২০২৫ সালের শেষ দিকে কিংবা ২০২৬ সালের মাঝামাঝি সময়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হতে পারে বলে কয়েকদিন আগে ঘোষণা দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। কিন্তু তার এই ঘোষণায় সন্তুষ্ট হতে পারেনি দেশের অন্যতম বড় দল বিএনপি। তারা আগামী নির্বাচন নিয়ে সংশয়ে রয়েছেন। এরই মধ্যে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ‘ভোট ও ভাতের অধিকারের জন্য ৫ আগস্টের মতো রাস্তায় নামতে হবে’ বলে মন্তব্য করেছেন; যা নিয়ে নানামুখী আলোচনা শুরু হয়েছে। দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেছেন, কখন নির্বাচন হবে, সেটি সরকার স্পষ্ট করেনি বলেই সংশয় তৈরি হয়েছে। এছাড়া বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা জহির উদ্দিন স্বপন বলেছেন, কোন কোন মহল নির্বাচন বিলম্বিত করার চেষ্টা করছে। এতে সংকট তৈরি হতে পারে। বিএনপি নির্বাচন চাইলেও অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেছেন, নির্বাচন নিয়ে অধৈর্য হওয়াটা সরকারের সংস্কার কার্যক্রমকে ব্যাহত করছে। সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়নের পরই সরকার নির্বাচনের দিকে যাবে। শুধু নির্বাচনের জন্য এত মানুষ প্রাণ দেয়নি। এদিকে রাজনীতি বিশ্লেষক অধ্যাপক জোবাইদা নাসরীন বলেছেন, নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট তারিখ না থাকায় সরকারের প্রবল অনীহা দৃশ্যমান হয়েছে।
প্রসঙ্গত, সরকারের সংস্কার কর্মসূচির জন্য সুপারিশ প্রণয়ন করতে ছয়টি কমিশন কাজ করছে। এসব কমিশন আগামী মাস, অর্থাৎ জানুয়ারি নাগাদ তাদের রিপোর্ট দিতে পারে। এসব কমিশনের রিপোর্ট পাওয়ার পর প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশন’ কাজ শুরু করবে এবং তারাই নির্বাচনের মতো জরুরি বিষয়গুলো নিয়ে দলগুলোর সাথে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবে বলে প্রধান উপদেষ্টা জানিয়েছেন।
নিজ জেলা ঠাকুরগাঁওয়ে দলীয় জনসভায় গত সোমবার ভাষণ দেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। সেখানে তিনি বলেন, আপনারা কি সত্যি পরিবর্তন চান, নাকি আবার ওই আওয়ামী লীগের নৌকায় ফিরে যেতে চান? তাহলে ৫ আগস্ট আপনারা যেমন রাস্তায় নেমেছিলেন, আবারও ঐক্যবদ্ধ হয়ে রাস্তায় নামতে হবে। ভোটের অধিকার, ভাতের অধিকার আদায়ের জন্য এবং ন্যায়বিচার পাওয়ার জন্য রাস্তায় নামতে হবে। সরকারের দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, কিছু মানুষ এখন বিভিন্ন রকম কথা বলছেন। বিভিন্ন রকম কথা বলা বন্ধ করুন। বিশেষ করে দায়িত্বশীল জায়গায় থেকে ভুল কথা বা উত্তেজনামূলক কথা বলে দেশের মানুষকে আর বিভ্রান্ত করবেন না।
প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস জাতির উদ্দেশে দেয়া সর্বশেষ ভাষণে বলেছেন, ২০২৫ সালের শেষে বা ২০২৬ সালের শুরুতে আগামী জাতীয় নির্বাচন হতে পারে। এটিই ছিল সরকারপ্রধানের দিক থেকে নির্বাচনের সম্ভাব্য সময়সীমা সম্পর্কে প্রথম আনুষ্ঠানিক মন্তব্য। পরদিনই তার প্রেস সচিব শফিকুল আলম সংবাদ সম্মেলনে ২০২৬ সালের ৩০ জুনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বলে মানুষ আশা করতে পারে বলে মন্তব্য করেন। এরপর তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বিএনপি। একদিন পরেই বিএনপি মহাসচিব নির্বাচন নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ও