কৃষকের লাভের টাকা মধ্যস্বত্বভোগীর পকেটে

নিখিল মানখিন
কৃষকের লাভের টাকা মধ্যস্বত্বভোগীর পকেটে

শাক-সবজির দাম নিয়ে কৃষকের মাথায় হাত পড়লেও ফুরফুরে মেজাজে মধ্যস্বত্বভোগীরা। কৃষকদের লাভের টাকা চলে যাচ্ছে তাদের পকেটে। দেশের উত্তরের জেলাগুলোতে কৃষক পর্যায়ে ফুলকপি, বাঁধাকপি আর মুলার দাম কেজি প্রতি দুই থেকে থেকে আড়াই টাকায় নেমেছে। কিন্তু হাত বদলে ঢাকার বাজারগুলোতে সেই সবজি বিক্রি হচ্ছে ২০ থেকে ২৫ টাকায়। চাষের খরচ উঠে না আসায় দুশ্চিন্তার ভাঁজ কৃষকদের কপালে। আর ঢাকায় ক্রেতার ‘পকেট কাটার’ দায় ফড়িয়া সিন্ডিকেটের ওপর চাপাচ্ছেন পাইকারি ব্যবসায়ীরা। মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণে গ্রামের তুলনায় ১১ থেকে ১২ গুণ বেশি দামে শাক-সবজি কিনতে হচ্ছে রাজধানীবাসীকে। বিভিন্ন জেলার শাক-সবজি চাষি এবং রাজধানীর বিভিন্ন পাইকারি ও খুচরা বাজার সরেজমিন ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে।

বগুড়ার শিবগঞ্জের মহাস্থান হাটে ফুলকপি বিক্রি করতে এসে হতাশ সে এলাকার মোকামতলার কৃষক কাসেম মণ্ডল। তিনি বলছিলেন, বাড়িতে গরু-ছাগল থাকলে তাদেরই খাওয়াতাম। উৎপাদন খরচ বাদ দিলাম, মাঠ থেকে হাট পর্যন্ত নিয়ে আসতে কেজি প্রতি যে খরচ হচ্ছে, সেই টাকাও আমরা পাচ্ছি না। দেশে সবজির অন্যতম বড় মোকাম মহাস্থান হাটে শুধু ফুলকপি নয়, শীতকালীন সবজির মধ্যে বাঁধাকপি, মুলা, শিমসহ আরও কয়েকটি সবজির দাম কৃষক পর্যায়ে পুরোপুরি ‘পড়ে’ গেছে। দেশের যেসব অঞ্চলে শীতকালীন এই সবজিগুলোর চাষ বেশি হয়, তার মধ্যে অন্যতম উত্তরাঞ্চলের তিন জেলা বগুড়া, গাইবান্ধা আর দিনাজপুর।

কৃষক পর্যায়ে যে ফুলকপি দুই থেকে আড়াই টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে, সেটি হাত বদলে রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে বিক্রি হচ্ছে গড়ে ২০ টাকা করে। কৃষক পর্যায়ে বাঁধাকপি আর মুলাও দুই থেকে আড়াই টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। অথচ ঢাকায় এসব সবজিও ২০ থেকে ২৫ টাকা করে কিনতে হচ্ছে। বগুড়ায় কৃষক পর্যায়ে প্রতিকেজি কাঁচামরিচ ২৫ টাকা, শিম ২০ টাকা আর বেগুন ১৫ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে। অথচ রাজধানীর বাজারগুলোতে কাঁচামরিচ ৫০ টাকা, শিম ৩০ থেকে ৫০ টাকা, বেগুন ৫০ থেকে ৬০ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে। রাজধানীর মহাখালী ও কারওয়ান বাজারে ঘুরে দেখা গেছে, খুচরা পর্যায়ে আকৃতিভেদে প্রতিটি ফুলকপি ও বাঁধাকপির দাম পড়ছে গড়ে ২০ টাকা। তবে আড়ত থেকে পাইকারি কিনলে দাম পড়ছে ১২ থেকে ১৫ টাকা প্রতিটি।

