বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রধান দুটি পরিবার হলো ‘শেখ পরিবার’ আর ‘জিয়া পরিবার’। এই দুই পরিবারের সবাই এখন একযোগে বিদেশে অবস্থান করছেন। তবে ‘শেখ পরিবার’ ও ‘জিয়া পরিবার’র সদস্যদের দেশের বাইরে অবস্থানের প্রেক্ষাপটও সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী। কারণ ব্যাপক-অনিয়ম, দুর্নীতি, গুম-খুনের সঙ্গে জড়িত পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার পতনের পরিণতি বুঝতে পেরে আগেই আত্মীয়-স্বজনকে নিরাপদে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেন। শেষে নিজেও দেশ ছাড়েন। তবে সেটা পালিয়ে। গণঅভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট নিজে ক্ষমতা ছেড়ে তড়িঘড়ি করে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন। এখনও তিনি সেখানে অবস্থান করছেন। অপরদিকে বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ক্ষেত্রে বিষয়টি সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র। পতিত আওয়ামী লীগের আমলে চিকিৎসার মতো মৌলিক ও মানবিক আবেদনে সাড়া পাননি তিনি। শেষ পর্যন্ত ফ্যাসিস্টের পতনের পর দেশ ও গণতন্ত্রের প্রশ্নে ‘আপসহীন’ খেতাবপ্রাপ্ত বেগম খালেদা জিয়া গতকাল মঙ্গলবার কাতারের আমিরের দেওয়া বিশেষ এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে সসম্মানে ঢাকা ছেড়েছেন।
শেখ হাসিনার ছোট বোন শেখ রেহানা, তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল ও শেখ রেহানা ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি এখন দেশের বাইরে অবস্থান করছেন। আর আগেই শেখ রেহানার মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিক ও আজমিনা সিদ্দিক রূপন্তী আগেই বিদেশে স্থায়ী। ২০০৭ সালে ১/১১’র বিশেষ প্রেক্ষাপটের পর শেখ হাসিনা কারামুক্তির পর চিকিৎসার নামে দেশ ছাড়লেও বেগম খালেদা জিয়া দেশেই থেকে যান। কারণ তখন দুই নেত্রীকে বিদেশে পাঠিয়ে দিয়ে ‘মাইনাস টু ফর্মুলা’ বাস্তবায়নের অপচেষ্টা হয়েছিল। এটা আঁচ করতে পেরেই বেগম খালেদা জিয়া দেশত্যাগ করেননি। তবে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থাকা বেগম খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমান (বর্তমানে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান) ২০০৮ সালে চিকিৎসার জন্য লন্ডনে যান। এখনও তিনি সেখানেই অবস্থান করছেন। তিনি সেখান থেকেই দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। আর ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকো চিকিৎসার জন্য বিদেশে গেলেও মালয়েশিয়া অবস্থানকালে মারা যান। স্বামী মারা যাওয়ার পর কোকোর স্ত্রী শর্মিলা রহমান মালয়েশিয়া থেকে দেশে যাওয়া-আাসার মধ্যেই ছিলেন। তবে সরকার পতনের পর তিনি দেশেই ছিলেন। তিনি খালেদা জিয়ার সফরসঙ্গী হয়ে লন্ডন গেছেন। এমন প্রেক্ষাপটে এবারও হঠাৎ রাজনীতির প্রধান দুই পরিবারের সবাই বিদেশে অবস্থান করায় রাজনীতিতে বিষয়টি নিয়ে শুরু হয়েছে গুঞ্জন-আলোচনা।
এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী দৈনিক ভোরের আকাশকে বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া গুরুতর অসুস্থ। তিনি নানা রোগে আক্রান্ত। চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে নিতে অনেক চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সরকার সে সুযোগ দেয়নি। এখন পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে চিকিৎসার জন্য বেগম খালেদা জিয়া বিদেশে গেছেন। সুস্থ হয়ে তিনি ফিরে আসবেন ইনশাল্লাহ। তিনি বলেন, ‘আপসহীন’ বেগম খালেদা জিয়া অবশেষে তিনি সম্মান নিয়েই দেশের বাইরে গেছেন। আর ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা জীবনের ভয়ে পালিয়ে দেশত্যাগ করেছেন। তাই শেখ হাসিনা ও বেগম খালেদা জিয়ার বিদেশে অবস্থানের মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য রয়েছে। শেখ হাসিনার জন্য ধিক্কার আর ঘৃণা। অপরদিকে বেগম খালেদা জিয়ার জন্য মানুষের ভালোবাসা।