সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ

হাসিনা-জয়ের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু দুদকের

এম বদি-উজ-জামান
হাসিনা-জয়ের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু দুদকের

ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতা ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের বিরুদ্ধে আরও একটি বিশাল দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধানে মাঠে নামছে দুদক। এবার যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে ৩০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার (৩ হাজার ৫৭০ কোটি টাকা) পাচারের অভিযোগে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গতকাল রোববার (২২ ডিসেম্বর) এই সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে জানা গেছে। দুদকের উপ-পরিচালক মো. সালাহউদ্দিনের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের টিমকে এই অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।

দুদকের জনসংযোগ কর্মকর্তা উপ-পরিচালক আখতারুল ইসলাম গতকাল রোববার ভোরের আকাশকে এ তথ্য নিশ্চিত করে বলেছেন, ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী ও তার ছেলের বিরুদ্ধে বিদেশে টাকা পাচারের বিষয়টি অনুসন্ধান শুরু হয়েছে।

জানা গেছে, দিনাজপুরে স্থাপিত রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ৫শ কোটি ডলারের বেশি বা ৫৯ হাজার কোটি টাকাসহ বিভিন্ন প্রকল্পে ৮০ হাজার কোটি টাকা দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য গত ১৭ ডিসেম্বর সিদ্ধান্ত নেয় দুদক। যেখানে শেখ হাসিনা, তার বোন শেখ রেহানা, তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় ও শেখ রেহানার মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিকসহ তাদের পরিবারের সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। অভিযোগে রূপপুর ছাড়াও আশ্রয়ণসহ ৮টি প্রকল্পে দুর্নীতির তথ্য আমলে নেওয়া হয়েছে। অন্যান্য প্রকল্পগুলোতে ২১ হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। এই অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য এরপর ১৮ ডিসেম্বর দুদকের উপ-পরিচালক মো. সালাহউদ্দিনের নেতৃত্ব পাঁচ সদস্যের টিম গঠন করা হয়। টিমের অন্য সদস্যরা হলেন, উপ-পরিচালক মো. সাইদুজ্জামান, সহকারী পরিচালক আফনান জান্নাত কেয়া, সহকারী পরিচালক এসএম রাশেদুল হাসান ও সহকারী পরিচালক একেএম মর্তুজা আলী সাগর। এই টিমকেই ৩শ মিলিয়ন ডলার পাচারের অভিযোগ অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। টিমের অপর সদস্যরা হলেন-উপ-পরিচালক মো. সাইদুজ্জামান, সহকারী পরিচালক আফনান জান্নাত কেয়া, সহকারী পরিচালক এসএম রাশেদুল হাসান ও সহকারী পরিচালক একেএম মর্তুজা আলী সাগর।

ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ৫০০ কোটি ডলার আত্মসাৎ করেছেন বলে আগস্ট মাসের মাঝামাঝিতে তথ্য প্রকাশ করে গ্লোবাল ডিফেন্স কর্প নামের একটি ওয়েবসাইট। ওয়েবসাইটের প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশাল অংকের এই অর্থ আত্মসাতের কাজে শেখ হাসিনাকে সহায়তা করেছেন ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় ও টিউলিপ সিদ্দিক। শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্যরা রাশিয়ান কোম্পানি রোসাটমের কাছ থেকে একটি পারমাণবিক চুল্লি কেনার নামে এই বিশাল অর্থ লেনদেন করেন। তবে গত ২৫ আগস্ট রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্যদের পাঁচ বিলিয়ন বা ৫০০ কোটি মার্কিন ডলার ঘুষ দেওয়ার খবরকে ‘গুজব’ ও ‘মিথ্যা’ বলেছেন বাংলাদেশে নিযুক্ত রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত আলেকজান্ডার মান্টিটস্কি। টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি ২০১৩ সালে বাংলাদেশে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে রাশিয়ার সাথে একটি চুক্তিতে মধ্যস্থতা করেছিলেন, যেখানে প্রকল্পের ব্যয় বাড়িয়ে ধরা হয়েছিল।

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ৫০০ কোটি ডলার আত্মসাৎ করার খবর গণমাধ্যমে প্রকাশের পর গত ৩ সেপ্টেম্বর হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারার ব্যারিস্টার ববি হাজ্জাজ। ওই রিট আবেদনের ওপর প্রাথমিক শুনানি নিয়ে গত ১৫ ডিসেম্বর বিচারপতি ফাহমিদা কাদের ও বিচারপতি মুবিনা আসাফের হাইকোর্ট বেঞ্চ রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পে শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্যদের পাঁচ বিলিয়ন বা ৫০০ কোটি ডলারের দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান প্রশ্নে রুল জারি করেন। রুলে ওই অভিযোগ অনুসন্ধানে দুদকের নিষ্ক্রিয়তা কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না তা জানতে চাওয়া হয়েছে। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সচিব, স্বরাষ্ট্র সচিব, দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের চেয়ারম্যান, নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্ট কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক, শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা, শেখ হাসিনার ছেলে সজিব ওয়াজেদ জয়, শেখ রেহানার মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিকী ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিরাপত্তা উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিকসহ ১৪ জনকে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট পতন হয় আওয়ামী লীগ সরকারের। সেদিন ভারতে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় আগে থেকেই যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছেন। আর টিউলিপ সিদ্দিকী যুক্তরাজ্যের লেবার মন্ত্রিসভার সদস্য, তিনি ইকনোমিক সেক্রেটারি টু দি ট্রেজারি অ্যান্ড সিটি মিনিস্টার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তার কাজ যুক্তরাজ্যের অর্থবাজারের ভেতরের দুর্নীতি সামাল দেওয়া।

