সাত প্রকল্পে ফাঁসছেন সাবেক চারমন্ত্রী

সাজেদা হক
সাত প্রকল্পে ফাঁসছেন সাবেক চারমন্ত্রী

প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকার অনিয়ম খুঁজতে রেল ভবনে অভিযান চালিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গতকাল রোববার ডেমুট্রেন প্রকল্পসহ সাত প্রকল্পের দুর্নীতি অনুসন্ধানে এ অভিযান চালানো হয়। এতে সাবেক চার রেলমন্ত্রী ফেঁসে যেতে পারেন। এসব প্রকল্পে সাজানো দরপত্রে ভিন্ন ভিন্ন নামে একই ব্যক্তিকে সুবিধা দেওয়ার অভিযোগ খতিয়ে দেখছে দুদক। অভিযানে নেতৃত্ব দেন সহকারী পরিচালক আবুল কালাম আজাদ ও ফেরদাউস রহমান।

জানা গেছে, ফেরদাউস রহমান নেতৃত্বে দেন সাজানো দরপত্রে ভিন্ন ভিন্ন নামে একই ব্যক্তিকে কাজ পাইয়ে দেওয়ার অভিযোগ তদন্তে। আর আবুল কালাম আজাদ নেতৃত্ব দেন ডেমু ট্রেনসহ ৭ প্রকল্পে অনিয়ম তদন্তে। তিনি বলেন, রেল খাতে বিভিন্ন প্রকল্পে অনিয়ম, স্ট্যান্ডিং টিকিট বিক্রয়ের অর্থ আত্মসাৎ ও পরিচালন ব্যয়ে নানাবিধ অনিয়মে বিগত ১৫ বছরে ২১০০০ কোটি টাকা লোকসান হওয়ার অভিযোগ খতিয়ে দেখা হচ্ছে। অভিযানকালে টিম ৩০টি লোকোমোটিভ ক্রয়; ২০১৮-২০১৯ অর্থ বছরের আবাসিক উন্নয়ন; রেলপথ নির্মাণ; ডেমু ট্রেন ক্রয় ও ব্যবস্থাপনা; অতিরিক্ত পরিচালনা ব্যয়; পূর্বাঞ্চলে রেলপথ ব্যবস্থাপনায় অতিরিক্ত মূল্যে যন্ত্রপাতি ক্রয় প্রভৃতিবিষয়ক ৭টি অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে। অভিযোগের ডকুমেন্টস পরে পাঠাবেন মর্মে অবহিত করেন রেলওয়ে মন্ত্রণালয়। পরবর্তীতে রেকর্ডপত্র প্রাপ্তি, সংগ্রহ ও যাচাইপূর্বক একটি প্রতিবেদন কমিশন বরাবর দাখিল করা হবে বলেও জানান তিনি।

তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক দুদক কর্মকর্তা জানান, এসব অনিয়মের মূল হোতাকে চিহ্নিত করতেই এই অভিযান। অভিযোগের তীর সাবেক চার মন্ত্রীর দিকে।

সূত্র জানায়, ডিজেল মালটিপল ইউনিট (ডেমু) প্রকল্পের ব্যর্থতার দায় নিচ্ছে না রেলের কেউ। প্রকল্পটি অনুমোদন, দরপত্র প্রক্রিয়া, ক্রয় প্রক্রিয়া এসবের প্রায় প্রতিটি ধাপে অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে। এ প্রকল্পের আওতায় প্রায় ৬৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে কেনা ২০ সেট ডেমু শুরুতেই মুখ থুবড়ে পড়ে। ৩৫ বছর মেয়াদ থাকলেও প্রথম ২ বছর থেকেই অকেজো হওয়া শুরু। এখন কোনো অবস্থাতেই এগুলো মেরামত করা সম্ভব নয়। ডেমুর মালামাল স্থানীয়ভাবে কোথাও পাওয়া যায় না। চীন এগুলোকে একটি বিশেষ সফটওয়্যার দিয়ে চালাত। সেই সফটওয়্যারও নেই। যে কদিন ট্রেনগুলো চলাচল করেছে সে সময় মেরামতের পেছনে অতিরিক্ত ব্যয়ের কারণে লোকসান হয়েছে আরও প্রায় ৩০ কোটি টাকা। সব মিলে ডেমু ট্রেনের পেছনে সরকারের লোকসান হয়েছে ৬৫০ কোটি টাকা। ২০১৩ সালে নেওয়া প্রকল্পের পিডিসহ সংশ্লিষ্ট বেশকিছু কর্মকর্তা অবসরে গেছেন। প্রকল্প তৈরির সময় রেলের মহাপরিচালক এবং তার পরের মহাপরিচালকও অবসরে। তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী এবং পরিকল্পনামন্ত্রী মারা গেছেন। কিছু কর্মকর্তা এখন চাকরিতে থাকলেও তাদের কেউ দায় নিচ্ছেন না। এছাড়া বর্তমানে যারা দায়িত্বে আছেন তারা বলছেন প্রকল্প গ্রহণ ক্রয়সহ এ সংক্রান্ত কাজের সময় তারা ছিলেন না।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, বিগত ১৬ বছরে রেলপথ নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ৯৭ হাজার কোটি টাকা। তাদের মতে, অত্যন্ত সুকৌশলে প্রতিটি প্রকল্পের মেয়াদ ও খরচ বাড়ানো হয়েছে একাধিকবার। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ১৮০০ কোটি টাকা প্রকল্প করা হয়েছে ১৮ হাজার কোটি; ৮০০ কোটি হয়েছে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা। কিন্তু আমলে নেয়নি বিগত সরকারের নীতিনির্ধারকরা।