কারওয়ান বাজারের পাইকারি সবজি বিক্রেতা মোবারক হোসেন বলেন, আমরা দুই তিন টাকায় কিনতে পারি না। আমরা কিনেছি স্থানীয় আড়তদারের কাছ থেকে। তারা কৃষকদের থেকে হয়ত আরও কমে কিনেছে। এর সঙ্গে আমাদের পরিবহন খরচ, গুদামসহ দোকান ভাড়া, বিদ্যুৎ বিলের হিসেব রয়েছে। বগুড়া থেকে আসার পর, সবজি আনলোড যারা করে, তাদেরও পয়সা দিতে হয়। সব মিলিয়ে আমরা ১২ থেকে ১৫ টাকা কেজি করে বিক্রি করছি। এই বাজারের খুচরা সবজি বিক্রেতা সবুজ হোসেন বলেন, আমরা বগুড়া থেকে পাইকারি কিনে এনে ফুলকপি খুচরা বিক্রি করি। এখন তো আগের তুলনায় সব শীতকালীন সবজির দাম কম।

কীভাবে হাত বদলে এই সবজির দাম বেড়ে যায়? সবুজ হোসেন বলছেন, প্রথমে কৃষকরা স্থানীয় বাজারে নিয়ে আসে। পরে সেখানকার পাইকার বা আড়তদাররা সেগুলো মণ হিসেবে কিনে নেয়। এরপর ট্রাক বা পিকআপে করে আসে রাজধানীতে। এভাবে কয়েকটি হাত বদল হয়েই মূলত সবজির দাম বাড়ে। আমরা যারা শেষ ধাপে আছি, তারা তো আর সরাসরি কৃষকদের থেকে কিনতে পারি না। স্থানীয় বাজারগুলোতে ফড়িয়াদের সিন্ডিকেট থাকে। তারা সবাই মিলে একটা দাম নির্ধারণ করে দেয়। এরপর সেই দামে কৃষকদের থেকে কিনে নেয়। এই বাজারের আরেক বিক্রেতা আরিফ হোসেনও বললেন একই কথা। তিনি বলেন, খুচরা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কৃষকদের সরাসরি সংযোগ থাকলে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য কমত। তাতে মানুষও কম দামে শাক-সবজি পেত। আবার কৃষকরাও লাভবান হতো।

বগুড়ার মহাস্থান হাটে পাইকারি সবজির দাম একেবারেই তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। সোমবার দেশের অন্যতম বড় শাক-সবজির বাজার মহাস্থান হাটে গিয়ে সবজির দাম পতনের এমন তথ্য পাওয়া গেছে। বাজার ঘুরে দেখা গেছে, মুলা বিক্রি হচ্ছে কেজি প্রতি দুই টাকা, ফুলকপির কেজিও দুই টাকা থেকে আড়াই টাকা করে। আর, বাঁধাকপি দুই টাকা থেকে তিন টাকা। পৌষের মাঝামাঝিতে এসব সবজির দামে ধ্বস নামায় মাথায় হাত পড়েছে কৃষকদের। ভালো লাভের আশায় শীতকালীন সবজির চাষ করে বিপাকে পড়েছেন তারা। অবশ্য পৌষ মাসের আগে শীত যখন নামতে শুরু করেছে, তখন কিছুদিন তারা ভালো দাম পেয়েছেন। এখন বাজারে সরবরাহ বেশি থাকায় দাম কমে যাচ্ছে। মৌসুমের এই সময়ে ফসল আবাদের খরচ না উঠলেও বাধ্য হয়ে কম দামেই সবজি বিক্রি করতে হচ্ছে কৃষকদের। বেপারিদের দাবি, দাম কমে যাওয়ায় ‘লোকসানে’ পড়তে হচ্ছে তাদেরও। কৃষক ও পাইকারি বাজারে দাম পড়তি হলেও হাতবদল হয়ে ১০০ গজ দূরে খুচরা বাজারেই এসব সবজি ৫ থেকে ২০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে।

মহাস্থান হাটে ফুলকপি বিক্রি করতে আসা বগুড়ার মোকামতলার কৃষক কাসেম মণ্ডলের জিজ্ঞাসা, ফুলকপির মতো সবজি মাত্র এক থেকে চার টাকা কেজিতে কখনও বিক্রি হতে পারে? মুলার কেজি দুই টাকার বেশি পাওয়া যাচ্ছে না। শীতের সবজির মধ্যে ফুলকপি বেশ জনপ্রিয়, মাছ দিয়ে রান্না করে খেতেও সুস্বাদু। ফুলকপি দিয়ে তৈরি হয় পাকোড়ার মতো মুখরোচক খাবারও।

