তীব্র গ্যাস সংকট অতীষ্ঠ নগরবাসী

শিপংকর শীল
তীব্র গ্যাস সংকট 
অতীষ্ঠ নগরবাসী

রাজধানীর গুলশান থানাধীন কালাচাঁদপুর এলাকার বাসিন্দা মো. সাইফুদ্দিন মিয়া। পাঁচ সদস্যের পরিবার। প্রতিদিন রাত ১০টা থেকে পরদিন সকাল ৭টা পর্যন্ত স্বাভাবিক থাকে গ্যাসের চাপ। সকাল ৮টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত থাকে না গ্যাসের চাপ। সকাল ৭টার মধ্যে রান্না শেষ করতে না পারলেই বেছে নিতে হয় বিকল্প ব্যবস্থা। এভাবে শুধু কালাচাঁদপুরের সাইদ্দিনের পরিবার নয়, পুরো রাজধানীবাসীই এমন গ্যাস সংকটে ভুগছে। গ্যাস লাইনের বিলের পাশাপাশি ইলেকট্রিক কুকার বা সিলিন্ডারের বিলও গুণতে হচ্ছে নগরবাসীকে।

রাজধানীর মগবাজারের দিলুরোডের ৩৭৪/১ হোল্ডিংয়ের বাসায় বসবাস করে সাংবাদিক নিখিল মানখিনের চার সদস্যের পরিবার। তিনি ভোরের আকাশকে জানান, সকাল ৭টার মধ্যে রান্না শেষ করতে না পারলেই ইলেকট্রিক কুকার ব্যবহার করতে হচ্ছে। এতে প্রতি মাসে গ্যাস বিলের পাশাপাশি বাড়তি এক হাজার টাকার বিদ্যুৎ বিল দিতে হচ্ছে। শুধু তাই নয়, ইলেকট্রিক কুকারে সব ধরনের তরকারি রান্না করাটাও বেশ ঝুঁকিপূর্ণ।

দীর্ঘদিন ধরে গ্যাস সংকটে বেশ ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ফার্মগেটের তেজকুনিপাড়ার বাসিন্দা সুপ্তি রায়। তিনি ভোরের আকাশকে বলেন, অভিযোগ দিয়েও গ্যাস সংকট থেকে রেহাই পাচ্ছে না এলাকাবাসী। সম্প্রতি গ্যাসের চাপ অস্বাভাবিকভাবে কমে গেছে। প্রতিদিন সকাল সাড়ে ৭টা পর্যন্ত মাঝারি ধরনের চাপ থাকে। তারপর চাপ কমে গিয়ে হয়ে যায় নিভুনিভু। বিকাল ৩টা পর্যন্ত একেবারে গ্যাস থাকে না। বিকাল চারটায় গ্যাস থাকলেও এতটাই স্বল্প চাপ যে, রান্না করার অবস্থা থাকে না। গ্যাসের স্বাভাবিক চাপ পেতে রাত ১০টা পর্যন্ত অপেক্ষায় থাকতে হয় বলে জানান সুপ্তি রায়।

ধানমন্ডি আবাহনী মাঠের পেছনের এলাকার বাসিন্দা মো. রাসেল বলেন, গত নভেম্বর থেকে সমস্যা বেড়েছে। ভোর থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত লাইনের গ্যাসে রান্নাই করা যায় না। ভাসানটেক পুনর্বাসন প্রকল্পের বাসিন্দাদের একই অভিজ্ঞতা। দিনের বেশির ভাগ সময় গ্যাসের সরবরাহ থাকে না। শীত শুরুর পর থেকেই পর্যাপ্ত গ্যাসের সরবরাহ নেই। সেখানকার বাসিন্দারা সিলিন্ডার গ্যাস ও ইলেকট্রিক চুলায় রান্নাবান্না করছেন। শ্যামলী এলাকার বাসিন্দা নিপা আক্তার বলেন, তিন-চার মাস ধরে তাদের লাইনে গ্যাস নেই। আজিমপুরের বাসিন্দা পল্লবী সরকার জানান, আগে দিনের বেলায় গ্যাসের চাপ কম থাকত। এখন ভোর থেকেই গ্যাস থাকে না। ফলে দিনের রান্নাগুলো ভোরের আগেই শেষ করতে হয়। বাসাভাড়ার সঙ্গে গ্যাসের বিলও দিতে হয়। এর চেয়ে বরং যারা সিলিন্ডার গ্যাসের বাসায় ভাড়া থাকেন, তারাই ভালো আছেন।

