- সামিট ও এস আলমের বিদ্যুৎ কেনে বিপিডিবি
- দেশের ১৪৩টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের ৫০টি বিপিডিবির
- জ্বালানি সংকট, কারিগরি জটিলতায় উৎপাদন কম
- ভুল পরিকল্পনায় কমছে না বেসরকারি নির্ভরতা
২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) বেসরকারি খাত থেকে ৭৯ হাজার ৩৯০ কোটি টাকার বিদ্যুৎ কিনেছে। এর মধ্যে ভারতীয় ১০টি প্রতিষ্ঠান নিয়েছে ৪৭ হাজার ১৯৭ কোটি টাকা। শুধু আদানির প্রতিষ্ঠানকে ১২ হাজার ১৪৬ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। এদিকে দেশে ১৪৩টি বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে। এগুলোর মধ্যে বিপিডির অধীনে রয়েছে ৫০টি। তবে জ¦ালানি সংকট, কারিগরি জটিলতায় উৎপাদন কমে গেছে। প্রতিষ্ঠানটির কিছু ভুল পরিকল্পনার কারণে বেসরকারি খাতে তার নির্ভরতা কমছে না।
প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, আদানি পাওয়ার গত অর্থবছরে বিপিডিবির কাছে বিদ্যুৎ বিক্রি করে ৮১৬ কোটি ৬৬ লাখ ৭৭ হাজার কিলোওয়াট। বিপরীতে অর্থ নিয়েছে ১২ হাজার ১৪৬ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। বিদ্যুৎ বিক্রি করে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অর্থ নিয়েছে বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (বিসিপিসিএল)। পটুয়াখালীর পায়রায় অবস্থিত এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি গত অর্থবছর বিপিডিবির কাছে মোট ৭৫৪ কোটি ৮৭ লাখ ৩৬ হাজার কিলোওয়াট বিদ্যুৎ বিক্রি করে। বিনিময়ে প্রতিষ্ঠানটি আট হাজার ৯৩১ কোটি ৭৩ লাখ টাকা পেয়েছে। টাকার অঙ্কে বিদ্যুৎ বিক্রির তালিকায় তৃতীয় স্থানে রয়েছে দেশের বিদ্যুৎ খাতের শীর্ষ প্রতিষ্ঠান সামিট গ্রুপ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সামিটের মালিকানায় থাকা অন্তত আটটি বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে পাঁচ হাজার ৬৪১ কোটি টাকার বিদ্যুৎ কিনেছে বিপিডিবি। তবে, বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ডের কাছে প্রতিষ্ঠানটির বিদ্যুৎ বিক্রির অর্থের হিসাব করলে তা ছয় হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।
সামিটের আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে তারা বিপিডিবির কাছে পাঁচ হাজার ৫১৭ কোটি ৮৫ লাখ টাকার বিদ্যুৎ বিক্রি করে। এর মধ্যে সামিট পূর্বাচল পাওয়ার লিমিটেডের কাছ থেকে বিপিডিবি ১৪৪ কোটি ৫৮ লাখ; সামিট বিবিয়ানা-২ বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে এক হাজার ২৬১ কোটি ৮৬ লাখ; বরিশালে অবস্থিত সামিটের বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ৪৬৬ কোটি ৪৯ লাখ; সামিট নারায়ণগঞ্জ-২ (৬২ মেগাওয়াট) কেন্দ্র থেকে ৩৬০ কোটি ৯৭ লাখ; গাজীপুরের কড্ডা বিদ্যুৎকেন্দ্র (৩০০ মেগাওয়াট) এক হাজার ৫২৩ কোটি ৯৯ লাখ; সামিট মেঘনাঘাট-২ বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ৪৩০ কোটি ৭৪ লাখ টাকার বিদ্যুৎ কেনে। এ ছাড়া নারায়ণগঞ্জে সামিট মেঘনাঘাট পাওয়ার লিমিটেডের আরেকটি বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে এক হাজার ৫২ কোটি ৩৯ লাখ এবং একই জেলায় অবস্থিত ভাড়াভিত্তিক একটি কেন্দ্র থেকে ৪০০ কোটি টাকার বিদ্যুৎ কেনে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাটি।
