সংকট-আস্থাহীনতায় ব্যাংক খাত নাজুক

বিশেষ প্রতিবেদক
সংকট-আস্থাহীনতায় ব্যাংক খাত নাজুক

২০২৪ সালের পুরোটা সময় ব্যাংক খাত ছিল চ্যালেঞ্জিং এবং ঘটনাবহুল। ব্যাংকিং খাতের শৃঙ্খলা, ঋণের নামে লুটপাটসহ প্রকাশ্যে আসতে থাকে নানা অনিয়ম। দেখা দেয় ডলার ও তারল্য সংকট। নতুন ঋণ অনুমোদনে বাধা, খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ার বিপরীতে তাগাদা দেওয়ার পরেও ঋণ আদায় না হওয়া ছিলো আলোচনার শীর্ষে। সাথে ছিল বৈদেশিক মুদ্রার সংকট, রিজার্ভ কমে যাওয়া, এলসি খোলা ও নিষ্পত্তিতে উভয় সংকটে পড়তে হয়েছে ব্যাংক ও গ্রাহকদের।

তারল্য ঘাটতি : তারল্য ঘাটতির কারণে চাহিদা মোতাবেক গ্রাহকদের টাকা দিতে পারেনি প্রতিষ্ঠিত ১০টি ব্যাংক। এসব ব্যাংকের চলতি হিসাবের ঘাটতি ১৮ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের। এ ব্যাংকটির ঘাটতির পরিমাণ সাত হাজার ২৬৯ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ তিন হাজার ৩৯৪ কোটি টাকার ঘাটতি রয়েছে স্যোশাল ইসলামী ব্যাংকের। এসব ব্যাংককে টাকা ছাপিয়ে টাকা ধার দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু আগের সরকারের মতো টাকা ছাপিয়ে সরকারকে বা কোনো ব্যাংককে অর্থ দেওয়া হবে না- গত আগস্টেই এমন মন্তব্য করেছিলেন গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর। তবে এমন মন্তব্যের তিন মাসের মধ্যেই সে সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। টাকা ছাপিয়ে ছয়টি দুর্বল ব্যাংককে সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকা ধার দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।

গভর্নরকে বয়কট : বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিক প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা ও অবাধ তথ্য প্রবাহ প্রকাশে বাধার প্রতিবাদে বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের বক্তব্য বয়কট করেছিলেন সাংবাদিকরা, যা দেশের আর্থিক খাতের জন্য বিরল ঘটনা। রীতি অনুযায়ী বাজেট ঘোষণার পরের দিন সংবাদ সম্মেলন করেন অর্থমন্ত্রী। সাধারণত বাজেটোত্তর এ সংবাদ সম্মেলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের। ব্যাংকখাত সংশ্লিষ্ট, মূল্যস্ফীতিসহ অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দিয়ে থাকেন তিনি। তবে এবার হয়েছে তার ব্যতিক্রম। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত সাংবাদিকরা গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারকে বয়কটের ঘোষণা দেন।

এনআরবিসির গুরুতর অনিয়ম : অনিয়ম জালিয়াতির মাধ্যমে একের পর এক অপরাধ করে তা লুকিয়ে রেখেছিলেন এনআরবিসি ব্যাংকের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা। অনিয়ম আড়াল করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে মিথ্যা তথ্য দিয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে দীর্ঘদিন ধরে বিভ্রান্ত করা হয়। অবশেষে দুর্নীতিবাজ চক্রটির বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক গোপন প্রতিবেদনে এসব তুলে ধরা হয়। ব্যাংকটির আলোচিত চেয়ারম্যান পারভেজ তমাল বিগত সরকারের প্রভাবশালীদের বলয়ে শক্ত সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় এবং তার অনুসারী কয়েকজন চিহ্নিত অপরাধীর সমন্বয়ে বিশেষ বাহিনীর মাধ্যমে কর্মকর্তা ও অংশীজনদের জিম্মি করে অপরাধ ধামাচাপা দেওয়া হতো বলে অভিযোগ ওঠে; যা দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে ধারাবাহিক প্রতিবেদন আকারে প্রকাশিত হতে থাকে।