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. দিলারা চৌধুরী এ বিষয়ে দৈনিক ভোরের আকাশকে বলেছেন, গণতন্ত্র হত্যাকারী কোনোদিন সসম্মান নিয়ে বাঁচতে পারেন না। বিশ্বে এরকম অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে। শেখ হাসিনা তার জ¦লন্ত নজীর। আর যারা গণতন্ত্রের জন্যে ত্যাগ স্বীকার করেন তারা সাময়িক কষ্টে থাকলেও মানুষ তাদের স্মরণ করেন। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। এখন তিনি বিদেশে যাচ্ছেন সম্মান নিয়ে। তিনি চিকিৎসা নিতে যাচ্ছেন। আর শেখ হাসিনা তো পালিয়েছেন। তিনি তো পলাতক। দুই জনের প্রেক্ষাপট একেবারে ভিন্ন।
বেগম খালেদা জিয়া। তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও দেশের বৃহৎ ও জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) চেয়ারপারসন। স্বামী শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান শহীদ হওয়ার পর তিনি বিএনপির হাল ধরেন। আস্তে আস্তে রাজনীতিতে নিজেকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। দেশ ও মানুষের অধিকার আদায়ের প্রশ্নে তিনি ‘আপসহীন’। বারবার তিনি এটা প্রমান করেছেন। তাইতো তার নামের শেষে বারবার যুক্ত হয় ‘আপসহীন’।
জানা গেছে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কথিত দুর্নীতির দুই মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি কারাগারে যান খালেদা জিয়া। এরপর থেকেই খালেদা জিয়ার বিদেশে উন্নত চিকিৎসার জন্য তার পরিবার এবং দল থেকে একাধিকবার দাবি জানানো হয়েছে। কারাবাসকালীন খালেদা জিয়াকে কারা কর্তৃপক্ষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে ভর্তি করলেও বিদেশে যাওয়ার অনুমতি দেয়নি সরকার। সরকারের পক্ষ থেকে বিষয়টি নিয়ে আদালতে যাওয়ার কথা বললে দলের পক্ষ থেকে বারবার আদালতের দ্বারস্থ হলেও তাকে বিদেশ যাওয়ার অনুমতি দেয়া হয়নি। ২০২০ সালের মার্চে তৎকালীন ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের নির্বাহী আদেশে শর্তসাপেক্ষে ৬ মাস করে সাজা স্থগিত রাখা হয়। বেশ কয়েকবার তার সাজা স্থগিতের মেয়াদ বাড়ানো হয়। এরপর বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া গুলশানের বাসভবন ফিরোজায় থাকলেও এ সময়ে তাকে একাধিকবার জরুরি ভিত্তিতে এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তার হার্টে রিং পরানো হয়েছে, লিভার সিরোসিসের চিকিৎসায় যুক্তরাষ্ট্র থেকে চিকিৎসক এনে ‘টিপস’ করানো হয়েছে। কিন্তু তারপরও তার বিদেশে চিকিৎসার দরজা উন্মুক্ত হচ্ছিল না।
অবশেষে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পরদিন ৬ আগস্ট খালেদা জিয়া মুক্তি পান। এর পরপরই তার বিদেশযাত্রা নিয়ে প্রস্তুতি শুরু হয়। তিনি কোনো দেশে যেতে পারেন, সেটা নিয়ে খালেদা জিয়ার মেডিকেল বোর্ড ও পরিবার একাধিকবার বৈঠক করেছে। এ সময়ের মধ্যে বেগম জিয়ার শারীরিক অবস্থাও দীর্ঘ ভ্রমণের জন্য সায় দিচ্ছিল না। এমন অবস্থায় তার শারীরিক অবস্থা দীর্ঘ ভ্রমণের উপযোগী করে তোলা, কোনোভাবে তাকে বিদেশে নেওয়া যায় এবং তার পাসপোর্ট জটিলতা নিরসনের ব্যাপারেও উদ্যোগ নেওয়া হয়। এরইমধ্যে তার নতুন পাসপোর্ট করানো, ভিসা জটিলতা সব কিছু কেটে গেছে। তিনি যুক্তরাজ্য ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরবের ভিসাও পেয়েছেন।
