রাজনীতিতে গরম হাওয়া

এম. সাইফুল ইসলাম
রাজনীতিতে গরম হাওয়া

জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ‘জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র’ নিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে গরম হাওয়া বইতে শুরু করেছে। দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন করে উত্তেজনা তৈরি হয়েছে। দীর্ঘদিন থেকে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন ফ্যাসিস্ট সরকার তথা স্বৈরাচারের পতন আন্দোলনে যুক্ত থাকা দলগুলোর নেতাদের মধ্যেও বিষয়টি নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে মত রয়েছে। একই দলের নেতার মধ্যেও ভিন্নমত রয়েছে বিষয়টিতে। অনেকে বলতে চাইছেন, নির্বাচিত একটি সরকার বা সংসদ ছাড়া সংবিধানের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে হাত দেওয়াটা উচিত নয়। আবার কেউ কেউ বলছেন- প্রকৃত গণতন্ত্রের স্বার্থে সৎ উদ্দেশ্যে কেউ যদি সংবিধান পরিবর্তন করতে চায় সেটি দোষের কিছু নয়।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন বা জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতা বলছেন, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের পরিবর্তে নতুন গণপ্রজাতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়তেই তাদের এই ‘জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র’ প্রকাশের উদ্যোগ। এখানে ক্ষমতার চর্চা নয় প্রকৃত অর্থে একটি অর্থবহ গণতন্ত্র দেখতে চান তারা। এছাড়া যেভাবে বারবার গণতন্ত্রকে কুক্ষিগত করা হয়েছে সেটির যেন পুনরাবৃত্তি না হয় সেটিতেই তাদের গুরুত্ব।

ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের প্রায় চার মাস পর আজ মঙ্গলবার বিকেলে জাতীয় শহীদ মিনারে ‘জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র’ প্রকাশ করতে যাচ্ছে বৈমষ্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া সংগঠনটি গত রোববার এক সংবাদ সম্মেলনে এ ঘোষণা দেয়, যা বাস্তবায়নে তাদের সহযোগিতা করছে জাতীয় নাগরিক কমিটি। আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি এবং আওয়ামী লীগের নির্বাচনি জোটে থাকা দলগুলোকে বাদ রেখে বাকি সব দলের নেতাদের শহীদ মিনারের এই কর্মসূচিতে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। তবে মঞ্চে রাজনৈতিক কোনো দলের নেতাদের রাখা হচ্ছে না। মঞ্চে থাকবেন জুলাই অভ্যুত্থানের শহীদ পরিবারের সদস্য ও আহত ব্যক্তিদের পাশাপাশি গত ৩ আগস্ট ঘোষিত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ১৫৮ সমন্বয়ক। আজকের এই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত সকল রাজনৈতিক দলের নেতারা উপস্থিত থাকবেন বলে আশা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের।

গত রোববারের ওই সংবাদ সম্মেলনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সংবাদ সম্মেলনে আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, মুজিববাদী সংবিধানকে কবরস্থ ঘোষণা করা হবে। যেখান থেকে এক দফার ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল, ঠিক সেই জায়গা থেকে মুজিববাদী ‘বাহাত্তরের সংবিধানের কবর’ রচিত হবে। আমরা প্রত্যাশা রাখছি, জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্রে নাৎসিবাদী আওয়ামী লীগকে বাংলাদেশে অপ্রাসঙ্গিক ঘোষণা করা হবে।

হাসনাত আব্দুল্লাহর ওই ঘোষণার পর বিষয়টি নিয়ে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপিসহ বড় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নানা আলোচনা শুরু হয়েছে। এই ঘোষণারপত্র পাঠ করার প্রসঙ্গটি এখন রাজনীতিতে বেশ উত্তেজনার সৃষ্টি করেছে। একইদিন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেছেন, বাহাত্তরের সংবিধান ছুড়ে ফেলে দেওয়ার কথা বললে শুনতেও খারাপ লাগে।

বিষয়টি নিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী দৈনিক ভোরের আকাশকে বলেছেন, রাষ্ট্রের কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে জনগণের। জনগণ একটি ভোটের মাধ্যমে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করবেন। নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দিয়েই একটি সংসদ গঠিত হবে। সেই সংসদ সংবিধান বা যেকোনো কিছুর পরিবর্তন করতে পারবে। তিনি বলেন, আমরা দীর্ঘদিন আন্দোলন করেছি কিন্তু গণতন্ত্রেও জন্যেই।

জামায়াতে ইসলামী সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আব্দুল হালিম বলেছেন, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে যেকোনো ব্যক্তি বা সংগঠন তার নিজস্ব মতামত প্রদান করতে পারেন। সেটি গ্রহণ বা বর্জনের বিষয়ে দেশের মানুষ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন। আগে থেকেই এ বিষয়ে কারোর সঙ্গে বিভাজনের সুযোগ নেই। ঘোষণাপত্র পাওয়ার পর দলের অবস্থান জানানো হবে বলেও জানান তিনি।

