ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ‘জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র’ ঘোষণা করা হবে আগামীকাল মঙ্গলবার। ঘোষণাপত্রের মর্মার্থসহ নানা দিক তুলে ধরবেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা। তারা বলছেন, যে স্পিরিট নিয়ে সরকার পতনের সফল আন্দোলন করা হয়েছিল তা জাতির সামনে তুলে ধরা হবে এই ঘোষণাপত্রে। বৈষম্যহীন সমাজ গঠনে নানা সুপারিশমালাও থাকবে সেখানে। অভ্যুত্থান পরবর্তী কেমন রাষ্ট্র শিক্ষার্থী ও দেশের সাধারণ মানুষ প্রত্যাশা করে সেটির বিষয় উল্লেখ থাকবে এই ঘোষণাপত্রে। এছাড়া মৌলিক অধিকার ও নাগরিক অধিকার রক্ষা করবে এমন একটা রাষ্ট্রের ঘোষণা কিংবা রূপকল্প উপস্থাপন করা হবে।
ওইদিন রাজধানীর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শিক্ষার্থীদের জড়ো হওয়ার আহ্বান জানিয়ে গত শনিবার সন্ধ্যার পর থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্যরা ফেসবুকে একের পর এক পোস্ট দিতে থাকেন। তবে ওই দিন কী হবে, তা নিয়ে কেউ বিস্তারিত না বলায় ব্যাপক চাঞ্চল্য তৈরি হয়। অবশেষে ঘোষণাপত্রের বিষয়টি গতকাল রোববার ঢাকায় এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে তুলে ধরেন তারা।
সংবাদ সম্মেলনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা বলেছেন, মঙ্গলবার দেশে মুজিববাদী সংবিধানের কবর রচিত হবে এবং আওয়ামী লীগ দল হিসেবে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়বে বাংলাদেশে। ওইদিন ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ‘জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র’ ঘোষণা করা হবে।
সংবাদ সম্মেলনে হাসনাত আবদুল্লাহ বলেছেন, এই ঘোষণাপত্র ৫ আগস্টেই হওয়া উচিত ছিল, সেটি না হওয়ার ফলে ফ্যাসিবাদের পক্ষের শক্তিগুলো ষড়যন্ত্র করেই যাচ্ছে। দুই হাজারের ঊর্ধ্বে শহীদ এবং ২০ হাজারের ঊর্ধ্বে আহতদের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে তারা এই আন্দোলনের ‘লেজিটেমেসি’কে প্রশ্ন করেই যাচ্ছে।
হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, জুলাই অভ্যুত্থান, যে গণঅভ্যুত্থানটি হয়েছে...তার মধ্য দিয়ে মানুষ মুজিববাদী সংবিধানের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। এই যে মানুষ মুজিববাদী সংবিধানের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে, তার একটি লিগ্যাল ডকুমেন্টেশন থাকা উচিত। সে জায়গা থেকে ৩১ ডিসেম্বর (মঙ্গলবার) ছাত্র-জনতার উপস্থিতিতে... ২০২৪ এর গণঅভ্যুত্থান ঘিরে আমাদের যে গণআকাক্সক্ষা তৈরি হয়েছে, ৭২ এর সংবিধানের বিপরীতে গিয়ে মানুষ যে রাস্তায় নেমে এসেছে এ অভ্যুত্থানে সেটির প্রাতিষ্ঠানিক, দালিলিক স্বীকৃতি ঘোষণা করার জন্য আমরা ৩১ ডিসেম্বর ছাত্র-জনতার উপস্থিতিতে শহীদ মিনার থেকে আমাদের ‘প্রোক্লেমেশন অব জুলাই রেভ্যুলেশন’ ঘোষণা করবো।
হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, আমাদের পরবর্তী বাংলাদেশের স্বপ্ন-আকাক্সক্ষা-অভিপ্রায় এবং ইশতেহার লিপিবদ্ধ থাকবে এই প্রোক্লেমেশনে। এটা কোনও দলের বা শ্রেণির প্রোক্লেমেশন না। ৭২- এর যে সংবিধানের বিরুদ্ধে মানুষ দাঁড়িয়েছে, মুজিববাদী চেতনার বিরুদ্ধে মানুষ দাঁড়িয়েছে, আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে যে মানুষ দাঁড়িয়েছে- আমরা চাই স্বীকৃতি দেওয়া হোক। আমরা চাই এই মুজিববাদী সংবিধানের কবর রচিত হবে, যেখান থেকে এক দফা ঘোষণা করা হয়েছিল, সেই শহীদ মিনার থেকেই মুজিববাদী সংবিধানের কবর রচিত হবে। ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ বাংলাদেশে অপ্রাসঙ্গিক দল হয়ে পড়বে।
সংবাদ সম্মেলনে সমন্বয়ক সারজিস আলম বলেন, জুলাই বিপ্লবে মানুষের আশা আকাক্সক্ষার প্রতিফলন একটি ঘোষণাপত্রে লিখিতভাবে লিপিবদ্ধ করা দরকার, সেটাই কিছুটা দেরিতে হলেও এই ঘোষণাপত্রে থাকবে। প্রয়োজনে সামনে এটি আরও সংশোধন, পরিবর্তন ও পরিমার্জন হতে পারে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা জানিয়েছেন, ইতোমধ্যেই এই ঘোষণাপত্রের ড্রাফট বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কাছে পাঠানো হয়েছে, তারা নিজ নিজ মন্তব্য ও বক্তব্য দিচ্ছেন, যা ৩১ ডিসেম্বর- জুলাই প্রোক্লেমেশনে দেখা যাবে।
৩১ ডিসেম্বর সবাইকে ঢাকায় আসার আহ্বান জানিয়ে সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসুদ বলেন, যারা পাঁচই আগস্ট ঢাকায় আসতে পারেননি, তারা সবাই ৩১ ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে উপস্থিত হবেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা জানিয়েছেন, এই কর্মসূচি হবে দলীয় ব্যানারহীন, তবে এতে উপস্থিত থাকবেন জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে নিহত এবং আহতদের পরিবারের সদস্য, ছাত্র, শ্রমিক, রাজনৈতিক দল, শিক্ষাবিদসহ সমাজের নানা অংশের মানুষ।
এত আলোচনার কারণ কী :
গত শনিবার রাতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সংগঠক ও বর্তমানে জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম নিজের ভেরিফাইড ফেসবুক পোস্টে লিখেন, ‘৩১ ডিসেম্বর! শহীদ মিনার, বিকাল ৩টা। এখনই সময়, বাংলাদেশের জন্য।’
প্রায় একই সময় পরপর দু’টি পোস্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ। সেখানে তিনি লিখেন, ‘কমরেডস, থার্টি ফার্স্ট ডিসেম্বর! নাও অর নেভার।’
এরপর আরেকটি স্ট্যাটাসে হাসনাত আব্দুল্লাহ লিখেন, ‘প্রোক্লেমেশন অব জুলাই রেভ্যুলেশন’, থার্টি ফার্স্ট ডিসেম্বর, শহীদ মিনার। বিকাল তিনটা।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ভেরিফাইড ফেসবুক পেজ থেকেও শনিবার রাতে পোস্ট দেওয়া হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, আগামী ৩১ ডিসেম্বর বিকেল তিনটায় শহীদ মিনারে জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র পাঠ করা হবে।
কী থাকবে সেই ঘোষণাপত্রে এমন প্রশ্নে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখ্য সংগঠক আব্দুল হান্নান মাসউদ গণমাধ্যমকে বলেন, ‘এই ঘোষণাপত্রে বেশ কিছু বিষয় থাকবে যেটার মূল বিষয় থাকবে জুলাই অভ্যুত্থানের স্পিরিট। আমরা এখন ঘোষণাপত্র প্রস্তুত করছি।’
স্বাভাবিকভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই পোস্ট ছড়িয়ে পড়ার পর অনেকের মধ্যে নানা আলোচনা তৈরি হয়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের ওইসব পোস্টের নিচে কেউ কেউ জানতে চান, ‘ছাত্রদের নতুন রাজনৈতিক দলের ঘোষণা আসবে সেদিন?’