বিএনপি চেয়ারপরসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার উন্নত চিকিৎসায় বিদেশ যাত্রার জন্য কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানি রাজকীয় বহরের এয়ার অ্যাম্বুলেন্স দিয়েছেন। সোমবার রাতেই সেটি বাংলাদেশে এসে পৌঁছেছে। সর্বাধুনিক চিকিৎসা সুবিধা সংবলিত এই বিশেষ এয়ার অ্যাম্বুলেন্সের ফ্লাইটে করে গতকাল মঙ্গলবার রাত ১০টার দিকে লন্ডনের উদ্দেশ্যে ঢাকা ছেড়েছেন বেগম খালেদা জিয়া। রাত ৮ টায় গুলশানের বাসা ‘ফিরোজা’ থেকে তিনি ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্টে পৌঁছান। বেগম খালেদা জিয়া বিদেশ যাচ্ছেন, একারণে গতকাল তার বাসার সামনে ভিড় জমান হাজারো নেতাকর্মী। উপচেপড়া নেতাকর্মীদের ভিড় আর নিরাপত্তার স্বার্থে সতর্ক অবস্থান নেয় আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে।
খালেদা জিয়ার বিদেশযাত্রার মাধ্যমে ফের দেশের প্রধান দুই পরিবারের সব সদস্য একযোগে বিদেশে অবস্থান করছেন। একারণেই ১/১১’র বিশেষ প্রেক্ষাপট ফের আলোচনায়। সবার মধ্যে গুঞ্জন ‘মাইনাস টু ফর্মুলা’। যদিও দেশের বর্তমান পেক্ষাপটে সেটা বাস্তবায়ন করা একেবারেই প্রায় অসম্ভব বলে সচেতন মহলের ধারণা। তাদের যুক্তি, ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে যেভাবে দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক শক্তি ও সাধারণ মানুষ শেখ হাসিনা ও তার দোসরদের বিরুদ্ধে মাঠে নেমেছে, তাতে জিয়া পরিবারকে বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে মাইনাস করার সুযোগ নেই। সেটা বার বার প্রমাণিত হয়েছে গত ৫ আগষ্টের পর আনসার লীগ, রিকসা লীগ, ইসকনের নামে আওয়ামী লীগ ও ভারতের দোসরদের ফিরে আসার অপচেষ্টা সম্মিলিতভাবে প্রতিহতের মধ্য দিয়ে।
এদিকে, গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে সরকার পতনের পর ক্ষমতা ছেড়ে শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়েছেন। তিনি ক্ষমতায় থাকাবস্থায় মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল বেশিরভাগ সময় দেশেই ছিলেন। ছেলেকে সজীব ওয়ায়েদ জয়কে নিজের আইসিটি উপদেষ্টা করলেও তিনি বেশিরভাগ সময় বিদেশে অবস্থান করতেন। এখন তিনি ওয়াশিংটন ডিসিতে অবস্থান করছেন বলে জানা গেছে। আর মেয়ে রয়েছেন ভারতে। শেখ হাসিনার ছোট বোন শেখ রেহানাও বড় বোন শেখ হাসিনার সঙ্গে ভারতে পালিয়ে যান। শেখ রেহানার ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিকী ববি বেশিরভাগ সময় দেশে থাকলেও ৫ আগস্টের সরকার পতনের আগেই তিনি দেশত্যাগ করে। আর শেখ রেহানার মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিকী ব্রিটিশ মন্ত্রী। তিনি সেখানে স্থায়ী। অর্থাৎ দুই রাজনৈতিক পরিবারের সদস্যরা এখন সবাই দেশের বাইরে।
জানা গেছে, ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত শেখ হাসিনা ভোটবিহীন নির্বাচনে ক্ষমতায় থাকাকালে তার পরিবারের সদস্য এবং আত্মীয়রা ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতি করে বিদেশে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করেন। তাদের অত্যাচার ও নির্যাতনের ক্ষত এখন সর্বত্র। খোদ শেখ হাসিনা ফ্যাসিস্ট, গণহত্যা ও গণতন্ত্র হত্যাকারী হিসেবে নিজেকে পরিচিত ডেকে এনেছেন। ক্ষমতা হারালে তার ও পরিবারের সদস্যদের পরিণতি সম্পর্কে শেখ হাসিনার আগেই ধারণা ছিল। যেকারণে নিজের ক্ষমতার নড়বড়ে অবস্থা দেখে তিনি আগেই আত্মীয় স্বজনদের দেশ ছেড়ে চলে যাওয়া নিশ্চিত করেন। এরপর পর তিনি গত ৫ আগস্ট ক্ষমতা ছেড়ে পালিয়ে যান।
ভোরের আকাশ/রন
মন্তব্য