ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতা ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে দেশে ফেরাতে ভারত সরকারকে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। শেখ হাসিনাকে ফেরাতে ভারতের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য বিভিন্ন মহল থেকে, বিশেষ করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের পক্ষ থেকে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে অব্যাহত দাবির মুখে ভারতকে এই চিঠি দেওয়া হয়েছে। দুই দেশের মধ্যে বন্দিবিনিময় চুক্তির আওতায় শেখ হাসিনাকে ফেরত চাওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে পাঠানো চিঠি পাওয়ার কথা স্বীকার করেছে ভারত। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্রের বরাত দিয়ে দেশটির বেসরকারি টেলিভিশন এনডিটিভি এ তথ্য জানিয়েছে। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বলেছেন, ‘আমরা নিশ্চিত করছি যে একটি প্রত্যর্পণের অনুরোধের বিষয়ে আজ বাংলাদেশ হাইকমিশন থেকে একটি নোট ভারবেল পেয়েছি।’
ভারত সরকারকে চিঠি দেওয়ার কথা গতকাল সোমবার দুপুরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের কাছে প্রকাশ করেছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন। তৌহিদ হোসেন বলেন, ভারতকে আমরা স্পষ্টভাবে জানিয়েছি বিচারিক প্রক্রিয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে (শেখ হাসিনা) ফেরত চায়। তিনি বলেন, ভারত সরকারকে নোট ভারবালের (কূটনৈতিক পত্র) মাধ্যমে এটা জানানো হয়েছে।
এর আগে গতকাল সকালে বিজিবি দিবসে পদক প্রদান ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী জানান, ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফেরত আনার বিষয়ে ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেওয়া হয়েছে। বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। তিনি বলেন, আমাদের সঙ্গে ভারতের বন্দিবিনিময় চুক্তি আছে। ওই চুক্তি মেনে শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে আনতে কোনো বাধা নেই। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার এই তথ্যের পরই পররাষ্ট্র উপদেষ্টার কাছে বিষয়টি জানতে চান গণমাধ্যম কর্মীরা।
সংশ্লিষ্ট পর্যবেক্ষকদের মতে, বন্দিবিনিময় চুক্তির শর্তানুযায়ী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অপরাধ ‘রাজনৈতিক প্রকৃতির’ বিবেচনায় শেখ হাসিনাকে ফেরত পাঠানোর অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করার অজুহাত দেখাতে পারে ভারত। তবে ওই চুক্তি অনুযায়ী হত্যা, নরহত্যা বা অপরাধমূলক হত্যা, আক্রমণ, বিস্ফোরণের কারণ, জীবন বিপন্ন করার উদ্দেশ্যে বিস্ফোরক পদার্থ বা অস্ত্র তৈরি বা নিজের কাছে রাখাসহ বেশ কিছু অপরাধকে রাজনৈতিক বলার সুযোগ নেই। একারণেই ওই চুক্তির আওতায় শেখ হাসিনাকে ফেরত আনা সম্ভব বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
এ বিষয়ে ফৌজদারি অপরাধ আইন বিশেষজ্ঞ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির ভোরের আকাশকে বলেন, ভারতের সঙ্গে থাকা বন্দিবিনিময় চুক্তির আওতায় শেখ হাসিনাকে ফেরত আনা সম্ভব। তিনি বলেন, এই চুক্তির মধ্যে ‘রাজনৈতিক প্রকৃতির’ বিবেচনায় আসামিকে তথা শেখ হাসিনাকে ফেরত না দেওয়ার অজুহাত তুলতে পারে ভারত। কিন্তু ওই চুক্তিতেই বলা হয়েছে, হত্যাকাণ্ডের মতো জঘন্যতম অপরাধকে রাজনৈতিক বিবেচনায় নাকচ করার সুযোগ নেই। ফলে এই চুক্তির আওতায় শেখ হাসিনাকে আনা সম্ভব। তবে সেটা নির্ভর করবে সরকারের দ্বিপাক্ষিক কূটনৈতিক তৎপরতার ওপর। তিনি বলেন, শেখ হাসিনা যে জঘন্যতম মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন, আর সেই অপরাধে তার বিরুদ্ধে বিচারিক প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। তাকে গ্রেপ্তারে ইন্টারপোলে রেড নোটিশ জারির আরজি জানিয়েছে বাংলাদেশ।