আলোচনায় বেসিক ব্যাংক : বিপুল পরিমাণ টাকা লুটের পরও রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই বাচ্চু ছিলেন আলোচনায়। ৫৮ মামলায় অভিযোগপত্রভুক্ত করার আট মাস পরও এই আলোচিত আসামিকে গ্রেফতার করা যায়নি। তবে সেপ্টেম্বরে দুদকের করা মামলায় বেসিক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান শেখ আব্দুল হাই বাচ্চু ও তার পরিবারের চার সদস্যের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন আদালত।

ব্যাংক একীভূত করার সিদ্ধান্ত : বছরের শুরুতেই আরেকটি আলোচিত ঘটনা ছিল ব্যাংক একীভূত করার সিদ্ধান্ত। ব্যাংকখাতে গতি ও স্থিতিশীলতা ফেরাতে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে অন্য ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি বছরের এপ্রিলে ব্যাংক একীভূতকরণ সংক্রান্ত নীতমালা জারি করা হয়। এরই অংশ হিসেবে চারটি ব্যাংকের মধ্যে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সইও হয়। তবে এখনও সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন খোদ দুর্বল ও সবল প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকর্তারা।

নগদের লাইসেন্স স্থগিত : দেশে প্রথমবারের মতো গত বছরে প্রাথমিকভাবে দুটি ডিজিটাল ব্যাংকের অনুমোদন দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এ দুটি হলো- নগদ ডিজিটাল ব্যাংক পিএলসি ও কড়ি ডিজিটাল ব্যাংক পিএলসি। আর ডিজিটাল ব্যাংকের উইন্ডোর জন্য গাইডলাইন তৈরির পর ব্র্যাক ব্যাংকের বিকাশ, ব্যাংক এশিয়ার ডিজিট অল ও ডিজি ১০ ব্যাংক ডিজিটাল ব্যাংক উইন্ডো খুলতে পারবে বলে সায় দেয়। ডিজি১০ ব্যাংকটি ১০টি বাণিজ্যিক ব্যাংকের সমন্বয়ে প্রস্তাবিত ডিজিটাল ব্যাংক। নগদের ডিজিটাল ব্যাংকিং লাইসেন্স স্থগিত করে পুনরায় পর্যালোচনা করার কথা জানান গভর্নর। ফলে এটিও বছরের আর্থিকখাতের আলোচিত ইস্যুতে পরিণত হয়।

ব্যয়যোগ্য রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ : বারবার অস্বীকার করলেও অবশেষে গত জুলাইয়ের শুরুতেই নিট ইন্টারন্যাশনাল রিজার্ভ (এনআইআর) বা ব্যয়যোগ্য রিজার্ভের হিসাব স্বীকার করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই সময়ে নিট রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ১৬ দশমিক ০৩ বিলিয়ন ডলার। বর্তমানে মোট রিজার্ভ ২৪ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। আইএমএফের পরামর্শে বিপিএম-৬ হিসাবে তা ১৯ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন ডলার। আর দেশের ব্যয়যোগ রিজার্ভ প্রায় ১৫ দশমিক ১৪ বিলিয়ন ডলার। যা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফের বেঁধে দেয়া লক্ষ্য ১৫ দশমিক ৩২ বিলিয়নের চেয়ে সামান্য কম। এই রিজার্ভ নিয়েও বছর জুড়ে আলোচনা ছিলোই।

সালমান এফ রহমান ও এস আলমের পতন : সরকারের পট পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সেই সালমান এফ রহমানের পতন হয়। যাকে দরবেশ নামেও চেনেন অনেকেই। গত ১৬ বছরে দেশের ব্যাংকিং খাত এবং শেয়ারবাজার ধবংসের কারণ হিসেবে মনে করা হয় সালমান এফ রহমান, নাসা গ্রুপের কর্ণধার নজরুল ইসলাম মজুমদারসহ আরও কয়েকজনকে। ফলে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হন তারা।

