ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের চার মাস হতে চলছে। ক্যালেন্ডারের পাতায় নতুন আরও একটি বছর যুক্ত হলো। সরকারের পতনের পর যে চ্যালেঞ্জ নিয়ে নোবেল জয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যাত্রা শুরু করেছিল সেই চ্যালেঞ্জ সামনের দিনগুলোতে আরও বাড়বে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, নতুন বছরে সরকারকে অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। এর মধ্যে রাজনীতি, নির্বাচন, কূটনৈতিক, অর্থনীতি-মোটা দাগে এই চারটি চ্যালেঞ্জ সরকারকে সামাল দিতে হবে।
চলতি বছরেই ঘোষণা হতে পারে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সম্ভাব্য সময়। এই নির্বাচনই সরাসরি প্রভাব রাখবে রাজনৈতিক পরিস্থিতি, অর্থনীতি আর কূটনৈতিক সম্পর্কের ওপর। রাজনীতি ও কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেছেন, বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে যে মতভেদ দেখা যাচ্ছে সামনে বছর তা আরও ঘনীভূত হতে পারে। বিশেষ করে নির্বাচন এগিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে এই মতভেদ সংঘাতে রূপ নিতে পারে। ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার দল আওয়ামী লীগের নির্বাচনে অংশ নেওয়া না নেওয়াও একটি বড় ফ্যাক্টর হয়ে উঠতে পারে। একই সঙ্গে শেখ হাসিনার ভারতে অবস্থানের প্রভাব পড়তে পারে ভারত-বাংলাদেশের কূটনীতিক সম্পর্কেও। এছাড়া বাংলাদেশের সীমান্তঘেঁষা মিয়ানমারের দুটি রাজ্য আরাকান আর্মির দখলে যাওয়ায় দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের রূপ কী হবে, তা নিয়েও বেশ জটিলতায় পড়তে হতে পারে বাংলাদেশকে। পাশাপাশি শেখ হাসিনা সরকারের পতনের দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, প্রশাসনে বিশৃঙ্খলা এবং মব সংস্কৃতির মতো বিষয়গুলো যে প্রকট আকার ধারণ করেছে, সেটাকে শৃঙ্খলায় ফেরানোও দেশের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হবে। তবে সবচেয়ে বড় যে চ্যালেঞ্জেটির মুখোমুখি বাংলাদেশকে হতে হবে, তা হলো অর্থনীতি। মূল্যস্ফীতি, টাকার বিপরীতে বাড়তে থাকা ডলারের দাম এবং আর্থিক খাতে যে সংকট গত বছর দেখা গেছে, তা পরবর্তী বছরেও বাংলাদেশকে বেশ ভোগাবে বলেই মত বিশ্লেষকদের।
নির্বাচন ও রাজনীতিনতুন বছর অর্থাৎ ২০২৫ সাল হতে পারে বাংলাদেশের জন্য নির্বাচনের বছর। ফলে নতুন বছরে বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হতে পারে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা। গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের চার মাসের মাথায় নির্বাচন ও সংস্কার ইস্যুতে ছাত্র নেতৃত্বের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর নানা ধরনের মতবিভেদ দেখা গেছে। বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে এই মতভেদ যদি আরও প্রকট হয় তবে সেটা সংকটের জন্ম দিতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করছেন বিশ্লেষকরা।
‘জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র’ দেওয়া নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে শুরু হওয়া আলোচনা প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সাব্বির আহমেদ বলেন, ‘বিপ্লব বা গণঅভ্যুত্থানের পার্টিসিপেন্ট শুধু ছাত্ররা না, সেখানে বিএনপি-জামায়াত আছে। তারা (বিএনপি ও জামায়াত) সংবিধানের অনুসারী, বিপ্লবের না। সুতরাং এখানে ডিফারেন্সেস অব অপিনিয়ন (মতভেদ) থাকছে। আর নির্বাচনের সময় যত ঘনিয়ে আসবে, এই দুইয়ের মধ্যে একটা সাংঘর্ষিক অবস্থান তৈরি হতে পারে।’
তাছাড়া রাজনৈতিক দলগুলো আগের মতোই পরিবারতন্ত্রের মধ্যে আটকে থাকবে, নাকি নিজেদের মধ্যে গণতন্ত্রের চর্চা করবে, সে বিষয়টিও রাজনীতিতে চ্যালেঞ্জ হয়ে আসতে পারে।
আর গণতন্ত্রে উত্তরণের পথে নির্বাচনকে যেহেতু একটি অন্যতম প্রধান মাধ্যমে হিসেবে দেখা হয়, সেখানে নির্বাচন আয়োজনে আন্তর্জাতিক একটি চাপ থাকতে পারে বলেও মনে করা হচ্ছে।