দেশের বেসরকারি খাতে সবচেয়ে বড় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র এসএস পাওয়ার আই লিমিটেড। চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে অবস্থিত এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট সক্ষমতার কেন্দ্রটি পরিচালনা করছে এস আলম গ্রুপ। এটি গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে উৎপাদনে যায়। চীনের অর্থায়নে নির্মিত এ কেন্দ্র থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রতি ইউনিট ২০ টাকা দরে ২৪০ কোটি ২৯ লাখ ৪৬ হাজার কিলোওয়াট বিদ্যুৎ কেনে বিপিডিবি। বিনিময়ে এসএস পাওয়ার পেয়েছে চার হাজার ৯০৮ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। যদিও বিদ্যুৎকেন্দ্র ও বিপিডিবি-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ কেন্দ্রের প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় গত বছর ছিল গড়ে ১৫ টাকার কিছু বেশি। বর্তমানে বিপিডিবির কাছে এসএস পাওয়ারের দুই হাজার ৬০০ কোটি টাকার বেশি পাওনা।
বেসরকারি ইউনাইটেড গ্রুপ আইপিপিভিত্তিক ছয়টি বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে গত অর্থবছরে বিপিডিবির কাছে ১৮৪ কোটি ৩১ লাখ ৭৮ হাজার কিলোওয়াট বিদ্যুৎ বিক্রি করে। বিনিময়ে তাদের পরিশোধ করতে হয়েছে চার হাজার ৭৯৮ কোটি ২৫ লাখ টাকা। এর মধ্যে আশুগঞ্জ থেকে বিদ্যুৎ কেনাবাবদ ব্যয় হয়েছে ৪৬৮ কোটি ৮ লাখ টাকা এবং ইউনাইটেড পাওয়ার জেনারেশনের অন্য একটি কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কিনে বিপিডিবিকে দিতে হয়েছে ৬০ কোটি ৭৩ লাখ টাকা।
এ ছাড়া ইউনাইটেড পাওয়ারের ময়মনসিংহের কেন্দ্র থেকে সরকারি সংস্থাটির বিদ্যুৎ কেনাবাবদ ব্যয় হয়েছে এক হাজার ৫৬১ কোটি টাকা। চট্টগ্রামের আনোয়ারা কেন্দ্রের বিদ্যুৎ কিনে বিল দিতে হয়েছে এক হাজার ৩৮৮ কোটি ৬৪ লাখ টাকা, পায়রা থেকে কেনা হয়েছে ৪৮০ কোটি ৭৮ লাখ টাকার বিদ্যুৎ। আর ইউনাইটেড জামালপুর ১১৫ মেগাওয়াট থেকে ৮২৮ কোটি ৭১ লাখ টাকার বিদ্যুৎ কেনা হয়েছে। এ ছাড়া গ্রুপটির আওতায় থাকা অন্যান্য কেন্দ্র থেকেও বিপুল অর্থের বিদ্যুৎ কিনেছে বিপিডিপি।
বাগেরহাটের রামপালে অবস্থিত দেশের কয়লাভিত্তিক আরেক বৃহৎ তাপ-বিদ্যুৎকেন্দ্র মৈত্রী সুপার থার্মাল পাওয়ার প্লান্ট। এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট সক্ষমতার কেন্দ্রটি পরিচালনা করছে বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (বিআইএফপিসিএল)। এ কেন্দ্র থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বিপিডিবি বিদ্যুৎ কিনেছে ২৮১ কোটি ১৫ লাখ ৫৪ হাজার কিলোওয়াট। সমপরিমাণ বিদ্যুৎ কিনতে বিপিডিবিকে পরিশোধ করতে হয়েছে চার হাজার ২৯৮ কোটি ২৭ লাখ টাকা।
