রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক অস্থির

সাজেদা হক
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক অস্থির

পদ না থাকলেও রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সোনালী ব্যাংক একযোগে ২ হাজার ২০০ কর্মকর্তাকে ঢালাও পদোন্নতি দিয়েছে। অগ্রণী ব্যাংক পদোন্নতি দিয়েছে ৩ হাজার ৮৪ জনকে। জনতা ও রূপালী ব্যাংকেও একইভাবে পদোন্নতির দাবি উঠেছে। একদিকে উচ্চ খেলাপি ঋণ এবং মূলধন ঘাটতির মতো সমস্যা তো রয়েছেই। অন্যদিকে রয়েছে ঢালাও পদোন্নতির ব্যয়ের চাপ। ফলে ব্যাংকের খরচ বাড়বে। এছাড়া যথাযথ প্রক্রিয়া ছাড়া পদোন্নতি দিলে ভালো কাজ করা কর্মকর্তাদের অনেকেই নিরুৎসাহিত হবেন বলে মনে করছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।

সূত্রগুলো বলছে, রাষ্ট্রীয় মালিকানার ব্যাংকগুলোর পরিধি বিবেচনায় গত সরকারের সময়ে সব ব্যাংকের নতুন অর্গানোগ্রাম অনুমোদন করে অর্থ মন্ত্রণালয়। এতে প্রতিটি ব্যাংকে অনেক নতুন পদ সৃষ্টি হয়। তবে সরকার পরিবর্তনের পর নির্ধারিত পদ, মেধা বা এসিআরসহ অন্য কোনো বিষয় বিবেচনায় না নিয়ে ঢালাও পদোন্নতি চাচ্ছে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একটি অংশ। নির্বাহী পদের প্রথম ধাপ সহকারী ব্যবস্থাপক পদে পদোন্নতি দিলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিচের সব পদে সমসংখ্যক কর্মী পদোন্নতি পেয়ে যান।

কর্মকর্তাদের দাবি মেনে ২৩ ডিসেম্বর সোনালী ব্যাংক একযোগে ২ হাজার ২০০ কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দিয়েছে। ২৪ ডিসেম্বর ঢালাও পদোন্নতির দাবিতে অগ্রণী ব্যাংকের কর্মকর্তারা পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের ঘেরাও করেন। ব্যাংকটির চেয়ারম্যান প্রথমে তাতে নারাজি ছিলেন। শেষ পর্যন্ত গত ২৯ ডিসেম্ববর রেকর্ড সংখ্যক ৩ হাজার ৮৪ জনকে পদোন্নতি দিয়েছেন। একই দাবিতে জনতা ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের সামনে কয়েক দিন ধরে আন্দোলন চলছে। সম্প্রতি ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের সভায় ২০১৯ সালের পর পদোন্নতি না পাওয়া সবাইকে একযোগে পদোন্নতি দেওয়ার একটি প্রস্তাব ওঠে। তবে কর্মকর্তাদের মধ্যে দ্বিধাবিভক্তির কারণে শেষ পর্যন্ত পুরো বিষয়টি ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। রূপালী ব্যাংকেও একইভাবে পদোন্নতির আয়োজন চলছে। আর এসব ব্যাংকের পদোন্নতি শেষ হলে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট, বেসিক, বাংলাদেশ কৃষি, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকেও পদোন্নতির চাপ তৈরি হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত জুন পর্যন্ত ব্যাংক খাতে মোট কর্মী রয়েছেন ২ লাখ ৮ হাজার। এর মধ্যে রাষ্ট্রীয় মালিকানার বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কর্মী সংখ্যা ৪৯ হাজার ১৮৩ জন। বিশেষায়িত তিন ব্যাংকে রয়েছেন ১৩ হাজার ২০৪ জন। বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে ১ লাখ ৪১ হাজার ৫০৭ জন। আর বিদেশি ব্যাংকে আছেন ৪ হাজার ৭২ জন।

জনতা ব্যাংকের একজন পরিচালক একজন সাংবাদিককে বলেন, বৈষম্যের নামে ব্যাংক খাতকে অস্থির করার পাঁয়তারা চলছে। জনতা ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা খুবই নাজুক। পরিস্থিতি উত্তরণের জন্য আলোচনা না করে সবাই নিজের পদ-পদবির পেছনে ছুটছেন। তিনি বলেন, জনতা ব্যাংক এখন বড় ধরনের লোকসানে পড়েছে। আমানত পাচ্ছে না বললেই চলে। যে কারণে অন্য ব্যাংক থেকে ধার করে দৈনন্দিন কার্যক্রম চালাতে হচ্ছে। এ রকম অবস্থার মধ্যে ঢালাও পদোন্নতি দিলে ব্যাংকটি আরও সংকটে পড়ে যাবে।