বগুড়ার মহাস্থানগড় এলাকার আরেক কৃষক হযরত আলী বলেন, প্রতি বিঘায় ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা লোকসান হয়েছে ফুলকপি চাষ করে। কৃষকদের জ্বালা কেউ বোঝে না। কাউকে বলতেও পারছি না, সহ্যও করতে পারছি না। তিনি বলেন, কাঁচা সবজি রাখার জন্য হিমাগারও নেই যে সেখানে রাখব। সবজি জমি থেকে না ওঠালে নষ্ট হয়ে যাবে। আবার বাজারে এনে লাভ হচ্ছে না। পরিবহন খরচও উঠছে না। এই বাজারের আড়তদার তাহেরুল ইসলাম বলেন, প্রতিদিন মহাস্থান হাট থেকে রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে অন্তত ৮০ থেকে ৯০ ট্রাক সবজি যায়। শীতের প্রথমে চাষিরা ভালো দাম পেলেও সরবরাহ বাড়ায় এখন দাম কমে গেছে।

আমদানি ও ফলন বেশি হওয়ায় বগুড়ার পাশের জেলা গাইবান্ধাতেও শীতের সবজির দাম কমে গেছে। এই জেলার হাট-বাজার ঘুরে জানা গেছে, গাইবান্ধার পাইকারি বাজারগুলোতে প্রতিকেজি ফুলকপি ৫ থেকে ৬ টাকা, বাঁধাকপি ৪ থেকে ৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া, বেগুন ৫ থেকে ৬ টাকা ও শিম ৫ থেকে ৬ টাকা কেজি দরে কৃষকরা পাইকারদের কাছে বিক্রি করছেন। হাত বদলের পর স্থানীয় খুচরা বিক্রেতারা প্রতিকেজি ফুলকপি ১০ টাকা, বাঁধাকপি ৭ থেকে ৮ টাকা, বেগুন ১০ টাকা ও শিম ১০ থেকে ১৫ টাকা দরে বিক্রি করছেন। গাইবান্ধার সাদুল্লাপুর খুচরা বাজারের ক্রেতা বিক্রেতারা জানান, গত এক সপ্তাহে সবজিসহ বিভিন্ন নিত্যপণ্যের দাম উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে।

সাদুল্লাপুর উপজেলার ধাপরেহাট ইউনিয়নের নিজপাড়া গ্রামের সবজি চাষি আতোয়ার মিয়া ৩০ শতক জমিতে বাঁধাকপি আবাদ করেছেন। সর্বমোট খরচ হয়েছে ২২ হাজার টাকা। তিনি বলেন, বাজারে কপি নিয়ে এসে দেখি ৫ টাকা কেজি দরেও পাইকাররা কিনছেন না। হঠাৎ করে দাম কমে যাওয়ায় এবছর তার খরচের টাকাই উঠবে না। মূলধন খোয়া যাবে। একই উপজেলার ইদিলপুর ইউনিয়নের কাঠাল লক্ষ্মীপুর গ্রামের কৃষক সাদা মিয়া একই বাজারে ফুলকপি বিক্রি করেছেন প্রতি কেজি ৫ থেকে ৬ টাকা দরে।

বগুড়া আর গাইবান্ধার মতো দিনাজপুরেও বাজার পড়ে গেছে ফুলকপির। অনেক জায়গায় মাঠেই পড়ে থাকছে এই শীতকালীন সবজিটি। দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলার কৃষক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, মাঠেই পড়ে থাকছে ফুলকপি। ক্রেতা নেই। কৃষকের কাছ থেকে কেনা হচ্ছে প্রতি মণ ৪০ টাকা দরে। প্রতিটা এক থেকে দেড় টাকা। যেটা খুচরা বাজারে ক্রেতা কিনছে প্রতি কেজি ১৫ টাকা দরে।

এদিকে, বাজার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণেই কৃষক পর্যায়ে পানির দামে কেনা শাক-সবজি রাজধানীসহ বিভাগীয় শহরগুলোতে চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে। এক মাস আগের আকাশচুম্বী দামের তুলনায় বর্তমানে কিছুটা স্বস্তিদায়ক হলেও গ্রামের তুলনায় অনেক বেশি দামেই শাক-সবজি কিনতে হচ্ছে ক্রেতাদের। সিন্ডিকেট ভাঙতে না পারলে মার্চেই আবার অসহনীয় পর্যায়ে চলে যাবে শাক-সবজির দাম।

 

ভোরের আকাশ/রন

মন্তব্য