বিদ্যুৎ খাতে দীর্ঘসময় ধরে বিনিয়োগ রয়েছে বেসরকারি খাতের কোম্পানি ওরিয়ন গ্রুপের। প্রতিষ্ঠানটির পাঁচটি কেন্দ্র থেকে বিপিডিবির বিদ্যুৎ কিনতে ব্যয় হয়েছে দুই হাজার ৮২ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। এর মধ্যে ওরিয়নের রূপসা কেন্দ্র থেকে ৪৮৩ কোটি ৫৯ লাখ টাকা, সোনারগাঁও কেন্দ্র থেকে ৫৭৮ কোটি ১৩ লাখ টাকা, মেঘনাঘাট থেকে ২৫১ কোটি টাকা, ডাচ্ বাংলা পাওয়ার অ্যাসোসিয়েটস কেন্দ্র থেকে ২৪১ কোটি টাকা এবং ডিজিটাল পাওয়ার অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস থেকে ৫২৮ কোটি ৫৩ লাখ টাকার বিদ্যুৎ কেনা হয়েছে।
আইপিপি হিসেবে বিপিডিবির কাছে বিদ্যুৎ বিক্রি করছে এ খাতের আরেক প্রতিষ্ঠান কনফিডেন্স গ্রুপ। প্রতিষ্ঠানটির তিনটি কেন্দ্র থেকে গত অর্থবছরে ৬৬ কোটি ৯৫ লাখ ৭৮ হাজার কিলোওয়াট বিদ্যুৎ বিক্রি করেছে। এ পরিমাণ বিদ্যুৎ কিনতে বিপিডিবিকে দিতে হয়েছে এক হাজার ৮৩৪ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। কনফিডেন্সের ফার্নেস অয়েলভিত্তিক এ তিন বিদ্যুৎকেন্দ্রের সক্ষমতা ৩৩৯ মেগাওয়াট।
ভোলায় অবস্থিত আরেকটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র বরিশাল ইলেকট্রিক পাওয়ার। কয়লাভিত্তিক এ কেন্দ্রের মোট সক্ষমতা ৩০৭ মেগাওয়াট। সেখান থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বিপিডিবি বিদ্যুৎ কিনেছে এক হাজার ৫৬১ কোটি ২৯ লাখ টাকার।
দেশের আরেকটি বিদ্যুৎ খাতের প্রতিষ্ঠান দেশ এনার্জি লিমিটেড। বিপিডিবির কাছে প্রতিষ্ঠানটির তিনটি বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়েছে। এর মধ্যে দুটি আইপিপি ও একটি রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে তিনটি কেন্দ্রের কাছ থেকে বিপিডিবি মোট এক হাজার সাত কোটি টাকার বিদ্যুৎ কিনেছে। এর মধ্যে চাঁদপুরের কেন্দ্রটির কাছ থেকে ৯২১ কোটি ৬৬ লাখ টাকা, নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার বিদ্যুৎকেন্দ্রটির কাছ থেকে ৪৬ কোটি ৬২ লাখ টাকা এবং রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র কুমারগাঁও থেকে ৩৮ কোটি ২১ লাখ টাকার বিদ্যুৎ কিনেছে বিপিডিবি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের ১৪৩টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের ৫০টিই বিপিডিবির অধীন। কিন্তু অধিকাংশ কেন্দ্র জ্বালানি সংকট, কারিগরি জটিলতাসহ নানা কারণে সক্ষমতার চাইতে কম বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। ফলে বাধ্য হয়ে চাহিদা পূরণে পিডিবিকে নির্ভর করতে হচ্ছে বেসরকারি ও আমদানিকৃত বিদ্যুতের ওপর। এতে কেন্দ্রগুলোর কাছে বিপুল পরিমাণ ঋণে পড়ছে প্রতিষ্ঠানটি।
তারা বলছেন, পিডিবির নিজস্ব পলিসি ও ভুল পরিকল্পনার কারণে চাইলেও কাটাতে পারছে না বেসরকারি বিদ্যুৎ নির্ভরতা। ফলে বছরের পর বছর বেড়ে চলেছে খরচ ও ভর্তুকির পরিমাণ। সরকারি বিদ্যুৎ খাতে যথাযথভাবে বিনিয়োগ ও সঠিক পরিকল্পনা তৈরি করা হলে আর্থিক এ চাপ অনেকটা কমে আসবে।
ভোরের আকাশ/রন
মন্তব্য