এমন পরিস্থিতিতে বিএনপির নেতাকর্মীদের মাঝে গুঞ্জন রয়েছে, এ ঘোষণাপত্র পাঠের মাধ্যমে ছাত্র আন্দোলনের নেতাদেরকে দিয়ে জামায়াত বিশেষ পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চাইছে। বিএনপি নেতাকর্মীরা গত কয়েকদিন জামায়াতের নানা নেতিবাচক বিষয়গুলোকে সামনে এনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারণা চালাচ্ছেন। গত রোববার রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী জামায়াত ইসলামী নিয়ে বেশ কড়া মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, জামায়াত কিন্তু ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের চেষ্টা করছে। এছাড়া দলটির প্রতি নানা বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি। এদিকে, জামায়াতও রিজভীর ওই বক্তব্যের কড়া প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। পাশাপাশির দলটির নেতাকর্মীরা ওই বক্তব্যের কড়া সমালোচনা করেছেন।

এদিকে, জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্রে কী থাকছে এমন প্রশ্নের জবাবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক ও বর্তমানে জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতারা বলছেন, ঘোষণাপত্রে উপনিবেশবিরোধী এবং পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এ অঞ্চলের মানুষের লড়াই-সংগ্রামের কথা উল্লেখ থাকবে। এছাড়া ’৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন ও ’২৪-এর গণঅভ্যুত্থানসহ এ দেশের মানুষের সকল আন্দোলন সংগ্রামের বিষয় উল্লেখ থাকবে। বিপ্লবীরা মনে করে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামের পর রচিত ১৯৭২ সালের সংবিধান নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা রয়েছে। যেটি বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক নেতৃত্ব, সুশীল সমাজ থেকে শুরু করে সাধারণ শিক্ষার্থীদের বক্তৃতায়ও ফুটে উঠেছে। তাই নতুন প্রজন্ম মনে করে ’৭২-এর সংবিধানের ব্যর্থতার কারণে এ দেশের গণতন্ত্র এবং সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস হয়েছে। মুজিববাদী সংবিধানের মাধ্যমে এদেশের গণমানুষের আকাক্সক্ষাকে পেছনে ফেলা হয়েছে। এছাড়া এক-এগারো সময়ে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া নিয়েও উল্লেখ থাকবে সেখানে। এছাড়া ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সরকারের সময়ে গুম, খুন ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে উল্লেখ থাকবে। জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্রে গুরুত্বের সঙ্গে স্থান পাবে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের অধিকারের ইস্যুগুলোও। একইসঙ্গে ৫ আগস্ট বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে বৈঠকে বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবির প্রসঙ্গটি গুরুত্ব সহকারে ঘোষণাপত্রে উল্লেখ থাকবে। এমন বাস্তবতায় ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে রাজপথের লড়াই-সংগ্রামে সক্রিয় থাকা রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতার আহ্বান থাকতে পারে।

বিএনপি ভাইস-চেয়ারম্যান ড. আসাদুজ্জামান রিপন দৈনিক ভোরের আকাশকে বলেন, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র যে কেউ তার মতামত তুলে ধরতে পারেন। সেটি নিয়ে আলেচনা বা নানা মতামত আসবে এটিই স্বাভাবিক।

গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম শীর্ষ নেতা ও গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেছেন, ছাত্ররা তাদের নিজের বক্তব্য তুলে ধরছেন। তবে এটা নিয়ে তাদের সব দল ও অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা করা উচিত। সবার সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে একটি জায়গায় পৌঁছানো যেতে পারে।

জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখ্য সংগঠক ও ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক সারজিস আলম দৈনিক ভোরের আকাশকে বলেন, আমরা বিপ্লবের একটিমাত্র ধাপ অতিক্রম করেছি। জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র আরও আগে ঘোষণা করার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু নানা ষড়যন্ত্রে আমরা সেটি করে উঠতে পারিনি। এর মধ্যে ঘোষণাপত্রে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল-মত, ধর্ম ও বয়সের যে মানুষের মতামত নেওয়া হচ্ছে। এটি সংশোধন, পরিমার্জন ও পরিবর্ধন করা হচ্ছে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখ্য সংগঠক আবদুল হান্নান মাসউদ বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে আমরা জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র ঘোষণা করবো। আমরা নিউ রিপাবলিক বাংলাদেশ গড়তেই এই ঘোষণাপত্র পাঠ করবো। সেটা সংবিধানে যুক্ত করে সেকেন্ড রিপাবলিক করার দায়িত্ব সরকারের।

 

ভোরের আকাশ/রন

মন্তব্য