তবে গত ১৬ ডিসেম্বর উপলক্ষে ভারতের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী পৃথক বার্তায় প্রকারান্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে অস্বীকার করেছেন। ১৬ ডিসেম্বরকে ভারতের বিজয় হিসেবে উল্লেখ করেছেন তারা। কিন্তু ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের বিজয় অর্জিত হয়। এর পর থেকে ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের বিজয় দিবস হিসেবে উদযাপিত হয়ে আসছে। ভারতের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর এমন বিবৃতির পর শেখ হাসিনাকে ফেরত দেওয়া নিয়ে সংশয় রয়েছে।
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ ঘটনার পর থেকে তিনি ও তার বোন শেখ রেহানা ভারতের সরকারের সহায়তায় দিল্লিতে একটি নিরাপদ আশ্রয়ে (সেফ হাউস) অবস্থান করছেন বলে জানা গেছে। সেখানে থেকেই তিনি দলীয় নেতাকর্মীদের সংগঠিত করার চেষ্টা করছেন। এ বিষয়ে তার একাধিক ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। এসব ভিডিওতে শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করতে নানারকম উস্কানিমূলক বক্তব্য দিয়েছেন। একারণে ছাত্র-জনতা তাকে দেশে ফিরিয়ে বিচারের মুখোমুখী করতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। শেখ হাসিনাকে ফেরাতে জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ, সারজিস আলমসহ অনেকেই সরকারের কাছে দাবি জানানো অব্যাহত রেখেছেন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে ভারতকে চিঠি দেওয়ার পর প্রশ্ন উঠেছে, শেখ হাসিনাকে কোন প্রক্রিয়ায় ফেরত আনা যাবে। কারণ, এরই মধ্যে ভারত বিভিন্ন ইস্যুতে পুরোপুরি শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। ফলে ভারত শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশের হাতে তুলে দেবে কিংবা তুলে দিতে বাধ্য হবে, এমন প্রেক্ষাপট এখনও সৃষ্টি হয়নি। এ অবস্থায় শেখ হাসিনাকে ফেরত পাওয়া নিয়ে সংশয় রয়েছে। শেখ হাসিনাকে ফেরাতে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্দিবিনিময় চুক্তির কথা স্মরণ করিয়েছেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, শেখ হাসিনা কি ভারতে বন্দি? শেখ হাসিনা ভারতে যেভাবে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় রয়েছেন, তাতে কোনোভাবেই বলা যাবে না তিনি সেখানে বন্দি। একারণে তাকে বন্দিবিনিময় চুক্তির আওতায় ফেরানো যাবে কি না তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। কেউ কেউ বলছেন, ‘প্রত্যর্পণ’ চুক্তির আওতায় শেখ হাসিনাকে ফেরানো সম্ভব। তবে সেক্ষেত্রে ভারতের স্বদিচ্ছা থাকতে হবে।
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বন্দিবিনিময়ের জন্য ২০১৩ সালে একটি চুক্তি হয়। ‘প্রত্যর্পণযোগ্য অপরাধের মামলা’য় অভিযুক্ত বা ফেরার আসামি ও বন্দিদের একে অপরের কাছে হস্তান্তরের জন্য এই চুক্তি হয়। চুক্তি অনুযায়ী, যদি কোনো ব্যক্তির নামে মামলা বা অভিযোগ দায়ের হয় বা তিনি দোষী সাব্যস্ত হন অথবা দেশের আদালতের কর্তৃক প্রত্যর্পণযোগ্য অপরাধ করার জন্য তাকে ফেরত চাওয়া হয়, তাহলে তাকে ফেরত দেবে বাংলাদেশ ও ভারত। এই চুক্তিতে বলা হয়েছে যে অপরাধটি ‘রাজনৈতিক প্রকৃতির’ হলে যে কোনো দেশ প্রত্যর্পণের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করতে পারে। তবে চুক্তি অনুযায়ী হত্যা, নরহত্যা বা অপরাধমূলক হত্যা, আক্রমণ, বিস্ফোরণের কারণ, জীবন বিপন্ন করার উদ্দেশ্যে বিস্ফোরক পদার্থ বা অস্ত্র তৈরি বা নিজের কাছে রাখাসহ বেশ কিছু অপরাধকে রাজনৈতিক বলার সুযোগ নেই। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্দি প্রত্যর্পণ চুক্তিটি ২০১৬ সালে সংশোধন করা হয়। সংশোধনের সময় এমন একটি ধারা যুক্ত করা হয়েছিল, যেটি হস্তান্তরের প্রক্রিয়াকে বেশ সহজ করে তুলেছে। সংশোধিত চুক্তির ১০(৩) ধারায় বলা হয়েছে, কোনো অভিযুক্তের হস্তান্তর চাওয়ার সময় অনুরোধকারী দেশকে সেই সব অভিযোগের পক্ষে কোনো সাক্ষ্যপ্রমাণ পেশ না করলেও চলবে। শুধু সংশ্লিষ্ট আদালতের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা পেশ করলেই সেটিকে বৈধ অনুরোধ হিসেবে ধরা হবে।
সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ূন কবির বলেন, প্রত্যর্পণ চুক্তি বাস্তবায়ন করার বিষয়টি শুধু আইনি বিষয় নয়, রাজনৈতিকও বটে। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বর্তমান সম্পর্কের জায়গা থেকে শেখ হাসিনাকে চুক্তি কিংবা ইন্টারপোলের মাধ্যমে ফেরত পাওয়ার বিষয়টি অনেকটা জটিল। রাজনৈতিক বোঝাপড়ায় কোনো দেশ যদি কোনো আসামিকে ফেরত দিতে না চায়, তাহলে যেকোনো কারণ দেখিয়ে আবেদন নাকচ করে দিতে পারে।
শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তারে ইন্টারপোলে চিঠিক্ষমতাচ্যুত হয়ে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে হত্যা, গুম, নির্যাতনসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ অনুসন্ধান শুরু হয়েছে। প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, এখন পর্যন্ত শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ১১২টি অভিযোগ দাখিল হয়েছে ট্রাইব্যুনালে। এই অভিযোগের পর, এরই মধ্যে পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনালের নির্দেশে শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তারে রেড অ্যালার্ট জারির জন্য আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলে চিঠি দিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়। গত ১০ নভেম্বর বাংলাদেশ পুলিশের মহাপরিদর্শকের (আইজিপি) মাধ্যমে এই চিঠি দেওয়া হয়েছে।
সারা দেশে গত সাড়ে ১৫ বছরে (২০০৯ সালের পর থেকে গত ৫ আগস্ট পর্যন্ত) চালানো গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধে যুক্ত থাকার অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গত ১৭ অক্টোবর গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামল এবং জুলাই-আগস্টে তাদের ভূমিকা তুলে ধরে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির এই আবেদন করা হয়।
চিফ প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, ‘তিনি (শেখ হাসিনা) মানবতাবিরোধী অপরাধ সংগঠনের অভিযোগে অভিযুক্ত। তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি রয়েছে, কিন্তু বাংলাদেশের জুরিসডিকশনের বাইরে তিনি চলে গেছেন। সে কারণে আন্তর্জাতিক পুলিশিং সংস্থা হিসেবে ইন্টারপোল যাতে তাকে গ্রেপ্তার করার ব্যবস্থা নেয় এবং তার ব্যাপারে অন্তত রেড অ্যালার্ট জারি করে, সেই ব্যাপারে আমরা অনুরোধ পাঠিয়েছি।’
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারির জন্য ইন্টারপোলে চিঠি দেওয়ার পর, গত ১০ নভেম্বর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, পলাতক ফ্যাসিস্ট চক্র পৃথিবীর যে দেশেই থাকুক, ইন্টারপোলের মাধ্যমে তাদের ধরে এনে বিচারের মুখোমুখি করা হবে। তবে ইন্টারপোলের মাধ্যমে শেখ হাসিনাকে ফেরত আনা সম্ভব কি না, প্রশ্ন রয়েছে।
সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক নূরুল হুদার ভাষ্য অনুযায়ী, শেখ হাসিনাকে ভারত থেকে ফেরত আনা সহজ নয়। তিনি বলেন, ইন্টারপোলে কাউকে রেড অ্যালার্ট দিলেই যে তাকে দেশে ফেরত আনা যাবে, বিষয়টি একদমই তেমন নয়। যার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে, তাকে যে দেশে নেওয়া হবে, সেই দেশের পরিস্থিতি কেমন কিংবা রাজনৈতিক কোনো কারণ আছে কি না, সেগুলোও বিচার-বিশ্লেষণ করা হয়। সেক্ষেত্রে রাজনৈতিক কাউকে ফৌজদারি অপরাধে আটক দেখিয়ে আনা খুব একটা সহজ নয়।