এর আগে ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্তু শেখ হাসিনা যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তখনও তার বিরুদ্ধে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল। তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলাও হয়েছিল। রাশিয়া থেকে ৮টি যুদ্ধবিমান মিগ-২৯ কেনায় তখনকার সময়ে ৭শ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ২০০৩ সালে মামলা করেছিল দুর্নীতি দমন ব্যুরো (বর্তমানে বিলুপ্ত)। তেল-গ্যাস উত্তোলনে কানাডিয়ান কোম্পানি নাইকো রিসোর্সকে অবৈধভাবে কাজ দিয়ে রাষ্ট্রের প্রায় ১৩ হাজার ৭০০ কোটি টাকা ক্ষতি সাধনের অভিযোগে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ২০০৭ সালের ৯ ডিসেম্বর একটি মামলা দায়ের করেছিল দুদক।

এছাড়া দুর্নীতি ও অনিয়মের মাধ্যমে নৌবাহিনীর জন্য পুরাতন যুদ্ধজাহাজ ফ্রিগেট কেনায় সর্বনিম্ন দরদাতা চীনা কোম্পানির পরিবর্তে চতুর্থ সর্বনিম্ন দরদাতা দক্ষিণ কোরিয়ান কোম্পানিকে কাজ দিয়ে রাষ্ট্রের ৪৪৭ কোটি টাকা ক্ষতি করার অভিযোগে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মামলা করে বিলুপ্ত দুর্নীতি দমন ব্যুরো (বর্তমানে দুদক)। মেঘনা ঘাট বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে অনিয়ম এবং দুর্নীতির কারণে রাষ্ট্রের ১৭ কোটি ৮৪ লাখ টাকা ক্ষতি করার অভিযোগে শেখ হাসিনাসহ সংশ্লিষ্টদেও বিরুদ্ধে আরও একটি দুর্নীতির মামলা করে হয় ২০০১ সালের ১১ ডিসেম্বর। এছাড়া বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্টের নামে তিন কোটি টাকা চাঁদা নিয়ে খুলনায় ভাসমান বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে সর্বনিম্ন দরদাতাকে বাদ দিয়ে দ্বিতীয় দরদাতাকে কাজ দেয়ার অভিযোগে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা হয়। মওলানা ভাসানীর নাম পরিবর্তন করে বঙ্গবন্ধু নভোথিয়েটার নির্মাণে প্রকল্পে ঠিকাদার নিয়োগে দুর্নীতি, অবৈধভাবে ব্যয় বৃদ্ধি করে রাষ্ট্রের ৫২ কোটি টাকা ক্ষতি সাধন করার অভিযোগে মামলা হয়। বেপজায় পরামর্শক নিয়োগে রাষ্ট্রের দুই কোটি ১০ লাখ ১ হাজার ৬৮৮ টাকা ক্ষতি সাধনের অভিযোগে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মামলা হয়। টুঙ্গিপাড়ায় সৃতিসৌধ নির্মাণে ৪২ কোটি টাকার দুর্নীতির আরও একটি মামলা করা হয়েছিল শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে।

কিন্তু ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে পুনরায় ক্ষমতাসীন হন শেখ হাসিনা। তিনি এ দফায় ক্ষমতাসীন হয়ে দলীয় নেতাদের হাইকোর্টে বিচারপতি নিয়োগ দেন। দলীয় এসব বিচারপতির আদালত থেকে ২০১০ সাল থেকে ২০১১ সালের মধ্যে একে একে সব দুর্নীতি মামলায় খালাস দেওয়া হয় শেখ হাসিনাকে। কিন্তু ওইসময় থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্তু টানা ১৫ বছর শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকায় দুদক কোনো মামলাই আপিল করেনি। তবে শেখ হাসিনা পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়ার পর তার সময়ে নিয়োগ পাওয়া দুদক চেয়ারম্যান ও কমিশনার পদত্যাগ করেন। এ অবস্থায় নতুন দুদক চেয়ারম্যান ও কমিশনার নিয়োগ দেওয়া হয়। নতুন কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে হাজার হাজার কোটি টাকা দুর্নীতি ও পাচারের অভিযোগ অনুসন্ধানে নেমেছে।

 

ভোরের আকাশ/রন

মন্তব্য