীপ থেকে হাত-পা বাঁধা অজ্ঞাত এক যুবকের অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। সেন্টমার্টিন দ্বীপের উত্তর সৈকত সংলগ্ন সাগর থেকে লাশটি উদ্ধার করা হয়। নিহত যুবকের বয়স আনুমানিক ৩০ বছর। তবে তার পরিচয় জানা যায়নি। ওই ছবিটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক ভাইরাল হয়েছে।

গত ১৬ ডিসেম্বর কাপাসিয়া উপজেলার ধাঁধার চর থেকে দুই দিন আগে নিখোঁজ হওয়া নাঈমুল ইসলাম শাওন নামের এক যুবকের লাশ উদ্ধার করা হয়। তিনি নরসিংদীর শিবপুর উপজেলার লাখপুর গ্রামের প্রবাসী দিদারুল ইসলামের একমাত্র ছেলে। পরিবার বলছে, তার কারও সঙ্গে শত্রুতা ছিল না।

গত ১৪ ডিসেম্বর সিলেটের কোম্পানীগঞ্জে নিখোঁজের এক দিন পর ধানের জমি থেকে আতাউর রহমান আতাই (৩৫) নামের এক যুবকের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। তিনি কোম্পানীগঞ্জের ইছাকলস ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের পশ্চিম পুটামারা গ্রামের মৃত বশির মিয়ার ছেলে। স্থানীয়রা জানান, শুক্রবার সন্ধ্যায় বাড়ি থেকে পুটামারা বাজারে যান আতাই। এরপর আর বাড়ি ফেরেননি। কোম্পানীগঞ্জ থানার ওসি উজায়ের আল মাহমুদ আদনান বলেন, ধারণা করা হচ্ছে ‘হত্যাকাণ্ডটি পরিকল্পিত’। নিহতের মাথায় ধারালো অস্ত্রের আঘাত রয়েছে। লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল কলেজে পাঠানো হয়েছে। তবে তাকে কী কারণে হত্যা করা হয়েছে তা তদন্ত করছে পুলিশ।

নেত্রকোনার কলমাকান্দার পাঁচগাঁও গ্রামের নিখোঁজ হওয়ার চার দিন পর শ্যামল হাজংয়ের লাশ পাওয়া গেছে। তিনি গাজীপুরের মাওনায় শ্রমিক হিসেবে একটি কারখানায় কাজ করতেন। জানা গেছে, গত ১৬ ডিসেম্বর ছুটি শেষে নিজ কর্মস্থলে ফিরে যেতে সন্ধ্যায় কলমাকান্দা থেকে একটি বাসে উঠেন। এরপর পরিবার তাকে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করতে চাইলে তার ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। ২০ ডিসেম্বর ময়মনসিংহের দিঘারকান্দার একটি ফিলিং স্টেশন থেকে তার লাশ উদ্ধার করা হয়। শ্যামল হাজংয়ের কারও সঙ্গে কোনো বিরোধ বা দ্বন্দ্ব নেই বলেও দাবি তার পরিবারের।

১৩ ডিসেম্বর টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলায় নিখোঁজের পাঁচ দিন পর বিল থেকে এক ব্যক্তির অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। নিহত ৪৪ বছর বয়সী লিটন উপজেলার পাইকড়া ইউনিয়নের বানকিনা গ্রামের প্রয়াত আতশের ছেলে। উপজেলার পাইকড়া ইউনিয়নের কালোহা বিল থেকে লাশটি উদ্ধার করা হয় বলে জানান কালিহাতী থানার ওসি মোহাম্মদ আবুল কালাম ভূঁইয়া।

১৭ ডিসেম্বর নেত্রকোনার দুর্গাপুরে নিখোঁজের দুই দিন পর পুকুর থেকে আলী ওসমান (৫২) নামের এক ব্যক্তির মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। উপজেলার বাকলজোড়া ইউনিয়নের পূর্ব বাকলজোড়া গ্রামের একটি পুকুর থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়। নিহত ব্যক্তি একই উপজেলার চণ্ডিগড় ইউনিয়নের ধানশিরা গ্রামের মৃত মনফর আলীর ছেলে।

স্থানীয় ও পুলিশ সূত্রে জানা যায়, গত ১৫ ডিসেম্বর পূর্ব বাকলজোড়া গ্রামের আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে যান আলী ওসমান। এরপর সেখান থেকে তিনি এশার নামাজের অজু করার জন্য বের হয়ে আর বাসায় ফেরেননি। পরিবারের সদস্যরা সম্ভাব্য সব জায়গায় খোঁজাখুঁজি করেও তার কোনো সন্ধান পায়নি। পরে পূর্ব বাকলজোড়া গ্রামের একটি পুকুরে ভাসমান অবস্থায় আলী ওসমানের মরদেহ দেখতে পান স্থানীয়রা। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে মরদেহ উদ্ধার করে।

বিষয়টি নিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক ও জুলাই বিপ্লবের অন্যতম নেতা আবদুল কাদের দৈনিক ভোরের আকাশকে বলেন, যে বিপ্লবীদের কাঁধে ভর দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল, সেই বাংলাদেশে বিপ্লবীদের লাশ রাস্তায় পড়ে থাকে। বিপ্লবীদের রক্ত মাড়িয়ে ক্ষমতায় যাওয়া অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এ ক্ষেত্রে নির্বিকার, নির্লিপ্ত ভূমিকা পালন করছে। এটা অশনিসংকেত। তিনি বলেন, এসব ঘটনার সঙ্গে পতিত আওয়ামী লীগ জড়িত থাকতে পারে। কারণ, ফ্যাসিস্ট এ দলটি নানাভাবে ফিরে আসার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হচ্ছে। তাই এখন দেশকে অস্থিতিশীল করে সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে দলটি এ ধরনের হত্যাকাণ্ড ঘটাতে পারে। সরকারের এ বিষয়ে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।

বিএনপির ভাইস-চেয়ারম্যান ড. আসাদুজ্জামান রিপন দৈনিক ভোরের আকাশকে বলছেন, দেশকে অস্থিতিশীল করতে এ ধরনের হত্যাকাণ্ড ঘটানো হচ্ছে। যারা এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িত, তাদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি দেওয়া সরকারের দায়িত্ব। অপরাধ করে পার পেয়ে গেলে এ প্রবণতা বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

বিষয়টি নিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. দিলারা চৌধুরী দৈনিক ভোরের আকাশকে বলেছেন, দেশে এখন বিশেষ পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এ অবস্থায় দেশকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারলে কার লাভ সেটি এখন সবাই জানেন। তাই দেশে স্থিতিশীলতা ফিরে আনতে হবে। কেউ যেন ফায়দা নিতে না পারে সে জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বোঝাপড়া এবং সরকারের কঠোরতা বাস্তবায়ন জরুরি বলেও মনে করেন তিনি।

 

ভোরের আকাশ/রন

মন্তব্য