ন্যাশনাল ও ইসলামী ব্যাংক : ঋণ জালিয়াতি ও নানা অনিয়মে ধুঁকতে থাকা প্রথম প্রজন্মের ন্যাশনাল ব্যাংক বছরজুড়ে আলোচনায় তুঙ্গে থাকে। সিকদার গ্রুপমুক্ত হয়ে ব্যাংকটির দখল চলে যায় এস আলম গ্রুপের হাতে। এর পর গত ৫ আগস্টের পট পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এস আলম গ্রুপ চলে যেতে বাধ্য হয়। ব্যাংকটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি ব্যবসায়ী আব্দুল আউয়াল মিন্টু। তার বেশ কিছু উদ্যোগে নতুন করে ঋণ আদায় শুরু হয়েছে। একইভাবে ইসলামী ব্যাংককে এস আলমের দখলমুক্ত করা হয়। বিএনপির এক নেতা প্রকাশ্যে গুলি করে এস আলমের দখলে রাখতে ব্যর্থ হয়। দায়িত্ব ফিরে পান সাবেক কর্মকর্তারা। ধুঁকতে থাকা ব্যাংকটির নতুন বোর্ড আবারও চাঙ্গা করে তুলেছে এ ব্যাংকটিকে।

অস্থির ডলার বাজার : আসন্ন রমজান মাসকে কেন্দ্র করে আমদানি পণ্যের চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানিতে এ চাহিদা বেড়েছে। তবে এর বিপরীতে ডলারের জোগান কম। এ কারণেই অতিরিক্ত চাহিদা পূরণের জন্য ব্যাংকগুলো ১২০ টাকা ঘোষিত দরের চেয়ে কমপক্ষে আট টাকা বেশি দিয়ে রেমিট্যান্স কিনছে। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে খোলাবাজারেও।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ১৩ কর্মকর্তাকে তলব : এস আলম গ্রুপ ও তার সহযোগীদের হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ অনুসন্ধানে বাংলাদেশ ব্যাংকের ১৩ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করে দুদক। চিঠিতে যাদের তলব করা হয়- বাংলাদেশ ব্যাংক পরিদর্শন বিভাগের যুগ্ম পরিচালক সুনির্বাণ বড়ুয়া, অনিক তালুকদার, অতিরিক্ত পরিচালক শংকর কান্তি ঘোষ, ছলিমা বেগম, উপপরিচালক মো. জুবাইর হোসেন ও রুবেল চৌধুরী, বাংলাদেশ ব্যাংক পরিদর্শন বিভাগের যুগ্ম পরিচালক সৈয়দ মু. আরিফ-উন-নবী, অতিরিক্ত পরিচালক মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন, মো. শোয়েব চৌধুরী, মো. মঞ্জুর হোসেন খান ও মো. আব্দুর রউফ, উপ-পরিচালক লেনিন আজাদ পলাশ এবং পরিচালক মো. সরোয়ার হোসাইন। এর আগে একই ঘটনায় ইসলামী ব্যাংকের ২৩ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করেছিল সংস্থাটি।

শৃঙ্খলা ফেরেনি : বাংলাদেশ ব্যাংক রেগুলেটরি প্রতিষ্ঠান হিসেবে ঠিকমতো দেখভাল করতে পারছে না। এতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে অনেক। রাতারাতি হয়ত এ খাতে পরিবর্তন আসবে না। তবে আশার বাণীও রয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর আর্থিক খাতে নানা সংস্কারের পাশাপাশি দুর্নীতির অনুসন্ধানে ও নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এদিকে চলতি মাস ডিসেম্বরের প্রথম ২১ দিনে দেশে বৈধপথে ২০০ কোটি মার্কিন বা দুই বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিট্যান্স এসেছে। দেশীয় মুদ্রায় যার পরিমাণ ২৪ হাজার কোটি টাকার বেশি (প্রতি ডলার ১২০ টাকা ধরে)। দৈনিক গড়ে রেমিট্যান্স এসেছে ৯ কোটি ৫২ লাখ ডলার বা এক হাজার ১৪২ কোটি টাকা। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই থেকে নভেম্বর) ১১৩ কোটি ৭৩ লাখ ডলার রেমিট্যান্স এসেছে দেশে। এর মধ্যে অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে দেশে রেমিট্যান্স এসেছে ১৯১ কোটি ৩৭ লাখ ৭০ হাজার ডলার, আগস্টে ২২২ কোটি ৪১ লাখ ৫০ হাজার ডলার, সেপ্টেম্বরে এসেছে ২৪০ কোটি ৪৭ লাখ ৯০ হাজার, অক্টোবরে ২৪০ কোটি (২ দশমিক ৪০ বিলিয়ন) ডলার এবং সবশেষ নভেম্বর মাসে এসেছে ২২০ কোটি (২ দশমিক ২০ বিলিয়ন) মার্কিন ডলারের রেমিট্যান্স।

 

ভোরের আকাশ/রন

মন্তব্য