ইতোমধ্যেই সাবেক চার মন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্টদের লুটপাটের ঘটনা অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। পাশাপাশি সাবেক রেলপথমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছে ভোরের আকাশ।

তবে রেলওয়ে পরিকল্পনা দপ্তর বলছে, রেলপথ নির্মাণে রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন ও সরকারের ওপর মহলের চাপ ছিল। একেকটি প্রকল্প ব্যয় ধরা হয় গড়ে ২ হাজার থেকে ৪০ হাজার কোটি টাকা। দুটি অগ্রাধিকার প্রকল্পসহ অন্তত ৭টি প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে যথাযথ সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়নি। প্রকল্প শুরুতে ব্যয় কিছুটা কম ধরা হলেও পরে প্রকল্পের ব্যয় অস্বাভাবিভাবে বাড়ানো হয়।

রেলপথ মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের জুলাই পর্যন্ত ছোট-বড় মিলিয়ে সর্বমোট ১০৮৮.১৭ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ করেছে আওয়ামী লীগ সরকার। এসব প্রকল্পে ৯৭ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। গড়ে প্রতিকিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ খরচ করা হয়েছে প্রায় ৯০ কোটি টাকা। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের নেওয়া নতুন রেলপথ নির্মাণে দুটি অগ্রাধিকার প্রকল্পসহ ৭টি প্রকল্পে গড়ে প্রতি কিলোমিটার লাইন নির্মাণে খরচ দেখানো হয়েছে ৭০ থেকে ২৩০ কোটি টাকা।

নতুন নির্মিত প্রকল্পগুলোর মধ্যে ৭টি প্রকল্পে প্রায় ৭৫ হাজার কোটি টাকা খরচ হয়েছে। বিগত সরকারের অগ্রাধিকার ‘দোহাজারী-কক্সবাজার-রামু’ প্রকল্প ব্যয় ধরা হয় ১৮ হাজার ৩৪ কোটি টাকা। সেই হিসাবে ওই পথে গড়ে প্রতি কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণে ব্যয় প্রায় ১৭৯ কোটি টাকা। আওয়ামী লীগ সরকারের ফাস্ট ট্র্যাকভুক্ত এ প্রকল্পের শুরুতে ২০১০ সালে ব্যয় ধরা হয়েছিল মাত্র ১৮০০ কোটি টাকা। সম্প্রতি পিইসি সভায় ওই প্রকল্পের রামু-ঘুমধুম অংশ বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ওই অংশ বাদ দেওয়া হলে ব্যয় কমবে ৬ হাজার ৬৭০ কোটি টাকা।

ঢাকা থেকে যশোর পযর্ন্ত ‘পদ্মা রেললিংক প্রকল্প’র কাজ চলমান রয়েছে। ১৭১ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পে প্রতি কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ খরচ ২৩০ কোটি টাকার বেশি। অর্থাৎ ৩৯ হাজার ২৪৬ কোটি টাকা ব্যয়ে নতুন এ রুট করা হচ্ছে। আখাউড়া-লাকসাম প্রকল্পে গড়ে প্রতি কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ খরচ হয় ৯০ কোটি টাকা। টঙ্গী-ভৈরববাজার রেলপথ নির্মাণ খরচ ১১৮ কোটি টাকার বেশি। তাড়াকান্দি-যমুনা ব্রিজ পর্যন্ত ৩৫ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ হয় প্রায় ২২শ কোটি টাকা। এ রুটে কিলোমিটার খরচ হয় প্রায় ৬৩ কোটি টাকা।