ইন্টারপোল বা ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল পুলিশ অর্গানাইজেশন হলো এমন একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা, যেটি সারা বিশ্বের পুলিশ এবং অপরাধ বিশেষজ্ঞদের একটি নেটওয়ার্কে সংযুক্ত ও সমন্বয় করে। এর প্রধান কাজ অপরাধীদের ধরতে আন্তর্জাতিক পুলিশকে সহায়তা করা, যেন বিশ্বের সব পুলিশ অপরাধের বিরুদ্ধে এক হয়ে কাজ করতে পারে। যদি একটি দেশের আসামি সেখানে অপরাধ করার পর অন্য দেশে চলে যায়, তখন সেই আসামিকে ধরতে ইন্টারপোলের সহায়তা লাগে। সংস্থাটি অপরাধের তদন্ত, ফরেনসিক ডেটা বিশ্লেষণ, সেই সঙ্গে পলাতকদের খুঁজে বের করতে সহায়তা করে। এক্ষেত্রে ওই দেশকে সন্দেহভাজন অপরাধীর যাবতীয় তথ্য দিয়ে রেড নোটিশ জারির জন্য আবেদন করতে হয়। তবে ইন্টারপোল কোনো আসামিকে ধরিয়ে দেওয়ার আবেদন পেলেই তার বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারি করতে পারে না। অভিযুক্তের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারির জন্য অভিযুক্তের অপরাধবিষয়ক যাবতীয় কাগজপত্র, মামলা কপি ইত্যাদি সংগ্রহ করে ইন্টারপোলের কাছে আবেদন দিতে হয়। ইন্টারপোল সেই কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত নেয় যে তার বিরুদ্ধে কোনো নোটিশ জারি করা হবে কি হবে না। এক্ষেত্রে ওই ব্যক্তির দণ্ডপ্রাপ্ত হওয়া না হওয়া তাদের কাছে মুখ্য নয়। ইন্টারপোল কারও বিরুদ্ধে একবার রেড নোটিশ জারি করলে সেটি সংস্থাটির সদস্যভুক্ত ১৯৪টি দেশের কাছে পাঠানো হয়। দুর্নীতি, যুদ্ধাপরাধ, সন্ত্রাসবাদ, মানব-পাচার, অস্ত্রপাচার, মাদক পাচার, সাইবার ক্রাইম, মানি লন্ডারিং, শিশু সহিংসতাসহ ১৭ ক্যাটাগরির অপরাধ তদন্তে ইন্টারপোল তার সদস্য দেশগুলোকে সহায়তা দিয়ে থাকে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে গত ৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অভিযোগে বলা হয়, আসামির বিরুদ্ধে তদন্তে গণহত্যার প্রাথমিক অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে। আসামি প্রভাবশালী। এখনো দেশের বিভিন্ন স্থানে আসামির লোকজন বিভিন্ন পজিশনে আছে। তাই আলামত নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এছাড়া মামলার তদন্ত কাজ বাধাগ্রস্ত হতে পারে। তাই আসামির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আবেদন করছি। এ সময় সংবিধানের বিভিন্ন সংশোধনী, ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পর থেকে গুম, খুন, তথ্যপ্রযুক্তি আইনে হওয়া মামলার পরিসংখ্যান, অর্থ পাচারের পরিসংখ্যান এবং সর্বশেষ ছাত্র আন্দোলনে বল প্রয়োগের তথ্য তুলে ধরেন তিনি। তিনি সূচনা বক্তব্যে ২০০৯ সালে বিডিআর বিদ্রোহে ৭৪ জনকে হত্যা, ২০১৩ সালে শাপলা চত্বরে হেফাজতের সমাবেশে ‘হত্যা’, র্যাবের বিচারবহির্ভূত হত্যা, ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট ‘গণহত্যা’সহ আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে ‘মানবতাবিরোধী অপরাধের’ সারসংক্ষেপ তুলে ধরেন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়াও তার সরকারের মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী, সাহিত্যিক ও গণমাধ্যমকর্মীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে ধরা হয়। আবেদনে অপরাধের ঘটনা স্থান হিসেবে সমগ্র বাংলাদেশকে দেখানো হয়েছে।
একাত্তরে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে। এই ট্রাইব্যুনালের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয় ২০১০ সালের ২৫ মার্চ। এই ট্রাইব্যুনালে চলছে শেখ হাসিনার বিচারকাজ।
ভোরের আকাশ/রন
মন্তব্য