তার প্রেস সচিবের বক্তব্যকে সাংঘর্ষিক উল্লেখ করে উষ্মা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, নির্বাচনকেন্দ্রিক সংস্কারগুলো সম্পন্ন করে দ্রুত নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব। জনগণ এই বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার কাছে সুস্পষ্ট বক্তব্য প্রত্যাশা করে। যদিও সরকার ইতোমধ্যেই নির্বাচন কমিশন গঠন করেছে এবং কমিশন ভোটার তালিকা হালনাগাদের কাজ শুরু করেছে। কিন্তু দলটির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা মনে করেন, এর পরেও নির্বাচন নিয়ে ‘রাস্তায় নামার আহ্বান’ আসার মূল কারণ হলো সরকার সংশ্লিষ্ট কিছু মহল থেকে নির্বাচন নিয়ে নানা ধরনের মন্তব্য আসা। বিশেষ করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং তাদের ঘনিষ্ঠ মিত্র জাতীয় নাগরিক কমিটি থেকে নির্বাচনের চেয়ে সংস্কার কার্যক্রমে জোর দেয়া এবং বিএনপির সমালোচনা করে করা নানা ধরনের মন্তব্য থেকে দলটির অনেকে আশঙ্কা করছেন, এগুলো ‘নির্বাচনকে বিলম্বিত করার প্রেক্ষাপট’ তৈরির একটি প্রচেষ্টার অংশ হতে পারে।
বিএনপি জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলছেন, সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ না দিয়ে নির্বাচন নিয়ে বিভিন্ন ধরনের বক্তব্য আসছে বলেই জনমনে বিভ্রান্তি কিংবা অস্পষ্টতা তৈরি হয়েছে। মানুষ কখন ভোট দিয়ে তাদের পছন্দনীয় সরকার গঠন করতে পারবে, সেটা স্পষ্ট করা দরকার দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার স্বার্থে। সরকার অন্য যাই বলুক, এই ভোটের সময়টা না পাওয়াতেই জনমনে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। বিএনপি সেটিই তুলে ধরছে। তিনি মনে করেন দেশের নানা সংকটের পাশাপাশি বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে দেশে-বিদেশে যেসব ‘অপতৎপরতা’ চলছে, সেগুলোও সরকার সামাল দিতে পারছে না। নানা ধরনের প্রচারণা দেখছি আমরা বাংলাদেশকে নিয়ে। নির্বাচিত সরকার ছাড়া এমন পরিস্থিতি মোকাবিলা করা কঠিন। অথচ সেদিকে মনোযোগ না দিয়ে বিএনপি ও নির্বাচন নিয়ে নানা ধরনের মন্তব্য আসছে সরকার ও সরকারঘনিষ্ঠ মহলগুলো থেকে। এজন্যই বিএনপি জনগণের ভোটের অধিকার চাইছে ও এ নিয়ে কথা বলছে। অন্যদিকে, দলটির চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য জহির উদ্দিন স্বপন বলেছেন, কোন কোন মহল নির্বাচনকে বিলম্বিত করার চেষ্টা করছে এবং বিষয়টি নিয়ে বিএনপির দিক থেকে আগেও সতর্ক করা হয়েছে। তিনি বলেন, আমরা সরকারকে সহযোগিতা করছি। কিন্তু নির্বাচনের তো বিকল্প কিছু নেই। কোন কোন মহল হয়তো ভিন্ন চিন্তা করছে। তেমনটি হলে জনগণের ভোটের অধিকার আদায়ের জন্য তো রাজনৈতিক কর্মসূচিই দিতে হবে। আমাদের মহাসচিব দলের পক্ষে সেই বার্তাই দিয়েছেন। অর্থাৎ দলটির নেতাদের কথায় এটি অনেকটাই পরিষ্কার- ভোট ও ভাতের অধিকারের জন্য রাস্তায় নামার কথা বলে মূলত বিএনপি মহাসচিব সরকারকে এমন বার্তাই দিতে চেয়েছেন যে নির্বাচন বিলম্বিত করার চেষ্টা হলে সেটি বিএনপি গ্রহণ করবে না।