তবে এসব প্রশ্ন নাকচ করে দিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সদস্য সচিব আরিফ সোহেল গণমাধ্যমকে বলেন, ওই দিন জুলাই অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র অংশগ্রহণের দিক থেকে এবং কার্যক্রমের দিক থেকে বাংলাদেশের ইতিহাসের ব্যতিক্রম একটি ঘটনা হবে। যে কারণে এটা নিয়ে সবার মাঝে আগ্রহ থাকবে এটাই স্বাভাবিক।
ঘোষণাপত্রের মর্মার্থ :
বিবিসি বাংলার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত শনিবার সন্ধ্যায় ফেসবুকে বিষয়টি ছড়িয়ে পড়ার পর এ নিয়ে নানা আলোচনা দেখা যায় যায়। বিবিসি বাংলার পক্ষ থেকে সরকারে থাকা ছাত্র উপদেষ্টা, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাসহ অনেকের সাথেই কথা বলেছে। সেখানে ছাত্ররা কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের কথা জানিয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম এক সংগঠক জানিয়েছেন, গত পনেরো বছরে কী কী দমন-পীড়নের কারণে শিক্ষার্থীদের অভ্যুত্থানের সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে সেটি থাকবে ঘোষণাপত্রের প্রথমেই। বিগত বছরগুলোতে রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ধ্বংস, ভোটাধিকার হরণ, গুম ক্রসফায়ারের কারণে যে সংকট হয়েছে তার সাপেক্ষে এই অভ্যুত্থান করতে হয়েছে।
সংগঠনের সদস্য সচিব আরিফ সোহেল বলেন, আমরা যে স্পিরিট নিয়ে এই আন্দোলন করেছিলাম সেটা জাতির সামনে তুলে ধরা হবে এই ঘোষণাপত্রে। বৈষম্যহীন সমাজ গঠনে নানা সুপারিশমালাও থাকবে সেখানে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা বলছেন, অভ্যুত্থান পরবর্তী কেমন রাষ্ট্র শিক্ষার্থী ও দেশের সাধারণ মানুষ প্রত্যাশা করে সেটির বিষয় উল্লেখ থাকবে এই ঘোষণাপত্রে। এছাড়া মৌলিক অধিকার ও নাগরিক অধিকার রক্ষা করবে এমন একটা রাষ্ট্রের ঘোষণা কিংবা রূপকল্প উপস্থাপন করা হবে এই ঘোষণাপত্রে। এই ঘোষণাপত্র রেট্রোস্পেক্টিভ কায়দায় ৫ আগস্ট থেকে কার্যকর হবে।
বিবিসির প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, গণঅভ্যুত্থানের গত পাঁচই আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটে। এরপর অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর গত কয়েক মাসে দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নানা ধরনের অসন্তোষ দেখা গেছে। সাম্প্রতিক সময়ে সরকারি কর্মকর্তারাও একটি সংস্কার প্রস্তাবকে ঘিরে আন্দোলনে নেমেছেন। এছাড়া সরকারের পক্ষ থেকে প্রশাসনের বিভিন্ন জায়গায় যখন রদবদলের চেষ্টা করা হয়েছে তখনও এক ধরনের অস্থিরতা তৈরি হয়েছে।বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শীর্ষ কয়েকজন সংগঠক বলেন, পাঁচই আগস্ট পরবর্তী সরকার বিপ্লবী সরকার না হওয়ায় অনেক সিদ্ধান্তই তারা বিপ্লবী কায়দায় নিতে পারেনি। যে কারণে এখনো প্রশাসন ও সরকারে নানা সংকট দেখা যাচ্ছে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখ্য সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসউদ বলেন, এই সরকার না বিপ্লবী, না সাংবিধানিক সরকার। সে সময় যদি একটা বিপ্লবী সরকার গঠিত হতো তাহলে এই তারা অনেক ধরনের সিদ্ধান্তই নিতে পারতো। তবে এই ঘোষণাপত্র হঠাৎ কেন এখন ঘোষণা হচ্ছে - এমন প্রশ্নে সরকারের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ বলেন, জুলাইয়ের ঘোষণাপত্র। জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানের কিছু অসমাপ্ত কাজ আছে সেটা সমাপ্ত করার কাজটি আমরা এই বছরের মধ্যেই করতে চাই।
প্রায় একই অভিমত ব্যক্ত করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সদস্য আরিফ সোহেল বলেন, এটি অনেক আগেই করা উচিত ছিল। কিন্তু এই ২৪ আর জুলাই আর কখনো ফিরে আসবে না। তাই একটু তাড়াহুড়ো করে হলেও বছরের শেষ দিন জুলাই ঘোষণাপত্র দেওয়া হবে।
এই ঘোষণা চূড়ান্ত করার আগে রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ, বিভিন্ন শ্রেণি-প্রেশার অংশীজনদের সাথেও এরই মধ্যে আলোচনা করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
ভোরের আকাশ/রন
মন্তব্য