এছাড়াও বাংলাদেশের জন্য ২০২৫-এর একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হতে পারে আওয়ামী লীগ। নির্বাচনে দলটির অংশগ্রহণ থাকা বা না থাকা নিয়ে জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে।
অধ্যাপক আহমেদ বলেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জিং বিষয় হবে অংশগ্রহণমূলক স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন করা। যদি আপনি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কথা বলেন তাহলে আপানকে ভাবতে হবে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে আসতে পারবে কী না। এই প্রশ্নের একটা অসমাধান বের করতে হবে এবং এই সমাধানটা খানিকটা চ্যালেঞ্জিং।’
কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জকেবল দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটেই না, দেশের বাইরের কূটনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও চ্যালেঞ্জিং ফ্যাক্টর হয়ে উঠতে পারে আওয়ামী লীগ। বিশেষ করে প্রতিবেশী দেশ ভারতে ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অবস্থানের কারণে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কেও পড়তে পারে বড় প্রভাব।
এ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক আমেনা মহসিন বলেন,‘শেখ হাসিনা তো ওখানে বসে নেই। ওখানে তিনি নানা ধরনের রাজনীতির সঙ্গে ইনভলভড আছেন, তাই না? যারা চলে গেছে, তারা তো চুপ থাকবে না। আর দেশের বাইরেও তাদের মিত্ররা আছে।’
বিশেষ করে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু ইস্যু এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতি ভারত নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করবে এবং সেখানে টানাপড়েন থাকবে বলেও মনে করেন তিনি।
অন্যদিকে, অন্তর্বর্তী সরকার থাকাকালীন ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক স্বাভাবিক করা সম্ভব হবে কী না সে বিষয়ে সন্দেহ রয়েছে অধ্যাপক সাব্বির আহমেদের। তিনি বলেন,‘শেখ হাসিনার ভারতে আশ্রয়ের কারণে বর্তমান সরকারের জন্য সম্পর্ক স্বাভাবিক করাটা অস্বস্তিকর হতে পারে। শেখ হাসিনার অন্যায়ের বিচার করতে তারা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, যেখান থেকে তারা সরতে পারবে না, আবার ভারতের সঙ্গে সম্পর্কটা তারা এমন জায়গায়ও নিতে পারবে না, যাতে আমাদের দেশ সামগ্রিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।’
সেক্ষেত্রে, নির্বাচিত সরকার না আসা পর্যন্ত পর্যন্ত ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে বাংলাদেশকে বেগ পেতে হবে।
আবার অনেকটা একই দৃশ্যপট আরেক প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারের ক্ষেত্রেও। শুরু থেকেই বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতিতে মিয়ানমারকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়নি। অথচ বাংলাদেশের সংকটের তালিকায় বেশ উপরেই জায়গা করে নেবে রোহিঙ্গা ইস্যুটি।
তার ওপর বাংলাদেশের সঙ্গে সীমান্তবর্তী এলাকাগুলো আরাকান আর্মি দখলে নেওয়ায় নির্বাচিত সরকার ছাড়া দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের গতিপথ নির্ধারণ বেশ কঠিন হবে বলেই মত বিশ্লেষকদের।
অধ্যাপক মহসিন বলেন, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দিকে আমাদের ভীষণভাবে মনোযোগ দিতে হবে এবং মিয়ানমারের ক্ষেত্রে দেশটির মধ্যে থাকা বিভিন্ন ফ্র্যাকশনের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে এগয়ে যেতে হবে।
একই সঙ্গে বঙ্গোপসাগরকে কেন্দ্র করে চলমান ভূ-রাজনীতিতে নিজেদের দৃঢ় অবস্থান ধরে রাখাও বাংলাদেশের জন্য চ্যালেঞ্জিং হতে পারে।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি৫ আগস্টের পর থেকে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটেছে। ছিনতাই, রাহাজানি, লুটপাট, চাঁদাবাজি বাড়ার খবর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তরফেই এখন স্বীকার করে নেওয়া হচ্ছে। ভঙ্গুর অবস্থা থেকে খুব একটা ঘুরে দাঁড়াতে দেখা যায়নি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও। উত্থান ঘটেছে মব সংস্কৃতির। বেড়েছে প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলা। এসব বিশৃঙ্খলাকে ২০২৫ সালে শৃঙ্খলায় ফিরিয়ে আনাও একটি বড় চ্যালেঞ্জ হবে বলেই মনে করা হচ্ছে।