একই চিত্র পূর্ব রামপুরা এলাকায়ও। পুর্ব রামপুরার বাসিন্দা লাবলী বেগম বলেন, সন্ধ্যা সাতটা- আটটার আগে গ্যাসের আলামত মিলে না। প্রতিদিন বেশিরভাগ পরিবারকে রাতের বেলা না খেয়ে থাকতে হয় বলে জানান লাবলী বেগম।

রাজধানীর বেলী রোডের বাসিন্দা চাকরিজীবী মনির হোসেন জানান, গ্যাস থাকে না বললেই চলে। কিন্তু প্রতি মাসে বিল ঠিকই দিতে হয়। আবার রান্নার জন্য ইলেকট্রিক চুলা ব্যবহার করায় মাসে প্রায় ১৫০০ টাকা অতিরিক্ত বিদ্যুৎ বিল দিতে হয়। এ টাকা কে দেবে। প্রতি মাসে বাড়তি টাকা খরচ করায় অন্য খাতে টান পড়ছে।

এদিকে,গত বৃহস্পতিবার পেট্রোবাংলার প্রতিবেদনে দেখা যায়, এদিন সারাদেশে ২৫০৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ হয়েছে; যা এক সপ্তাহ আগের যেকোনো দিনের চেয়েও অন্তত ৪০০ মিলিয়ন ঘনফুট কম। এদিন সাগরের এলএনজির ভাসমান টার্মিনাল থেকে এসেছে ৫৭৪ মিলিয়ন ঘনফুট। যদিও সেখান থেকে ১১৬৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহের সক্ষমতা রয়েছে।

মহেশখালীর একটি টার্মিনাল মেরামতের জন্য সেটি ৭২ ঘণ্টা বা তিন দিন বন্ধ রাখা হবে বলে আগেই ঘোষণা করেছে পেট্রোবাংলা। ঢাকা অঞ্চলের গ্যাস সরবরাহে নিয়োজিত তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহ নেওয়াজ পারভেজ বলেন, তিতাস এলাকায় প্রায় ১৪০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হয়। টার্মিনাল মেরামতের কারণে তা ২০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস কমে এসেছে। সে কারণে কিছু এলাকায় সংকট তীব্র হয়েছে। ঢাকায় গ্যাসের সমস্যা তো বহুদিনের। কিছু এলাকায় চাহিদা মত গ্যাস সরবরাহ করা যাচ্ছে না। আবার কিছু এলাকায় লাইনে সমস্যা আছে। ফলে বেশি চাপে গ্যাস দেওয়া যায় না। আমরা একেকটি অঞ্চল ধরে লাইন মেরামতের চেষ্টা করছি।

সারাদেশে ৭২ ঘণ্টা গ্যাসের স্বল্প চাপ থাকবে : মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ কাজের জন্য মহেশখালীতে এক্সিলারেট এনার্জি পরিচালিত এলএনজি ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল (এফএসআরইউ) বন্ধ থাকবে আগামী ৪ দিন। ফলে চাহিদা অনুযায়ী গ্যাসের সরবরাহ না থাকার কারণে সারাদেশে গ্যাসের স্বল্প চাপ থাকবে।

গত ৩১ ডিসেম্বর এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানায় পেট্রোবাংলা। এতে বলা হয়, ১ থেকে ৪ জানুয়ারি সকাল ৯টা পর্যন্ত ৭২ ঘণ্টা গ্যাসের চাপ কম থাকবে। মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ কাজের জন্য মহেশখালীস্থ এক্সিলারেট এনার্জি পরিচালিত এলএনজি এফএসআরইউ থেকে ৭২ ঘণ্টা আরএলএনজি সরবরাহ বন্ধ থাকবে। এ সময়কালে অপর এফফএসআরইউ (এমএলএনজি) দিয়ে দৈনিক প্রায় ৫৭০-৫৮০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ অব্যাহত থাকবে। ফলে বিদ্যুৎ খাতে দৈনিক প্রায় ১৫০-১৮০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ হ্রাস পাবে। এছাড়াও অন্যান্য খাতে প্রায় দৈনিক প্রায় ৫০-৭০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ হ্রাস পাওয়ার কারণে দেশের কোন কোন এলাকায় গ্যাসের স্বল্প চাপ বিরাজ করবে। জনসাধারণের এ সাময়িক অসুবিধার জন্য কর্তৃপক্ষ আন্তরিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করছে।

 

ভোরের আকাশ/মি

মন্তব্য