অন্যদিকে, গত মঙ্গলবার সরকারের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, নির্বাচনের সময়টা নির্ভর করবে সংস্কার কার্যক্রমের ওপর। সংস্কার কমিশনগুলো দ্রুত রিপোর্ট দেয়ার পর দলগুলোর সাথে আলোচনার মাধ্যমে সরকার সংস্কার বাস্তবায়নের দিকে যাবে। সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়নের পর আমরা নির্বাচনের দিকে যাবো। নির্বাচন কমিশন তা নিয়ে কাজ করছে। নির্বাচন নিয়ে অধৈর্য হয়ে যাওয়া সংস্কার কার্যক্রম কিছুটা ব্যাহত করছে। সেখানে এক ধরনের বাধার সৃষ্টি করছে। আশা করবো দলগুলো সংস্কার কার্যক্রমে তাদের মতামত দিয়ে সহযোগিতা করুক। তাদের সাথে আলোচনার ভিত্তিতেই সংস্কার সম্পন্ন হবে। গতকাল বুধবার তিনি ঠাকুরগাঁওয়ে বলেন, শুধু একটা নির্বাচন কিংবা ভোটের জন্য এত এত মানুষ জীবন দেয়নি। গতকাল সকালে ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গী উপজেলা পরিষদ হলরুমে অসহায় ও দুস্থ মানুষের মধ্যে শীতবস্ত্র বিতরণ শেষে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন। এই উপদেষ্টা বলেন, এই গণঅভ্যুত্থানের যে এক দফা ছিল, তা হলো স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার পতন ও ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপ। ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপ বলতে আমরা স্পষ্টভাবে বুঝি, বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানগুলোকে ফ্যাসিজমের মধ্য দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সব প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস অবস্থায় রেখে যাওয়া হয়েছে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করা হয়েছে। সেই জায়গা থেকে, এক দফা বাস্তবায়নের জায়গা থেকে আমরা মনে করি, সংস্কারের কার্যক্রম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শুধু একটা নির্বাচন কিংবা ভোটের জন্য এত এত মানুষ জীবন দেয়নি। আমরা ধারণা করছি, ২ সহস্রাধিক মানুষ শহীদ ও ২০ হাজারের বেশি আহত।
শহীদ পরিবার ও আহত ব্যক্তিরাও সংস্কারের কথা বলছেন মন্তব্য করে আসিফ মাহমুদ বলেন, এই সরকারের ক্লিয়ার ম্যান্ডেট হচ্ছে, আমরা সংস্কার কার্যক্রমগুলো করব। আপনারা জানেন, আমাদের কমিশনগুলোর তিন মাসের মতো সময় হয়ে যাচ্ছে; তারা প্রস্তাবনা দেবে। তারপর যারা স্টেকহোল্ডার আছে, তাদের সঙ্গে কথা বলে সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে একটা নির্বাচনের দিকে যাব।
বিএনপির শঙ্কা কী যৌক্তিক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক জোবাইদা নাসরীন বলেন, নির্বাচন নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা মোটামুটি একটি সময়ের কথা বললেও সুনির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণায় যে সরকারের প্রবল অনীহা - তা কিন্তু দৃশ্যমান। তিনি বলেন, প্রধান উপদেষ্টা একদিকে একটি সময় বলেছেন, আবার অন্যদিকে বলেছেন তার নেতৃত্বে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন এসব বিষয় চূড়ান্ত করবে। আবার উপদেষ্টারা কেউ কেউ বলছেন সংস্কারের পর নির্বাচন। ফলে নির্বাচনের তারিখ বলার ক্ষেত্রে একটি অনিশ্চয়তা তো জনমনে আছে। সে কারণেই বিএনপির মধ্যেও শঙ্কা তৈরি হয়েছে এবং এ পরিস্থিতিতে সেটাই স্বাভাবিক।
অধ্যাপক জোবাইদা নাসরীন বলেন, অনেক দিন ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি বিশ্বাস করে, যত দ্রুত নির্বাচন হবে তত তাদের ক্ষমতায় যাওয়ার পথ তৈরি হবে। কিন্তু বিলম্বিত হলে আবার রাজনৈতিক সংকট তৈরি হতে পারে। কোন সংস্কার কতদিনে হবে কিংবা কতটা হবে তারও তো নিশ্চয়তা নেই। এসব কারণেই দলটির মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।
ভোরের আকাশ/রন
মন্তব্য