অগ্রণী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের ঘেরাওয়ের পর গত ২৬ ডিসেম্বর চেয়ারম্যান সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, বিগত সরকারের সময়ে কেউ পদোন্নতি বঞ্চিত হলে, তাদের পদোন্নতি দেওয়ার পক্ষে তিনি। কিন্তু পদোন্নতির একটি নিয়ম আছে। ঢালাও পদোন্নতি দিলে যারা ভালো কাজ করেন, তারা নিরুৎসাহিত হবেন। যে কারণে একটি নিয়ম মেনে পদোন্নতি দিতে হবে।

জানা গেছে, রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলোতে চলমান আন্দোলনে বিএনপি-জামায়াতপন্থি কর্মকর্তাদের বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা সামনে থাকলেও আন্দোলনে অংশ নেওয়া অনেকেই ২০০৯ সালের পর নিয়োগ পাওয়া। গত সরকারের সময়ে নিয়মিত পদোন্নতি পেয়েছেন এমন অনেকেই এখন বৈষম্যের শিকার দাবি করে সুপারনিউমারারি পদোন্নতি চাচ্ছেন।

ব্যাংক খাতসংশ্লিষ্টরা জানান, ঢালাও পদোন্নতি হলে এখনকার মতো আর বিভিন্ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের চাপ থাকবে না। ভালো কাজের মাধ্যমে নিজেদের এগিয়ে রাখার প্রতিযোগিতা থাকবে না। ঝুঁকি নিয়ে শাখা ব্যবস্থাপকের দায়িত্ব পালন করতে আগ্রহী হবেন না। এজিএম ও তদূর্ধ্ব নির্বাহী পদ বিবেচনায় তারা গাড়ি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য টাকা পান। আবার সুদবিহীন ৩০ লাখ টাকা গাড়ি কেনার ঋণ দেওয়া হয়। এই ৩০ লাখ টাকা ঋণের ওপর প্রতি মাসে ১০ শতাংশ হারে অবচয় সুবিধা পান কর্মকর্তারা। ঢালাও পদোন্নতির ফলে ব্যাংকের খরচ অনেক বাড়বে।

জানা গেছে, সোনালী ও অগ্রণী ব্যাংকে এমন অনেকেই পদোন্নতি পেয়েছেন, বিভিন্ন অনিয়মে অভিযুক্ত হয়ে যাদের ‘সাসপেন্ড’ করা হয়েছিল কিংবা ইনক্রিমেন্ট ডাউনসহ বিভিন্ন শাস্তি দেওয়া হয়েছিল। আর সোনালী, অগ্রণী ব্যাংকের আদলে জনতা ও রূপালী ব্যাংকেও পদোন্নতির জন্য যারা আন্দোলনের সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তাদের অনেকেই বিভিন্ন অনিয়মের মাধ্যমে নিয়োগ পেয়েছেন।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বিদ্যমান ব্যবস্থায় রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের পদোন্নতিতে বড় ধরনের বৈষম্য করার সুযোগ কম। কেননা প্রতিটি ধাপে পদোন্নতি দেওয়া হয় নির্দিষ্ট কিছু মার্কিংয়ের ভিত্তিতে। পদোন্নতি দেওয়ার ক্ষেত্রে একজন কর্মকর্তার সর্বশেষ পাঁচ বছরের এসিআর, চাকরির বয়সকাল, শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং ব্যাংকিং ডিপ্লোমা বিবেচনায় নেওয়া হয়। ব্যাংকের নির্বাহী পদের প্রথম পর্যায় হিসেবে বিবেচিত সহকারী ব্যবস্থাপক (এজিএম) এবং তদূর্ধ্ব পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে এসবের পাশাপাশি মৌখিক পরীক্ষা নেওয়া হয়। সেখানে তার উপস্থাপনাসহ বিভিন্ন বিষয়ের ওপর নম্বর দেওয়া হয়।

এদিকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক ব্যাংকের মানবসম্পদের দায়িত্বে থাকা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানান, সাধারণভাবে প্রতিবছর অবসর কিংবা অন্য কারণে পদ খালি হওয়া সাপেক্ষে পদোন্নতি দেওয়া হয়। ব্যাংকের পরিধি বৃদ্ধির আলোকে পদের সংখ্যা বাড়ানো হয়। তবে পদ খালি না হলে পদোন্নতি দেওয়া হয় না। বিগত সরকারের সময়ে ব্যাংক খাতে বিভিন্ন অনিয়ম হলেও রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলোর পদোন্নতির ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট একটি নীতিমালা অনুসরণ করা হয়েছে। কিন্তু এখন তা মানা হচ্ছে না বলেও জানিয়েছেন তারা।

গত সরকারের সময়ে পদোন্নতিতে ‘বৈষম্যের শিকার’ হয়েছেন- এমন যুক্তি দিয়ে ঢালাও পদোন্নতি চাচ্ছে সরকারি ব্যাংকগুলোর কর্মীদের একটি অংশ। তারা আন্দোলন করছেন। দল বেঁধে কর্তৃপক্ষের ওপর চাপ তৈরি করছেন। সাম্প্রতিক সময়ে প্রায়ই এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। এতে এসব ব্যাংকে এক ধরনের অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে।

 

ভোরের আকাশ/রন

মন্তব্য