অধ্যাপক মহসিন বলেন, ২০২৪ সালে এক ধরনের চরম বিশৃঙ্খলা কিন্তু আমরা দেখেছি। ওই শৃঙ্খলাটা ফেরত আনা কিন্তু বড় ব্যাপার থাকবে। কিন্তু শৃঙ্খলার নামে আবার কারো শ্বাসরুদ্ধ করে দিচ্ছি, সেটা হবে না। এগুলোর মধ্যে ভারসাম্য আনার পাশাপাশি মানবাধিকার পরিস্থিতির দিকেও নজর দেওয়ার কথা বলেন এই বিশ্লেষক।
অধ্যাপক সাব্বির আহমেদ বলছেন, জুলাই বিপ্লবে অনেকগুলো পক্ষ অংশীদার হলেও তাদের স্বার্থের সমীকরণ আলাদা। এটা সমাধান হয়নি। উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো বিভিন্ন জায়গায়, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে দখল করে বসে আছে। সেই পদগুলোকে তারা তাদের করায়ত্ত করে নিয়েছে। এর মাধ্যমে তারা তাদের দলীয় স্বার্থকে সুসংহত করার চেষ্টা করছে।
তিনি বলছেন, বহু জায়গায় আগের দলের আওয়ামী লীগের স্থানে নতুন দল চাঁদাবাজিতে লিপ্ত হয়ে পড়েছে। কিন্তু সে বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না।
অর্থনীতির যত চ্যালেঞ্জবাংলাদেশের জন্য ২০২৫ সালে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জিং ফ্যাক্টর হতে পারে অর্থনীতি, যা আগের বছরও প্রকট ছিল। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর আগের সরকারের আমলে আর্থিক খাতে যে পরিমাণ দুর্নীতির উন্মোচিত হয়েছে, তা থেকে বেরিয়ে নতুন করে দেশের অর্থনীতিকে গঠন প্রক্রিয়া বেশ কঠিন ও সময়সাপেক্ষ হবে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদেরা।
ইতোমধ্যেই ২০২৪-২৫ অর্হবছরে বাংলাদেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার সাড়ে চার শতাংশ হবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফ। আর সার্বিক মূল্যস্ফীতি হবে নয় দশমিক সাত শতাংশ।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, অনবরত বাড়তে থাকা মূল্যস্ফীতি এবং ডলারের সঙ্গে টাকার বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখতে না পারায় ২০২৫ সালের জন্য ভালো ইঙ্গিত দেখা যাচ্ছে না।
অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ বলেন,‘মূল্যস্ফীতি অব্যাহত আছে, আর একে কিছুতেই বাগ মানানো যাচ্ছে না। এটা একটা বড় সমস্যা। আর ডলারের সঙ্গে আমাদের টাকার যে বিনিময় হার - সেটা ক্রমাগত উপরের দিকে যাচ্ছে এবং সেটাকে একটা জায়গায় স্থিতিশীল করা যাচ্ছে না। কোনোভাবেই এর অবস্থা ২০-২২ বিলিয়নের ওপরে যাচ্ছে না উল্লেখ করে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, আমাদের একটা চ্যালেঞ্জ হচ্ছে ভঙ্গুর রিজার্ভের অবস্থা এটাকে কীভাবে পরিবর্তন করা যায়। সেটা যদি না করা যায় তাহলে এক্সচেঞ্জ রেটের ইনস্ট্যাবিলিটি সেটা অব্যাহত থাকবে, সেটা আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবো না। সেক্ষেত্রে রিজার্ভ বাড়াতে হলে রেমিট্যান্সের দিকে নজর দেওয়ার পরামর্শ দেন অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ।
দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণসরকার সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে, নতুন বছরের প্রথম চ্যালেঞ্জ দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে যে সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে নতুন বছরে এগোতে হবে, এর মধ্যে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ-জনসাধারণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে নিত্য-পণ্যের দাম নিয়ে আসা। একই সঙ্গে বাজার ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন ছাড়া সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে নিত্যপণ্যের দাম নিয়ে আসা কঠিন বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। তারা মনে করেন, বাজার ব্যবস্থাপনার প্রথম শর্ত বাজারে মনোপলি ব্যবসা পরিহার করতে হবে। সিন্ডিকেটের বৃত্ত ভেঙে বাজারে পণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিক করতে হবে।
ভোরের আকাশ/রন
মন্তব্য