এছাড়া ঢাকা-টঙ্গী ৩য় এবং ৪র্থ লেন লাইন স্থাপন প্রকল্পে প্রতি কিলোমিটার খরচ হচ্ছে ১০১ কোটি টাকা। এ প্রকল্পটি ২০১২ সালে শুরু হয়। শুরুতে প্রকল্প ব্যয় ধরা হয় ৮৪৮ কোটি ৬০ লাখ টাকা। পরবর্তী সময়ে একাধিকবার সময় ও ব্যয় বাড়িয়ে বর্তমানে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ হাজার ৩৪৩ দশমিক ৫৫ কোটি টাকা। রাজবাড়ী টঙ্গীপাড়া রেলপথ নির্মাণ প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় হয় ২৩৫০ কোটি টাকা। এ পথে কিলোমিটার খরচ হয় প্রায় ৩১ কোটি টাকা।

এছাড়া আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা ছাড়ার বছর খানেক আগে ঢাকা-পায়রা বন্দর-কুয়াকাটা পর্যন্ত ২১৫ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প গ্রহণ করে; যাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৪১ হাজার ৭৯৮ কোটি টাকা। ২০২২ সালের জুন থেকে ২০২৯ সালের জুন পর্যন্ত মেয়াদকাল ধরা হয়েছে। এ প্রকল্পে প্রতি কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ১৯৬ কোটি টাকা। আখাউড়া সিলেট রেলপথে মিটারগেজকে ডুয়েলগেজ লাইনে রূপান্তর প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয় প্রায় ১৬ হাজার ১৫০ কোটি টাকা। এ পথে প্রতিকিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ ব্যয় ধরা হয় প্রায় ৭২ কোটি টাকা।

অপরদিকে টঙ্গী-ভৈরব হয়ে আখাউড়া পর্যন্ত ডুয়েলগেজ ডাবল লাইন নির্মাণ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে। এ রুটে প্রতি কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ ব্যয় হবে ১৮৪ কোটি টাকার বেশি। অথচ এ পথের টঙ্গী-ভৈরববাজার পর্যন্ত প্রায় ৬৪ কিলোমিটার মিটারগেজ রেলপথ গত ৭ বছর আগে নির্মাণ করা হয়।

এদিকে, ১৫ বছরে পাঁচ মন্ত্রীর হাতবদল হয়েছে রেলপথ মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ে মন্ত্রীর আসনে একের পর এক বসেছেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, ওবায়দুল কাদের, মো. মুজিবুল হক, মো. নূরুল ইসলাম সুজন ও মো. জিল্লুল হাকিম। পাঁচ মন্ত্রীর একজন নূরুল ইসলাম সুজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে গত সোমবার। বাকি তিনজন পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। এ চারজনই এখন নিশানায় আছেন। বাকি একজন মারা গেছেন। তাদের খুঁজছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। প্রতিবারই নেওয়া হয়েছে নতুন প্রকল্প। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়নি। দফায় দফায় বাড়ানো হয়েছে ব্যয়। রেলের সম্পত্তি দখল, টেন্ডার বাণিজ্য, নিয়োগ ও বদলি বাণিজ্য হয়েছে বেশুমার। প্রায় প্রতিটি খাতেই দুর্নীতি হয়েছে শত শত কোটি টাকা। দুর্নীতি দমন কমিশনও তাদের বিরুদ্ধে মাঠে নেমেছে। রেলের সর্বশেষ মন্ত্রী মো. জিল্লুল হাকিমের দুর্নীতির বিরুদ্ধে অনুসন্ধান চলছে দুদকে। মামলা আছে ওবায়দুল কাদের ও মুজিবুল হকের নামেও।

এদিকে, রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব আবদুল বাকী গণমাধ্যমকে বলেন, আমরা একাধিকবার বৈঠক করেছি। অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত মন্ত্রী, সচিব কিংবা যে কেউ জড়িত থাকুক-সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে। প্রকল্প বাস্তবায়নে দুর্নীতির মাধ্যমে সময় ও ব্যয় বৃদ্ধির বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

অন্যদিকে, রেলওয়ে উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান গণমাধ্যমকে বলেন, রেলে উন্নয়নের নামে যে অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে তা দুদক নিশ্চয়ই দেখছে। দুদকে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে। আমরা এসব দুদককে দিয়ে সহায়তা করব। রেলে যাতে এমন অনিয়ম-দুর্নীতি এবং গুরুত্বহীন প্রকল্প গ্রহণ না হয়, তা নিয়েও আমরা কাজ করছি। সবাইকে জবাবদিহির আওতায় আনা হচ্ছে।

 

ভোরের আকাশ/রন

মন্তব্য